সবেমাত্র মোবাইল ফোনখানা চারজারের সাথে জুড়েছে মধুরিমা ওমনি ঝুপ করে অন্ধকার নেমে আসল ওর চোখের সামনে ! লোডশেডিং। ঘড়ি ধরে ঠিক সাড়ে ছ’টার সময়। মধুরিমা শুনেছে এ পাড়ায় ঘন-ঘন লোডশেডিং হচ্ছে গত কয়েকদিন ধরে, আজ তার চাক্ষুস প্রমাণ পেলো।
নতুন ফ্ল্যাটে আসার আজ চতুর্থ দিন সবে, এখনও অনেক গোছগাছ বাকি, সারাদিন ঘরের কাজ করেও কূল পায়না মধুরিমা ! স্বামী প্রদীপ্ত সেই সকালে বেরিয়ে যায়, ফেরে সেই রাত দশটায় ! এই সময়টুকু মধুরিমাকে একাই ফ্ল্যাট বন্দি হয়ে কাঁটাতে হয় ! দিনভর কাজ করার পর সন্ধ্যেটায় একটু আয়েশ করে কাটাবে ভেবেছিল তখনই এই বিপত্তি !
অন্ধকারের মধ্যে হাতড়াতে থাকে মধুরিমা, কি কুক্ষণেই যে মোবাইলে আজ অতক্ষন গেম খেলছিল, এখন টর্চ জ্বালাবার মতো ন্যূনতম চার্জ নেই ওটাতে ! এখন অন্ধকারের মধ্যে হাতড়ে-হাতড়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেশলাই না জ্বালানো অবধি এই অন্ধকারের কালো কুয়াশাতেই ডুবে থাকতে হবে ! একা মধুরিমার গাটা ছমছম করে উঠল !
ফ্ল্যাটখানা মধুরিমার ইচ্ছেতেই কেনা। এতদিন ভাড়ার ফ্ল্যাটে থাকার পর নিজেদের একখানা ফ্ল্যাটের বাসনা হয়েছিল তার মনে, প্রদীপ্তও শুনে আপত্তি করেনি, অনেক খোঁজখবর করার পর এই ফ্ল্যাটটা বেশ সস্তায় পেয়ে গেছিল তারা। জায়গাটাও ভালো, নির্মীয়মাণ জোকা মেট্রো বাড়ি থেকে প্রায় পনের মিনিটের হাঁটা পথে, পাশাপাশি অন্যান্য সুবিধাগুলোও আছে। তবে ফ্ল্যাটগুলো এখনও বড্ড খালি, আঠেরোখানা ফ্ল্যাটে মাত্র ছ’জন বোর্ডার এসেছে সবে, মধুরিমাদের ফ্লোরে তারা বাদে আর কেউ নেই এই মুহূর্তে।
কানার মতো টলতে-টলতে, দু’বার হোঁচট খেয়ে অবশেষে মধুরিমা রান্নাঘরে গিয়ে পৌঁছাল। প্রায় পাঁচ মিনিট অন্ধকারের সাথে লড়াই করার পর যখন দেশলাইয়ের বাক্সটা হাতে এসে ঠেকল তখন যেন ধরে প্রাণ এলো ! উফ, এতক্ষন ঘরভর্তি অন্ধকার যেন তাকে গিলে খাচ্ছিল !
দেশলাইটা জ্বেলে সামনে তাকাতেই সে আঁতকে উঠল !
“সরি বৌদি, আমি আপনাকে না জানিয়েই আপনাদের ফ্ল্যাটে ঢুকে পড়েছি !”
মধুরিমা এবার কিছুটা ধাতস্ত হল, ভয়ে তার গলা শুকিয়ে গেছিল ! হাতের দেশলাই কাঠিটা নিভে গেছিল, আবার একখানা জ্বালিয়ে সে দেখতে পেলো, ঘরের আগুন্তুক একটি মেয়ে, বয়সে তার থেকে ছোটই হবে, অন্ধকারে তার মুখখানা ভালো বোঝা যাচ্ছিল না, তবে এটুকু বুঝতে পারছে, মুধুরিমা হঠাৎ ভয় পাওয়ায় সে বেশ অনুতপ্ত !
মেয়েটা বলল, “আমি কমলিনী, ওপরে পাঁচশ দুই নম্বর ফ্ল্যাটে থাকি । আমরাও নতুন এসছি। ঘরে একাই ছিলাম, হঠাৎই কারেন্ট অফ হয়ে অন্ধকার হয়ে গেলো, আর আমিও নার্ভাস হয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে নীচে নেমে আসাতে দেখলাম, আপনার ফ্ল্যাটের দরজা খোলা ! ভাবলাম, আপনার সাথে থাকলে ভয়টা কাঁটবে! কিছু মনে করবেন না, এভাবে না বলে ঢোকাটা উচিত হয়নি !”
মধুরিমার তখন ভয় কেঁটে গেছে, সে উত্তরে বলল, “না না, অন্ধকারে আমিও তালগোল পাচ্ছিলাম না, তুমি আসাতে ভালোই হয়েছে ! এসো, বসবে এসো !” বলে সে একটা মোমবাতি ধরায়।
তারপর কমলিনীর সাথে টানা অনেকক্ষণ কথা বলল মধুরিমা। নিজের ব্যপারে বলল, কমলিনীর ব্যপারেও জানল- স্বামী কি করে, আগে কোথায় থাকত, এখানে এসে কেমন লাগছে- এইসব। কথা বলতে-বলতে মধুরিমা বুঝতে পারছিল, এতদিন যেই সঙ্গীর অভাব সে বোধ করছিল, আজ সন্ধ্যের লোডশেডিং সে অভাব পূর্ণ করেছে !
কথা বলতে-বলতে সময় পেরিয়ে জাচ্ছিল,কারেন্ট আসার নামই নেই ! তবে কমলিনীর সঙ্গে বসে গল্প করতে খারাপ লাগছিল না, মাঝে একবার কমলিনী জল খেতে চাওয়া উঠতে হয়েছিল, এবং অদ্ভুত ব্যপার, মধুরিমা রান্নাঘরে যাওয়ার সাথে-সাথেই কারেন্ট চলে আসে !
কিন্তু জলের গ্লাস নিয়ে ওঘরে যাওয়ার পর কমলিনীকে কোথাও দেখতে পেলো না ! মধুরিমা ভাবল- কারেন্ট আসার সাথে-সাথেই নিজের ফ্ল্যাটে পালিয়েছে, ছেলেমানুষ একটা !
[২]
নতুন ফ্ল্যাটে আসার পর দশদিন পেরিয়ে গেছে, মধুরিমা এখন যথেষ্ট সড়গড়, ফ্ল্যাটের গোছগাছও মোটামুটি শেষের পর্যায় ! এখনও সন্ধ্যেবেলায় মাঝে-মধ্যেই কারেন্ট অফ থাকছে কয়েক ঘণ্টার জন্য, কিন্তু সে সময়টা খারাপ কাঁটে না মধুরিমার, তাকে সঙ্গ দিতে সব সময় হাজির থাকে কমলিনী।
কিন্তু কয়েকটা জিনিষ সে লক্ষ্য করেছে, শুধুমাত্র লোডশেডিং হলেই কমলিনীকে তার ফ্ল্যাটে আসতে দেখা যায়, সারাদিন তার চিহ্ন পাওয়া যায় না ! আরও আশ্চর্যের ব্যপার, প্রতিবারই কারেন্ট আসার কয়েক সেকেন্ড আগে কমলিনী মধুরিমাকে ছুতোয়-নাতায় ভেতরে পাঠায়, কখনও জল আনতে, কখনও পাওয়ার ব্যাংক আনতে, কিন্তু মধুরিমা ভেতরে যাওয়ার সাথে-সাথেই কারেন্ট চলে আসে, আর সেও ফিরে এসে কমলিনীকে দেখতে পায় না, ব্যপারটা সাংঘাতিক রহস্যময় মনে হয় !
আবার মধুরিমা যে এতো করে কমলিনীর ফ্ল্যাটে একদিন যাওয়ার কথা বলছে, সেটাও সে কথায়-কথায় এড়িয়ে যায় প্রতিবারই, যেন মধুরিমাকে নিজের ফ্ল্যাটে নিয়ে যেতে চায়না! “এখনও সব অগোছালো হয়ে আছে বৌদি, আপনাকে যে কোথায় বসাব সেখানে নিয়ে গিয়ে, ফার্নিচারই তো কেনা হয়নি ! ও অফিস করে সময় পাচ্ছে না, আমিও এখনও এখানকার কিছুই চিনে উঠতে পারিনি !” কমলিনী বলে বটে, কিন্তু ওর কথা মধুরিমার বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়না !
ব্যপারটা স্বামী প্রদীপ্তকে জানাতেই সে বলে উঠল, “কমলিনী চক্রবর্তী নাম বলল, হাসব্যান্ডের নাম জিজ্ঞেস করোনি ?”
মধুরিমা বলল, “ওনার নাম অংশুমান চক্রবর্তী, আমাদের ওপরের ফ্ল্যাটেই থাকেন !”
প্রদীপ্ত খানিকটা ভেবে বলল, “অংশুমান চক্রবর্তী- নাহ, সে নামে তো কোন বোর্ডারের নাম মনে আসছে না ! আমাদের আট’তলার ফ্ল্যাটে মাত্র ছ’জন বাসিন্দা এখন, ওপরের তিনটে ফাঁকা, ফিফথ ফ্লোরে আছেন মিঃ দাসগুপ্ত আর মিঃ বাটরা, ফোরথে শুধু আমরা, থার্ড, সেকেন্ড খালি- ফার্স্ট ফ্লোরে শুধু ডঃ মজুমদার, আর গ্রাউন্ডে দত্তবাবু আর মিঃ নটরাজনদের ফ্যামিলি, আমার সব মুখস্থ ! এর মধ্যে কোথায় তোমার অংশুমান চক্রবর্তী ?”
প্রদীপ্তর কথা শুনে মধুরিমার বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল, তাহলে কমলিনী আসলে কে? আর সে এই ফ্ল্যাটের বোর্ডার না হলে প্রতি সন্ধ্যেয় কোথা থেকে আসে তাকে সঙ্গ দিতে ?
মধুরিমা ঘোরের মধ্যে শুনতে পায়, প্রদীপ্ত বলে, “চেনো-না জানো-না এসব উটকো লোককে বাড়িতে ঢুকিও না, নতুন যায়গা, একা থাকো সারাদিন- “
ঠিকই তো, মধুরিমা সারাদিন একা থাকে, তার কথা বলার সঙ্গী চাই !
তাই সে রোজ সন্ধ্যেবেলা অপেক্ষা করে, কখন কারেন্টটা অফ হবে !