গদ্যে সঙ্গীতা দাশগুপ্ত

পেশা - সফট স্কিল ট্রেনার শখ - স্বপ্ন পূরণ শক্তি - ভালবাসা দুর্বলতা - ভালবাসা

করিৎকর্মা কবি

তুমি আমার চোখের বালি
তাই চোখে আমার কালি
আমার শূণ্য ভাতের থালি
পেটে দানাপানি নাই
আমি ঘরেই ফিরে যাই
ও আমি ঘরেই ফিরে যাই
…”দেখুন তো কেমন লিখলাম”

কথাটি বললেন যিনি তিনি গত ছ ঘন্টা আমার পাশে বসে মারাত্মক নাক ডেকে সবাইকে জাগিয়ে রেখে নিজে ঘুমিয়েছেন। ভদ্রলোক যারপরনাই পুলকিত হয়েছিলেন পাশে বাঙালী সহযাত্রী পেয়ে। প্রথমে যদিও ভাঙ্গা হিন্দিতে কথা বলেছিলেন “থোরা পাস দিজিয়ে। অন্দর ঘুসেগা” …

অপূর্ব এ হিন্দী শুনেই আমার বি টি রোডের জ্যামে দাঁড়িয়ে থাকা লরিগুলোর কথা মনে পড়ল… লরির পিছনে লেখা থাকে “জাগা মিলনে সে পাস দিয়া জায়গা”। তা ইনিও  থোড়া পাস মাঙ্গা।
আমি উঠে দাঁড়িয়ে ওঁকে ভিতরে যেতে দিলাম।
আমার আইল সিট। ফ্লাইটে মাঝে মাঝেই হাঁটতে উঠি বলে আমি সবসময় আইল সিটই কিনি। আগে আলাদা করে কিনতে হত না। এখন দিন দিন এয়ারলাইন্সের ভিখিরিপনা বাড়ছে। এর পর হয় বাথরুমেও পয়সা ফেলে ঢুকতে দেবে। তো  তাঁকে পাস তো দিলাম।  উনি আমার পাশেরটিতে। আর তার পাশের সিটে একটি বিদেশি ছেলে।
বিদেশি ছেলেটি খুব বেশি খাবে না আমাকে এ আমার অভিজ্ঞতায় জানি।  এরা একটানে চারটে সিনেমা দেখবে ট্যাবে, টুকটাক খাবে আর ঘুমোবে।  পাশাপাশি বসলে অল্প আড্ডাও মারতে পারে। তবে সে উপায় তো নেই।
খানিক পরে অবশ্য ওঁর ভুল ভাঙল।
আপনি বাঙালী? হে হে। বইটা দেখে বুঝলাম।
আমি তখনকার মত হ্যাঁ বলে বইয়ে মন দিয়েছিলাম। এর পর উনি  ঘুমিয়েছেন। আমিও ঘুমোতে পারতাম কিন্তু ওঁর  প্রবল পরাক্রমী নাসিকাবাদ্য আমাকে জাগিয়ে রেখেছিল। স্লিপ অ্যাপনিয়া সংক্রান্ত একটা লেখায় পড়েছিলাম মানুষ বসে ঘুমোলে নাক ডাকেন না। কারিগরি সমস্যা বা সমাধান আর কী। কিন্তু ইনি দেখলাম সেসব থিওরিকে কলা দেখিয়েছেন।
অতএব আমার হাতে তখনও “রানাঘাট লোকাল”।
জয় গোস্বামীর বিষাদ… “একজন কবিতালেখকের তো অধিকার আছে তার নিজের কোনও কোনও লেখা কবিতার বই বের করার সময় বর্জন করার? আছে কি না?”
এ বিষাদ আমাকে স্পর্শ করে কারণ আমি প্রাইভেট স্পেসে বিশ্বাসী মানুষ।  আমার মত নগন্য মানুষ অনায়াসে প্রাইভেট স্পেস তৈরি করতে পারে কিন্তু কিন্তু বিখ্যাত মানুষদের গোটা জীবনটাই পাবলিক স্পেস। সুলভ  ধৌতালয়। যে পারে গিয়ে খানিক হাত, পা, সেলিব্রেটির লিনেন, সব ধুয়ে আসে সে স্পেসের মধ্যে।
ধীরে ধীরে আমার ভাবনা গড়াতে থাকে। কবির ব্যক্তিগত স্পেস ছেড়ে নিজের ব্যক্তিগত স্পেস নিয়ে ভাবনা মাথায় আসতে শুরু করে। এই কারণেই আমি মেডিটেশন করে উঠতে পারিনা। সাদা নুড়িতে মনঃসংযোগ করতে গিয়ে দেওয়ালের গায়ে আটকে থাকা টিকটিকি, সেখান থেকে সেই কোন ছোটবেলায় বড় মাসির বাড়ির দেওয়ালে আটকানো  রবারের টিকটিকি মুখে আরশোলা ধরা,  ওদের বাড়ির দিশি মুরগীর মাংস দিয়ে চিড়িয়াখানার পিকনিক… এসবে মন চলে যায়। এখনও সেরকমই এগোচ্ছিল… হঠাৎ এই প্রশ্ন “দেখুন তো কেমন লিখলাম”
উনি জেগেছেন। নাকের বাদ্যি সেরে উঠে খাবার দাবার খেয়ে ন্যাপকিনটি রেখে ট্রে ফেরত দিয়েছেন। এবং তারপর কবিতা চর্চায় মন দিয়েছেন।
ন্যাপকিনে সুন্দর হস্তাক্ষরে লেখা কবিতাটি দেখে আমি সম্পূর্ণ নন রিঅ্যাকটিভ মোডে চলে গেলাম।
“কী হল? কেমন হয়েছে?” উনি নাছোড়
আমার মুখে তখন  নিশ্চই ওই টিকটিকির মুখের আরশোলার মত অসহায়তা মাখা। উনি বললেন – আপনি আর এক কবির লেখাই পড়ছেন দেখলাম। উনিও তো কবিই না? অবশ্য আমি ওনার লেখাটেখা অত পড়িনি। তা এটা বোধহয় গল্পের বই, নাকি?
“না, গল্পের না। মুক্তগদ্য”
“ওহ, সে আবার কী জিনিস? আমি আসলে বুঝলেন তো, সারাজীবন বিদেশে।  মাঝেসাঝে ওই বঙ্গ সংস্কৃতিটৃতিতে যাই, তাও বউয়ের শখে। তবে লিখি, বুঝলেন! কবিতাই লিখি অবশ্য শুধু। বেড়াতে গেলে টেলে মনে রাখি সব ঘটনা। বাড়ি ফিরে লিখে রাখি ডায়েরিতে। তবে কিনা, কাজের মাঝেমাঝে লেখা তো, খুব বেশি সময় দিতে পারছি না! আগে বন্ধুদের পড়াতাম। সন্ধ্যেবেলায় বাড়িতে একটু আড্ডা হই চই… আমার স্ত্রীও খুব অ্যাকটিভ এসবে। কিন্তু  একবার এক বন্ধুকে বাড়িতে বসে পড়ে শোনাতে গেলাম। সে ব্যাটা এমন বেরসিক…
ঠিক এই বেরসিক বলার সাথে সাথেই উনি একটা মোক্ষম হাঁচি দিলেন নাকে হাত চাপা না দিয়ে। আমাদের দুজনের টিভি স্ক্রীন ভরে গেল হাঁচিনিঃসৃত অখাদ্যে।
আমি তুরন্ত হাতের ওই ন্যাপকিনটা দিয়ে আমার স্ক্রীণটা মুছে ওঁর দিকে সেটা বাড়িয়ে ধরেই বুঝলাম কী মারাত্মক ভুল করলাম।
অত্যন্ত বিব্রতভাবে ক্ষমা চাইছিলাম আমি। “সরি সরি, খেয়াল ছিল না ওতে লেখাটা আছে…” ইত্যাদি। মনে মনে নিজেকে গালি দিচ্ছি। লম্বা ফ্লাইটে সহযাত্রীকে রাগানো মানেই সিটের হাতলের দখল হারানো এ তো জানাই কথা।
উনি কিন্তু একেবারেই বিরক্ত  হলেন না। কেবল একটু বেজার মুখে বললেন “এই হয় বুঝলেন? আমি বাড়িতেও কাগজের কিচেন টাওয়েল বা বিলের পেছনে লিখি আর বউ সে দিয়ে কাউন্টার মুছে ফেলে বা ট্র্যাশ করে দেয়।”
আরও বেশি লজ্জিত হলাম। বুঝলাম আমার মত ওঁর স্ত্রীও ওঁর প্রতিভার দাম দেন না।
তবে কয়েক মিনিটের মধ্যেই উনি কেবিন ক্রুকে ডেকে  বেশ কটি ন্যাপকিন চেয়ে নিলেন।  একটিতে দিব্যি আবার গুছিয়ে এই কবিতাটি লিখে আমার দিকে তাকিয়ে  বললেন “নাম কী?”
আমি – কার?
উনি  – আরে আপনার! আমার নাম তো আমি জানি! আপনার নামটা বলুন
অঃ … আমার নাম…
কিন্তু নাহ। অত ধৈর্য কার আছে! আমার নাম বলার আগেই উনি চট করে বোর্ডিং পাসটি টেনে নিয়েছেন বই থেকে যেটাকে আমি বুকমার্ক হিসেবে গুঁজে রেখেছিলাম।
নামটা দেখে ওঁর সেই কবিতার নিচে  লিখলেন “সহযাত্রী সঙ্গীতাকে”। তারপর সেই অমোঘ প্রশ্ন – গান গাইতে পারেন?
পারি বললে হয়ত উনিও ইন্সপায়ার্ড হয়ে গেয়ে উঠবেন। হাসিমুখে বললাম “নাহ, পারিনা।”
তাহলে? লেখেন টেখেন?
আমি ঘটঘট করে ঘাড় নাড়ি … লেখা? পাগল? ও কি আমার মত মানুষের পক্ষে সম্ভব?
অ, তাহলে আঁকেন টাকেন?  বাঙালী মেয়েরা তো কিছু কিছু করেই… আমার বউ তো সব অনুষ্ঠানে চারটে গান গাইবেই। তা ছাড়া  রান্না! অপূর্ব রান্নার হাতে বুঝলেন… মানে আমি তো ফ্লাইটের খাবার মুখেই তুলতে পারি না
আমি ওঁর স্ত্রী ভাগ্যে যথেষ্ট ঈর্ষান্বিত হতে হতে বুঝলাম এই কারণেই উনি ফ্লাইটের খাবার মুখে তুলেও হেঁচে কেশে বার করে দেন…
বাহ… খুব ভাল তো! আপনিও গান গান ফাংশনে?
আরে না না। আমি ওসব … হে হে… আমি এই লেখাটেখাই একটু…
তা আপনি হবি হিসেবে কী করেন?
কী জানি কী করি। ভাবতে গিয়ে মনের মধ্যে একটা ছবি ফুটে উঠল। বিরাট একটা বাড়ির ছাদে ভীষণ রোদ্দুরে বসে একটা মেয়ে… অল্প ঝুঁকে…
ভাবনার মধ্যে উনি ঢুকলেন আবার – না কি হবি টবি নেই তেমন?
আমি ততক্ষনে ওই ন্যাড়া ছাদে থেবড়ে বসে পড়েছি। ওঁর দিকে তাকিয়ে হেসে বললাম না না, হবি আছে… আমি অবসর সময়ে বড়ি দিই…
অ্যাঁ? বড়ি?
হ্যাঁ… বড়ি…
এটুকু বলেই আমি চোখ বন্ধ করেছিলাম। বলা বাহুল্য, কথাটি বলেই আমি  চেয়ারের হাতলের দখল হারাই এবং উনিও বার তিনেক বাথরুম যাওয়ার কারণে আমাকে চেয়ারচ্যুত করা ছাড়া বাকি সময়টা কড়ি মধ্যমের নাসিকাবাদ্যেই মনোরঞ্জন করেন।
তবে হ্যাঁ, সেই “সহযাত্রী সঙ্গীতাকে” লেখা ন্যাপকিনটা আমার বাড়িতে হয়ত এখনও আছে কোথাও, সযত্নে রাখা।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।