সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে রঞ্জন চক্রবর্ত্তী (পর্ব – ৩)

উপন্যাসের বহুমাত্রিক রূপ

অনেকে উপন্যাসের উপাদানসমূহের মধ্যে চরিত্রের উপরে সবথেকে বেশী গুরুত্ব দেন। মানবজীবনকে খুঁটিয়ে দেখা ও মানুষের চরিত্রকে বিশ্লেষণ করা ঔপন্যাসিকের প্রধানতম কর্তব্য বলে বিবেচিত হয়। W. J. Harvey চরিত্রকে দেখেছেন সময়, ব্যক্তিত্ব, স্বাতন্ত্র্য, কার্যকারণ সম্বন্ধ, সামাজিক আচরণ, নৈতিকতা, আবেগ, চিন্তাভাবনা ইত্যাদির মিশ্রিত রূপ হিসেবে। চরিত্রের বিশ্লেষণের দ্বারাই মানুষের অর্ন্তলোকের ছবি পাঠকের সামনে ফুটে ওঠে এবং যে সব উপাদানের সাহায্যে উপন্যাসের সামগ্রিক রূপ প্রকাশিত হয় তাদের সবগুলির সঙ্গেই চরিত্রগুলির ঘনিষ্ঠ যোগ মুখ্য হয়ে দাঁড়ায়। সমাজের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে চরিত্রের অন্তর্জগতের বৈশিষ্ট্যও পরিবর্তিত হয়। সুতরাং উপন্যাসও কোন এক জায়গায় আবদ্ধ নয়, চিরপরির্বতনশীল এবং জীবনের নিরবিচ্ছিন্ন এক অনুসন্ধান। সেই অনুসন্ধানের প্রয়োজনে ঔপন্যাসিককে মানুষের জীবনের গভীরে ডুব দিতে হয়, চেতন ও অবচেতন মনের আনাচে-কানাচে উঁকি দিতে হয়। বিংশ শতাব্দীর লেখিকা Virginia Woolf বলেছেন – “Life is a semitransparent envelope surrounding us from the beginning of consciousness to the end. The thoughts, feelings and impressions are the stuff of life – the reality and the task of the novelist is to discover this reality.”
ঔপন্যাসিকের নিজস্ব চিন্তাধারা, অনুভূতি ও উপলব্ধি সৃষ্ট সাহিত্যকর্মের মাধ্যমে পাঠকের কাছে পৌঁছায়। শুধু কাহিনীর জাল বুনলেই বা চরিত্র সৃষ্টি করলেই ঔপন্যাসিকের দায় শেষ হয়ে যায় না, পাঠকের মনে কাহিনীকে সঞ্চারিত করা ও চরিত্রগুলিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলাও তাঁর দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।‘চোখের বালি’ উপন্যাসের ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথের বলেছেন – “. . . . সাহিত্যের নবপদ্ধতি হচ্ছে ঘটনা পরম্পরার বিবরণ দেওয়া নয়, বিশ্লেষণ করে তাদের আঁতের কথা বের করে দেখান।”এই কারণে ঔপন্যাসিককে নিজের দৃষ্টিকোণ (point of view) থেকে কাহিনী উপস্থাপন করতে হয় এবং পরির্বতনশীল সমাজক ও মানবচরিত্রকে রচনায় ধরার জন্য প্রয়োজনে দৃষ্টিকোণ পাল্টাতেও হয়। কোন দৃষ্টিকোণ থেকে লেখক ঘটনাকে দেখছেন সেই বিচারে প্রতিটি উপন্যাসই আলাদা আলাদা চিন্তা-ভাবনার পরিচয় বহন করে।
উপন্যাসের বিষয়গত দিকের সঙ্গে কালগত দিক ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত।Samuel Richardson সময়কে দেখেছেন উপন্যাসের চরিত্রচিত্রণের সহায়ক হিসেবে। কিন্তু Henry Fielding পাঠকের কাছে ঘটনাকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার উদ্দেশ্যে সময়কে ব্যবহার করেছেন। বারবুল্ড অবশ্য সময়কে দেখেছেন লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিকোণ ও কাহিনী বর্ণনার পদ্ধতি মাথায় রেখে। সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সমাজ পরিবর্তিত হয় এবং মূল্যবোধও সমাজের নিরিখেই নির্ধারিত হয়। লেখক সৃষ্ট চরিত্রের মাধ্যমে সময়ের সংকট মানুষের জীবন ও চেতনায় যে ছাপ ফেলে তাকে শিল্পসম্মত ভাষারূপ দেন, তাঁর নিজস্ব মূল্যবোধের মাণদণ্ডে তিনি সময়ের দন্দ্ব তথা ব্যক্তিমানুষের জীবনের দ্বন্দ্বে বিশ্লেষণ করেন।মূল্যবোধ নির্ভর করে লেখকের জীবনদর্শনের ওপর। বস্তুত মূল্যবোধের দৃষ্টি দিয়েই তিনি সমকাল ও সমাজকে দেখেন, যে দৃষ্টিকে আমরা তাঁর second self বা দ্বিতীয় সত্ত্বা বলতে পারি। এই দ্বিতীয় সত্ত্বাই সহজাত বোধের মাধ্যমে চরিত্রের আবেগ-অনুভূতির সঙ্গে জড়িয়ে থাকে।
চরিত্রের উপরে পরিবেশের (enviornment) প্রভাব পড়ে এবং ব্যক্তির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলিও পরিবেশ দ্বারা বহুলাংশে প্রভাবিত হয়। পরিবেশই আসলে উপন্যাসের পশ্চাৎপট বা background। উপন্যাসের মূলে আছে যে ব্যক্তিচরিত্র তা ভৌগোলিক তথা সামাজিক পরিবেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। এখানেই সার্থক উপন্যাস রচনায় পশ্চাৎপটের গুরুত্ব।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।