T3 শারদ সংখ্যা ২০২২ || তব অচিন্ত্য রূপ || বিশেষ সংখ্যায় রীতা চক্রবর্তী

বোধন

“জ্ঞানদা নন্দিনী বালিকা বিদ্যানিকেতন”এর আজ Foundation day. তাই আজ সকাল থেকে চলছে স্কুল ডেকোরেশন। ছাত্রীরা নিজের নিজের ক্লাসের টেবিল চেয়ার ফুলদিয়ে সাজিয়েছে। কাগজ কেটে রঙিন মালা বানিয়ে ক্লাসগুলো সুন্দর করে সাজিয়েছে। আর সেন্ট্রাল হলে একটা বেলুন ফুলিয়ে হেডমিস্ট্রেসের চেয়ারের ওপর ঝুলিয়ে রেখেছে। ম্যাডাম যখন তার চেয়ারে বসবেন তখন মাথার ওপর ঝোলানো বেলুনটা ফাটিয়ে ওনার জন্মদিন পালন করা হবে। হেডমিস্ট্রেস পত্রালি পুশকিন অবশ্য মনে করেন যে প্রতিটা দিনই মানুষের জন্মদিন। প্রতিদিনের পরিবর্তিত পরিস্থিতি মানুষকে নতুন অভিজ্ঞতা দিয়ে যায়। সেগুলো নিয়েই তো আগামীর পথে এগিয়ে যাওয়া। বিগত দিনের কাজের পুরষ্কার হিসেবে আমরা যে ফলাফল লাভ করে থাকি সেগুলোই আমাদের সামনে এগিয়ে যাবার পাথেয় হয়। তাইতো রোজই জন্মদিন, রোজই প্রাপ্তি, রোজই সঞ্চয় আর রোজই দান। তাইতো নিজেকে উজাড় করে দিতে হয় অন্ধকারে ডুবে থাকা মানুষেগুলোর মুক্তির জন্য। যেভাবে পৃথিবী তার সমস্ত সম্পদ উজাড় করে দিয়েছে এই জগতের কল্যাণের জন্য ঠিক সেইভাবে । পত্রালির মতো এরকম ভাবে ভাবতে পারেনা সবাই। কারণ পত্রালি নিজের জীবনের অর্জিত অভিজ্ঞতা সঙ্গে নিয়ে আজকের এই জায়গায় পৌঁছেছে।
পত্রালি যখন খুব ছোট ছিল তখন ভাগীরথীর ভাঙনে ওদের বাড়িঘর তলিয়ে যায়। বাবা মা ‘র হাত ধরে ওরা চলে আসে মামার বাড়িতে। প্রথমদিকে আত্মীয় পরিজন ওদের এই দুরবস্থার দিনে পাশে থাকলেও পরবর্তী সময়ে ওদের থাকতে দেয়া নিয়ে তিন মামার মধ্যে ঝগড়াঝাটি মারামারি শুরু হয়। এমনকি দিদিমাকে পর্যন্ত মার খেতে হয়েছে ওদেরকে মামা বাড়িতে থাকতে দেবার জন্য। এছাড়া ছোট্ট মেয়ে পতু মানে পত্রালিকে নিয়েও দুশ্চিন্তা শুরু হয়েছিল ওর মায়ের। এখানে আসার কিছুদিনের মধ্যেই পতু ছোটমামাকে দেখলে কেমন ভয়ে ভয়ে পালিয়ে যায় । ডাকলে সাড়া দেয়না, লুকিয়ে থাকে। কিন্তু ওর ছোটমামা ওকে তো খুব ভালোবাসে। কোলে নিয়ে আদর করে। ওকে সাথে নিয়ে গিয়ে বাজার করে আনে, জামা কিনে দেয়। পতু যা চায় সব কিছুই দেয় ওর ছোটমামা। তবে মেয়েটা যে কেন এরকম বদমাইশি করছে মা সেটা বুঝতে পারেনা। রেগে গিয়ে মেয়েকেই চড় থাপ্পড় মেরে দেয়। ছোট্ট মেয়ে কান্নাকাটি করে ঘুমিয়ে পরে। একদিন এরকমই দুপুর বেলা পতু দিদার বিছানায় ঘুমিয়ে ছিল। ছোটমামা এসে ওকে খুব আদর করে। গায়ে হাত বুলিয়ে দেয়। তারপর ওর হিসিটায় খুব চুমু খায়। পতু বুঝতে পারে এরপর মামা অন্য দিনের মতোই ওর হিসিতে নিজের হিসিটা ঘসে ঘসে হিসি করবে। কিন্তু এরমধ্যেই দিদা ঘরে এসে হাজির হলে মামা চুপচাপ চলে যায়। কিন্তু দিদা সেদিন মা’র সাথে খুব ঝগড়া করে। মেয়েকে একলা ঘরে না রেখে সাথে করে কাজের বাড়িতে নিয়ে গেলেইতো পারে। তাতে মায়েরই একটু কাজের সুবিধা হয়। ঘরের মধ্যে শুধু বিছানায় পরে থেকে থেকে একটা অশান্তি বাধিয়ে রেখেছে এই মেয়ে। তখন মা রেগে গিয়ে পতুকে আরো মেরেছিল। তারপর কাছে ডেকে চুপি চুপি জানতে চায় তার মেয়ে আজ কি অন্যায় করেছে? পতু ভয়ে পেয়ে পালাতে গেলে মা ওকে নিয়ে ঘরে ঢুকে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়। ভয়ে কাঁদতে কাঁদতে পতু সব কথা মাকে বলে দেয়। এই অশান্তির হাত থেকে রক্ষা পাবার জন্য ওর বাবা মা’ মামাবাড়ি ছেড়ে দিয়ে দুরের একটা রেলস্টেশনের ধারে ঝুপড়ি বানিয়ে থাকতে শুরু করে। মা এখানেও লোকের বাড়িতে ঠিকে ঝিয়ের কাজ করা শুরু করে আর বাবা স্টেশনে কুলির কাজ। বাবা সারাদিন কুলিগিরি করে যা পেত তাই দিয়ে কোনোরকমে ফ্যানাভাতের জোগাড়টুকু হতো। তবে মেয়েটা একা থাকত বলে বাবা মা’র মনে একটু দুশ্চিন্তাতো ছিলই। একা থাকার থেকে স্কুলের বাচ্চাদের সাথে থাকলে ভালো থাকবে ভেবে ওর বাবা ওকে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিল। পড়ায় ওর আগ্রহ দেখে বন্ধুরা ওকে বই খাতা দিয়ে সাহায্য করত। বন্ধুদের সহৃদয়তা আর সহানুভূতির জোরে পতু খুব তাড়াতাড়ি লেখাপড়ায় উন্নতি করতে শুরু করে। কিন্তু অল্প দিনের মধ্যেই ওর স্কুলে আসা কমতে থাকে। মাঝে মাঝেই কামাই হয় বলে স্কুলের বন্ধুরা ওর খোঁজ নিতে ওদের বাড়িতে চলে যায়। গিয়ে দেখে ও বাসন মাজতে বসেছে। বন্ধুরা ওকে স্কুলে নিয়ে যেতে চাইলে ও বলে যে এখনো রান্না হয়নি। ও যদি রান্না না করে তবে মায়েরও খাওয়া হবে না। মায়ের তো আতুর, তাই মা এখন রান্না করতে পারবে না।

অভাবের সংসারে মা ষষ্ঠীর কৃপাদৃষ্টি একটু বেশিই থাকে ।
আর পত্রালির পরিবারও এর বাইরে নয়। প্রতি বছরই মা’ হাসপাতালে ভর্তি হয় আর মেয়ের স্কুল যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। মেয়েটার এতো কামাই দেখে ওদের স্কুলের হেড মাস্টার পুশকিনস্যার একদিন ওর বাবাকে ডেকে পাঠান। স্যার বাবাকে বুঝিয়ে বলেন যে মেয়েটা পড়াশোনায় এত ভালো কিন্তু এত কামাই হলে ওর রেজাল্ট খারাপ হয়ে যাবে। বাবা তখন সাফ জানিয়ে দেন, মেয়েদের বেশি লেখা পড়ার দরকার নেই। বিয়ে করে তো সেই হাতাখুন্তি নিয়েই জীবন কাটাতে হবে। আর খরচটাও তো কম নয়। গরীবের সংসারে “নুন আনতে পান্তা ফুরায়”- কোথা থেকে জোটাবে পড়ার খরচ। এতগুলো পেটের খাবারের খরচ আছে।কোলের বাচ্চার সাবু বার্লি কাঁথাকাপড়ের খরচই জোটে না তার উপর বই খাতার খরচ জুটবে কোথা থেকে? গরিবের সংসারে লেখাপড়াটা একটা বিলাসিতা ছাড়া আর কিছু নয়। আর তাছাড়া ইস্কুলে যাবার জন্য সারাটা দিন নষ্ট হয়। ওই সময়ে দু’তিন বাড়ির কাজ ধরলে মাসে কিছু পয়সা হাতে আসে। উপরন্তু বাড়ির বাচ্চাগুলোর দেখভাল করারও একটা লোক ঘরে থাকে। তাই ও মেয়েকে আর পড়তে হবে না। বাবার কথা শুনে হেডস্যার চুপ করে থাকেন।

পুশকিন স্যার বাবার কাছে জানতে চেয়েছিলেন, মেয়ে যদি লোকের বাড়ি কাজ করে তবে মাসে কতটাকা আয় করতে পারবে ? বাবা বোধহয় ভেবেছিল স্যার তার মেয়েকে কাজের জন্য নিতে চায়। তাই দাম বাড়িয়ে বলেছিল, একবাড়িতে কাজ ধরলে কমকরে পঞ্চাশ টাকাতো মাসে আসে। স্যার তখন বাবাকে বলেন, আমি প্রতি মাসে আপনাকে পঞ্চাশ টাকা করে দেব। কিন্তু মেয়েকে রোজ স্কুলে পাঠাতে হবে। বেশ কয়েকমাস চলেছিল এভাবেই। পতু তখন ছোট হলেও বেশ বুঝতে পারত যে ওর বাবা স্যারের কাছ থেকে শুধু শুধু টাকা নিচ্ছে। এইভাবে লোককে ঠকিয়ে টাকা নেওয়ার জন্য ওর খুব খারাপ লাগত। তাই ও মাঝে মাঝে স্যারের বাড়িতে গিয়ে মামনির সাথে হাতে হাতে টুকটাক কাজ করে দিত আর তাতে ওর মনটাও ভালো হয়ে যেত। কিন্তু এভাবে বেশি দিন গেলনা। ওর বাবা একদিন স্কুলে গিয়ে স্যারকে বলল যে ওই টাকার বদলে মেয়েকে আর রোজ রোজ ইস্কুলে পাঠাতে পারবেনা। এবারে ওর বাবা স্যারের কাছে একেবারে একশো টাকা চেয়ে বসল। স্যার ও বাবাকে অবাক করে দিয়ে বলেছিলেন যদি আপনাকে আমি টাকাটা দিয়ে দিই তবে ওকে স্কুলে পড়াতে আপনার কোনো আপত্তি নেই তো? ওর বাবা এই উত্তরটা আশাই করেনি। বাবা চেয়েছিল স্টেশনমাস্টারের বাড়িতে পতু বাঁধা ঝিয়ের কাজ করবে। বদলে মাসে সত্তর টাকা মাইনে বাবার হাতে আসবে আর মেয়ের খাওয়া পরা সব ওরাই দেবে। তাই স্যারের কথা শুনে বাবা তখন কোনো উত্তর না দিয়ে চলে আসতে চাইছিল। তখন হঠাৎই হেডস্যার বাবার হাতদুটো ধরে বলেছিল, “আপনার তো সংসার আলো করে আছে পাঁচ পাঁচটা মেয়ে। আমার সংসারে একটাও মেয়ে নেই। আপনি যদি দয়া করেন তবে এই মেয়েটার দায়িত্ব আমি নিতে পারি। আপনি রাজি থাকলে আমি চিরদিন কৃতজ্ঞ থাকবো আপনার কাছে। অবশ্য সেজন্য আপনার সংসারে যদি আরো কিছু সাহায্য লাগে আমি দেব। “স্যারের কথায় বাবা তখনই রাজি হয়ে গিয়েছিল। একথোকে পঞ্চাশ হাজার টাকা নিয়ে পতুকে দিয়ে দিয়েছিল স্যারের সংসারের সদস্য করে আর কোনোদিন যেন মেয়েকে ফেরত না পাঠায় সেটাও লিখিয়ে নিতে ভোলেনি ওর বাবা। সেদিন ওর বাবা হাসি মুখে যখন আঙুলে থুথু লাগিয়ে টাকা গুনছিল তখন পতুর মনে হচ্ছিল দুর্গা ঠাকুরের পায়ের তলায় থাকা অসুরের মুখে এরকমই হাসি লেগে থাকে। অনেকদিন আগে মামাবাড়িতে থাকতে যখন প্রায়ই দুপুর বেলায় ছোটমামা ওর হিসিতে নিজে হিসি করে দিত তখনও এইরকমই হাসি লেগে থাকত মামার মুখে। সেকথা ও শুধু মা’কে বলেছিল। তখন মা বলেছিল চুপ করে থাকতে। কেউ জানতে পারলে ওদের আর থাকতে দেবে না, বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে। তাই সেকথা আর কাউকে কোনো দিন বলেনি।তবে যতই আপন হোকনা কেন মানুষ যে কখনো কখনো অসুর হয়ে যায় সেটা ছোটবেলাতেই জেনে গিয়েছিল পতু।
আর এই অসুরদের বধ করতে পারলেই আসবে বোধনের ভোর। এমনই এক বোধনের ভোরে মামনি গিয়ে ওকে নিয়ে এসেছিল স্যারের মেয়ে করে আর সেই দিনটাই ওর জন্মদিন।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।