নভেলা গল্প হলেও সত্যি-তে রাজদীপ ভট্টাচার্য – ধারাবাহিক (রু)

নবম পর্ব

মিনতি চট্টরাজ আগের থেকে অনেকটাই সুস্থ এখন। সকালে বারান্দায় বেরুতেই পলাশের সাথে মুখোমুখি দেখা হল। ওয়াকারে ভর দিয়ে ধীরে ধীরে হাঁটছেন বাড়ির সামনে। পলাশ গলা তুলে বলল — এইতো মাসীমাকে এখন আগের থেকে অনেক ভালো দেখাচ্ছে। যা খেল দেখিয়েছিলেন আমরা তো ভয়েই আধখানা হয়ে গেছিলাম।

মৃদু হাসেন ভদ্রমহিলা। অস্পষ্ট গলায় বলেন — তোমরা সবাই মিলে যমের হাত থেকে ফিরিয়ে আনলে বাবা।

— আমরা আর কী করলাম মাসীমা! সমীর বাবু একাই লড়ে গেলেন। আমাদের তেমন সুযোগ দিলেন না। নাওয়া খাওয়া ভুলে আমসির মতো মুখ করে ক’দিন যেভাবে কাটাচ্ছিলেন তাকে দেখেও আমার আশঙ্কা হচ্ছিল। যাইহোক সব ভালো যার শেষ ভালো।

স্বামীগর্বে অপার্থিব হাসি ফোটে ভদ্রমহিলার মুখে। কথাবার্তা শুনে সুমি নেমে আসে বাইরে। মেয়েটা সেই দিনের পর থেকে আর পলাশের ঘরে ঢোকে না। খুব প্রয়োজন হলেও বাইরে দাঁড়িয়ে কথা বলে। সেটা একদিক থেকে ভালোই হয়েছে। নাহলে এতদিনে পলাশকে এই বাড়ি ছেড়ে অন্য কোথাও পালাতে হতো।

এইরকম অল্প বয়সে মনের মধ্যে নানান ফ্যান্টাসি বাসা বাঁধে। তাই সুমির সেদিনের আচরণ খুবই স্বাভাবিক। মা আকস্মিক ভাবে অসুস্থ হয়ে পড়া। তার অনিশ্চিত জীবন। ঘরে তীব্র শূন্যতা। মাথা রেখে কাঁদার মতো একটা মানুষের অভাব। সেখান থেকে অসহায় করুণ সমর্পণ। পলাশের অবাক লাগে ভেবে যে যৌনতা কত বলবান! অমন পরিবেশেও কীভাবে মানুষকে শতপদী বিছের মতো আঁকড়ে ধরে। সেদিন পলাশ ওই মানসিক জোরটুকু দেখাতে না পারলে জল অনেক দূর অবধি গড়িয়ে যেত। তার জের টানতে গিয়ে কে কোথায় পোঁছত তার হদিশ থাকতো না।

সুমির মনে একটা আঘাত নিশ্চয়ই লেগেছে। তবে সেটা স্বাস্থ্যকর ধাক্কা। যত বড় হবে ও বুঝবে সেদিনের প্রত্যাখ্যানও আসলে একরকম ভালোবাসা। মানুষের মনের কোমল পাপড়িগুলোকে ফুলের গায়ে অটুট রেখে দেওয়ার জন্য এও একপ্রকার শুশ্রূষা। আর সেটা করে উঠতে পারার জন্য আজ ভিতরে গর্ব হয় পলাশের। হাল্কা শীতের সকালে আধো কুয়াশার মধ্যে খোলা বারান্দায় দাঁড়িয়ে ও দেখে দূরে রাস্তায় আবছা ছবির মতো ধীরে ধীরে হেঁটে যাচ্ছে মা আর মেয়ে। সকালবেলার নিষ্পাপ খুশি ছড়িয়ে পড়ে ওর সারা শরীরে।

★★★

স্ক্রিনে রেমির নামটা ভেসে উঠতেই মনটা ভালো হয়ে গেল পলাশের। সেই পুজোর পরে পরে একবার কথা হয়েছিল। তারপর অনেক দিন কেটে গেছে ও আর ফোন করেনি। রেমি বা ইন্দ্রাণীও যোগাযোগ করেনি। পলাশ কলটা রিসিভ করে বলল — কেমন আছো ব্রাদার?

ম্রিয়মাণ গলায় রেমি বলে — ভালো না পলাশ। লাস্ট এক মাস খুব টেনশন ছিলো বাবাকে নিয়ে।

— ওহো! তাই নাকি! আমি তো কিছুই জানতাম না। একবার বললে পাশে দাঁড়াতে পারতাম তোমার। যাইহোক এখন কেমন আছেন?

একটু ধরা গলায় রেমি বলে — লাস্ট ট্যুইসডে বাবা এক্সপায়ার করে গেছেন। সেইজন্যই তোমাকে ফোন করছি।

মনে মনে নিজের প্রতি নিজেরই রাগ হয় পলাশের। বেশ কিছুদিন একবারও যোগাযোগ করা হয়নি। রেমি বা ইন্দ্রাণী কাউকেই ফোন করেনি। নীরবতা ভেঙে ও বলে — অত্যন্ত দুঃখজনক। খুব খারাপ লাগলো শুনে। আমি যত দ্রুত পারি যাবো মহুলিতে।

— সামনের রবিবার বিকেলে বাড়িতেই একটা স্মরণসভা হবে। খুব সামান্য কিছু লোকজন। বাবার দু’একজন কলিগ। কিছু প্রতিবেশি। আর কয়েকজন বন্ধু।

— ওকে, আমি অবশ্যই যাবো। ইন্দ্রাণীকে বোলো।

— তুমি শনিবার অফিস করে চলে এসো। আগে থেকে এলে ওইদিন সুবিধা হবে।

— বেশ। তাই যাবো। সাবধানে থেকো তোমরা।

ফোনটা রেখে একটু শান্ত হয়ে বসে পলাশ। আগামী শনিবার কোলকাতায় যাওয়ার কথা ছিল। রুনার সঙ্গে বিয়ের ডেটটা ফাইনাল করে ফেলার জন্য মা বারবার যেতে বলছে। মার্চ মাসে হবে এটা ঠিক হয়েছে কিন্তু দিন স্থির না হলে বিয়েবাড়ি বা অন্যান্য এরেঞ্জমেন্ট ঠিক করা যাচ্ছে না। বাড়িতে ফোন করে আবার দিনটা পিছোতে হবে। সামনের বুধবার অফিস ছুটি আছে। তখন কোলকাতা যাবে নাহয়।

রুনাকেও জানাতে হবে বিষয়টা। কথা ছিল শনিবার গিয়ে ওর সঙ্গে বাইরে কিছুটা সময় কাটাবে। ফোনে আর কত কথা হয়! পরস্পরকে কাছ থেকে দেখাও খুব জরুরী। বছরের পর বছর প্রেম করেও দুজনকে দুজনের ঠিকঠাক চেনা হয়ে ওঠে না। বিয়ের পরে মনে হয় অন্য মানুষ। আর এক্ষেত্রে প্রেমের প্রশ্ন নেই কিন্তু পারস্পরিক আদানপ্রদান তো দরকার। তাছাড়া বিয়ে হবার আগে ঠিক এই সময়টাও ভীষণ উপভোগ্য। যেন পুজো আসছে। আর সেই আসছে আসছে ভাবনাটাই বেশি আনন্দের। এসে গেলে তখন আর থ্রিল উপভোগের সুযোগ থাকে না।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *