বইমাত্রিক রাহুল গাঙ্গুলি

কবিতা-কবিতা : চেতনা নেপথ্যে উৎসেচক ক্ষরণ

(১টি আলাদা পর্যবেক্ষণ)

বই : কবিতার ফর্ম
লেখক : অরুণ দাস
প্রকাশক : জলদর্চি (২০২০)

সাধারনতঃ কবিতার ফর্ম বিষয়ক কোনো বইয়ের শিরোনাম দেখলেই ~ সেখানে সময়ের সাপেক্ষে কবিতার অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন বিবর্তন আশা করাটা স্বাভাবিক।আজ যে, বইটি নিয়ে আলোচনা করতে চলেছি, সেটিও পড়ার নেপথ্যে ব্যক্তিগতোভাবে, এরকমই কিছুটা কারণ ছিলো অনেকগুলির মধ্যে।কিন্তু পড়া শুরু করতেই, যেটা বোঝা গ্যালো এসবের ভিতর দিয়ে লেখক হাঁটেন নি; বরং তিনি এসবের চেয়েও যে সকল গুরুত্বপূর্ণ বা প্রয়োজনীয় কথাগুলি লিখেছেন : তা পাঠ করতে, পাঠক (বিশেষতঃ বাঙালী পাঠক) অনভ্যস্ত তো বটেই, বরং তাঁর আত্মবিকাশের ক্ষেত্রে এসব জরুরি; অনেকেই হয়তো তা উপলব্ধি করবেন ভবিষ্যৎের বিশেষ একটা সময়ে।প্রতিটি সৃজনশীলতার নেপথ্যে থাকে এক বিশেষ মনোবৈজ্ঞানিক চড়াই-উতরাই।একটা বিশেষ গতিবেগ; কারণ সময় ও জার্নির দূরত্ব।আবার এই গতিবেগ দ্বারা প্রাপ্ত আঘাতটির পুনরাবৃত্তি বারবার ঘটে : চেতনার জারন-বিজারণের ফলে উপলব্ধ প্রকাশ তখোন; বিমূর্ত থেকে মূর্ততায় যাবার জন্য একটি বিশেষ আকারকে ধারক হিসেবে গণ্য করলে, যে শব্দটির অবতারণা করতে হয় ~ কম্পাঙ্ক।এই কম্পাঙ্ক ও গতিবেগ সান্নিধ্য গাণিতিক মডেল প্রকাশ করতেই পারে, চেতনা ও প্রকাশের স্থানাঙ্ক পরস্পরলগ্ন সাপেক্ষে।অনেকেই এবার জিজ্ঞাসা করতেই পারেন : চেতনা’র সাথে পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতের সম্পর্ক কোথায় বা কিভাবে।এখানে উত্তরটি এরকম হওয়া উচিৎ ~ চেতনার প্রকাশিতো প্রতিফলনটি যদি চিন্তা হয়, সমান্তরালে ভাব থেকে যদি ভাবনা হয়; তা যে অসংখ্য অসীমতার অভিব্যক্তি, একথা নিশ্চয়ই স্বীকার্য হবে।আর এখান থেকেই শুরু হবে বইটির পাঠ-প্রস্তুতি।আজ পর্যন্ত কবিতা বিষয়ক যেসকল আলোচনা করা হয়েছে, তা মূলতঃ : (১) কবিতার বিশ্লেষণ নির্ভর; (২) কবিতার নেপথ্যে থাকা মতাদর্শগতো বিষয়ক; (৩) কবির আত্ম-বিশ্লেষাত্মক অনুভূতির গ্রন্থন বা ডকুমেন্টেশন্; (৪) একজন নিগূঢ় পর্যবেক্ষক রূপে, কবির অভিজ্ঞানলব্ধ দেখা; (৫) কবিতা বিবর্তনের ইতিহাস।বর্তমানে আলোচিতো বইটি, এসবের কোনো ধারার নয়।বরং, বলা ভালো বইটিকে এসবের কোনো শ্রেণীভুক্ত করাটা, নেহাতিই স্ব-আত্তীকরণের অক্ষমতা।বিদেশে, যেসব জায়গায় কবিতা নিয়ে চর্চা হয় (অসংখ্য চর্চাক্ষেত্র, কিন্তু তুলনামূলকভাবে আকারে ক্ষুদ্র); সেখানে যে দুটি বিশেষ বিষয়ের প্রতি মনোযোগ দেওয়া হয় ~ ভাষাবিজ্ঞান এবং মনোবিদ্যা; দুটির সংযোজনায় মনোভাষাবিজ্ঞান।সাধারনতঃ আমাদের দেশে, এই দুটি বিষয় নেহাতিই গড়পড়তায় অপ্রাসঙ্গিক।তবে, দৈনন্দিন চর্চা যাঁরা করে থাকেন; যাঁরা নতুন দিশার প্রয়োজনে মনোজগৎকে ধাবমান করেন, তাঁদের কবিতার পাশাপাশি উল্লেখিতো বিষয়টি নিয়ে চর্চা করতেই হয়।চর্চা করাটা অতি-আবশ্যক্, নিজের কাছেই; নিজের গতি ও চার্জকে ঠিকঠাক রাখতে।আর এখানে বলতে চাই, বাংলা কবিতা বিষয়ক মনোভাষাবিজ্ঞান চর্চায়, এই বইটি গুরুত্বপূর্ণ এবং সর্বপ্রথম : কারণ, মনোবৈজ্ঞানিক অবস্থান এবং কবিতার ধারনাগতো ধারকটির অবস্থানের সাথে তাত্ত্বিক-বিশ্লেষণের মেলবন্ধন।আপাততো, ৮৪পাতার বইটিকে একটা সাংঘাতিক প্রচেষ্টা বলে মনে করতেই পারি।তার চেয়েও বড়ো কথা এই বিমূর্ত জায়গাটি নিয়ে বিশ্লেষণ-প্রচেষ্টার ভয়াবহো সাহস।
মোট ৬টি পরিচ্ছেদ নিয়ে এই বইটি : একটি প্রত্যাশিত হইচই; অনুভবের জ্যামিতি; কবিতার ক্রম উন্নতি ও ফর্ম; কবির অনুভবের জগৎ : জেড্ (z) প্রজন্মের কবিতাযুগের সূচনা; কবিতা মূল্যায়নের পথ; কবিতা প্রসঙ্গে।লেখক অরুণ দাস’র সাথে যে ব্যক্তিগতো প্রচুর পরিচিতি আছে অথবা খুব যে বিরাট কথাবার্তা বা ইন্টার‌্যাকশন হয়েছে, তাও নয় (যদিও, এগুলির অতি-অবশ্যই প্রয়োজন)।আসুন বন্ধুরা, এবার আমরা বইটির প্রতিটি পরিচ্ছেদগুলি নিয়ে, আলাদা-আলাদাভাবে দুচার কথা আলোচনা করি।এতে মনে হয় ~ সকলেই বইটির সম্পর্কে একটি প্রাথমিক ধারনা পেতে পারেন।
য্যামোন, প্রথম পরিচ্ছদ “একটি প্রত্যাশিত হইচই” : এখানে, লেখক শুরুটাই করেছেন ~ কবি ও পাঠকের পারস্পরিক সম্পর্ক দিয়ে।সাধারনতঃ, আমরা ‘কবির চোখে পাঠক’ এবং সমান্তরালভাবে ‘পাঠকের চোখে কবি’ সম্পর্কিতো বিষয়টা নিয়ে যেসব বক্তব্য শুনে থাকি; চেষ্টা করা হয়েছে নিরপেক্ষ একটি অবস্থান থেকে সেইসব বক্তব্যের অযৌক্তিকতা তুলে ধরার প্রয়াস।এমনকি, নতুনভাবে যাঁরা লিখতে চান বা পড়তে চান, রয়েছে সে বিষয়কও একটি তুলনামূলক লেখকীয় অবস্থান।ভূল / ঠিক প্রমাণ করা তাত্ত্বিকদের কাজ, কাজেই এই প্রসঙ্গটি এখানে আলোচনা করবো না; যেহেতু আমি তাত্ত্বিক-গোত্রের নই।দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ “অনুভবের জ্যামিতি” : এখানে, লেখক বিশ্লেষণ করেছেন পাঠকের কাছে অনুভূতি বিষয়টি ঠিক কিরকম।প্রকল্পিতো করার জন্য, লেখক সহায়ক হয়েছেন ‘জ্যামিতি’ বিষয়টির প্রতি।শুধু কবিতা নয়, শিল্পের যেকোনো ধারা/উপধারায় (সেটি চিত্রকার্য বা পেইন্টিং থেকে সঙ্গীত, থিয়েটার বা সিনেমা), জ্যামিতি বিষয়টির প্রভাব আলোচিতো হয়েছে নিপুণভাবে।অবতারণা করা হয়েছে, পৃথিবীর বিভিন্ন অবস্থানে থাকা মানুষের কাছে জ্যামিতির প্রাথমিক চিত্রগুলি কিভাবে ভাষার্থ বহন করে (বিভিন্ন সময়ের মানুষ / বিভিন্ন ভাষাভাষীর মানুষ)।তৃতীয় পরিচ্ছেদ “কবিতার ক্রম উন্নতি ও ফর্ম” : এখানে প্রধানতো আলোচিতো হয়েছে, একজন কবি যখোন একেকটি প্রাথমিক স্তর পেরিয়ে পরবর্তী স্তরে পৌঁছান; তার কিছু চেতনা-নেপথ্যের বিশ্লেষণ।পৌঁছানো বা এই নতুনত্ব অভিমুখিনী জার্নির পেছনে থাকা প্রবণতা / ভাবনা / ঝোঁকের কারন / পাঠকশ্রেণীর অনুভব / প্রভৃতির বিশ্লেষণ ও উপস্থাপনা ভীষনরকমের বৈচিত্র্যপূর্ণ, মৌলিক এবং বইটির উৎকৃষ্ট সম্পদ।বিভিন্ন ব্যাখ্যায় সহায়তা নেওয়া হয়েছে রেখচিত্র বা গ্রাফ্ এবং ফ্লো-চার্ট (স্বল্পস্থানে কোনো প্রবাহমুখীনতার কার্যকারণ সহো দ্বিমাত্রিক প্রকাশ)।বিশেষতঃ, উদাহরণস্বরূপ জীবনানন্দ দাশ’র ‘বনলতা সেন’ কবিতাটির আংশিক উপস্থাপনের বিশ্লেষণে, যেভাবে লজিক্যাল্ মডেল বা প্রযুক্তি-দর্শন ভাবনার মডেল বা গণিতকে দ্যাখানো হয়েছে ~ তা এককথায় দীর্ঘচিন্তনের ফসল।
চতুর্থ পরিচ্ছেদে আসি, শিরোনাম “কবির অনুভবের জগৎ : জেড্ (z) প্রজন্মের কবিতাযুগের সূচনা” : এই পরিচ্ছেদ মূলতঃ কবির চেতনার আড়ালে থাকা মনোজাগতিক নানান্ বিন্যাসকে বিশ্লেষণ।মনোজগতের নানান্ ‘গুন’ ও ‘শক্তি’ বা ‘রঙের ব্যবহার’ ইত্যাদি বিভিন্ন মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ, অতিচেতনা / মহাচেতনা থেকে কবিতায় ভাবনার বিস্তৃতি বা টেকনিকের ব্যবহার ~ অবশ্যই পাঠককে সমৃদ্ধ করবে।পরবর্তী পরিচ্ছেদ “কবিতা মূল্যায়নের পথ” : এই পর্যায়টি আলোচিতো হয়েছে মূলতঃ কবিতা ভাবনার মূল্যায়ন বা প্রকৃত সমালোচনার সমস্যাগুলির ওপরে।কিছু নমুনামূলক সম্ভাব্য মূল্যায়ন এবং তার সমস্যা সম্পর্কিতো কয়েকটি সমাধানও রয়েছে এখানে।কবিতার চিন্তাভাবনার অভ্যন্তরীণ জগতে ধ্রুবকের ব্যবহার, চেতনা-তরঙ্গের গতিশীলতা, ইত্যাদি বিষয় বাংলা কবিতা জগতে নতুন আঙ্গিকে ডকুমেন্টেশন; একথা অগ্রজ / অনুজ, কোনো পূর্ববর্তী লেখক/কবি’কে ছোটো না করেও বলা যায়।সর্বশেষ পরিচ্ছদ “কবিতা প্রসঙ্গে” : কবিতার ‘বাস্তবতা’ বা একটি কবিতার শরীরের পেছনে যেসব চিন্তা, তার প্রকরণগতো ব্যবহারিকগুলি বা কবিতায় এক্সপেরিমেন্ট, ইত্যাদি নানান্ বিষয়ের একটি তুল্যমূল্য কনক্লুশন্ বা অভিমুখ তুলে ধরা; এসবই এই পরিচ্ছেদের অংশ।আমরা বলতে পারি, সমাপ্তি ঘোষনার পরও যেরকম কিছু প্রয়োজনীয় না-বলাগুলি থেকে যায়, তার একটা ডকুমেন্টেশন্ ~ অতি সহজবোধ্যভাবে ও সহজকথায় বাস্তব-পরাবাস্তব-অতিচেতনা’র মতো জটিল চ্যাপ্টারগুলিকে বন্ধনীমুক্তির প্রয়াস।
অবশ্য পুরো বইটি পাঠের পর, ব্যক্তিগতভাবে বইটির সর্বস্তরের ও লেখকের সব অবস্থানের সাথে যে আমি সহমত, তা নয়।কয়েকটি বিষয়ের প্রতি দুর্বলতা এবং ১টি বিষয়ে বিরোধ; এখানে অতিপ্রয়োজনীয়ভাবেই উল্লেখ করতে চাই।তা অনেকটা এরকম : দুর্বলতা একেএকে বলছি :
১) বইটির শিরোনাম : এটা কবিতা ও চেতনার মধ্যে ডাইরেক্ট কমিউনিকেটিভ্ মিডিয়মের হলে, ভালো হতো||
২) কবিতার নেপথ্যে, মনোবৈজ্ঞানিক সম্ভাবনা ও পর্যবেক্ষণ যতোটা থিয়োরি দিয়ে বোঝানো হয়েছে, কিছু সরাসরি প্রয়োগ থাকলে আরো ভালো হতো।য্যামোন, বিভিন্ন আপাতো ঘটনায় মস্তিষ্ক কিভাবে সাড়া দেয় বা ইনফরমেশন এবং নলেজের ভেতর তফাৎ কী, এরকম জাতীয় হাতেকলমে প্র্যাকটিস||
৩) বইটিতে আরো কবিতা নমুনা এবং তার বিশ্লেষণ থাকলে, আরো ভালো হতো||
এবার, বিরোধিতা বলি : কবিতা ও চেতনার সমন্বয়কারী মাধ্যম হিসেবে, যেভাবে ধ্বনি ও শব্দার্থের প্রসঙ্গ তোলা হয়েছে, দৃশ্য প্রসঙ্গ সেভাবে নেই।দৃশ্যকল্প বললাম না কিন্তু।নির্মিতো কবিতায় একটি অচেনা অক্ষরও যেমন প্রভাব ফেলতে পারে; ত্যামোনই অভ্যস্ত অক্ষরটিও ১টি অনভ্যস্ত কবিতা নির্মাণ করতেই পারে।এ নিয়ে বহু কাজ হচ্ছে।ভাষার অভ্যন্তরীণ গঠনের ক্ষেত্রে, এনকোডিং-ডিকোডিং নতুন দিগন্ত খুলে ফেলেছে।সেখানে যে সবসময় ধ্বনি থাকবেই এমন নয়।
তবে যেটাই হোক, তর্ক-বিতর্ক, ইত্যাদি ব্যক্তিগতো বিচার্য বাদ দিয়েও একথা বলতে পারি : বর্তমান সময়ে ‘কী লিখছি’ ও ‘ক্যানো লিখছি’ থেকে ‘কী লিখবো’ ও ‘ক্যানো লিখবো’ বা সমান্তরালভাবে ‘কী পড়ছি’ ও ‘ক্যানো পড়ছি’ থেকে ‘কী পড়বো’ ও ‘ক্যানো পড়বো’; এই যে দীর্ঘ যাত্রাপথ, তা অতিক্রমণ করতে বেশ সহায়ক হবে এই বইটি।সুতরাং চর্চা হোক, শিল্পের নেপথ্য আলোকিতো হোক; আলোকিতো হোক ব্রহ্মাণ্ডের অতিসূক্ষ্ম দশাগুলি।একথা বলেই, আজকের বইমাত্রিক্ শেষ করছি।ভালো থাকুন সকলে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।