গল্পবৈঠক ৩৪ এর গল্পে পার্থ সারথি গোস্বামী

টার্গেট

অফিস থেকে ফেরার পথে বাস থেকে নেমে  মোবাইলে ইন্ডিয়া-ইংল্যান্ড ম্যাচের স্কোর দেখে মেজাজটা বিগড়ে গেল । ভারতের ঘাড়ে বিরাট রানের বোঝা । তাতেকি ! আমাদের টিমও এরিগেরি না । আজ একটা জবরদস্ত ম্যাচ দেখা যাবে  ।  সেই ভেবে দ্রুত পা চালালাম বাড়ির পথে ।
   বাড়ি পৌঁছে কাঁধ থেকে ল্যাপটপের ব্যাগটা যেই নামিয়েছি , বৌ বলল,
– জানো, আজ মনটা আমার খুব ভালো ।
– দারুন ব্যাপার তো ! তা ,খুশির কারণটা বলবে না ।
– ময়না গো ময়না । ময়নার শাশুড়ি ময়নাকে মেনে নিয়েছে । আজ ময়না বাড়ি ফিরছে ।
কে ময়না ! ভাবলাম গৃহিণীর বাপের বাড়ির কোন আত্মীয় বা কোন প্রতিবেশী হবে । এই পাড়ায় আমরা নতুন এসেছি ।  সারাদিন অফিস পিটিয়ে প্রতিবেশীর খোঁজ খবর রাখা আমার পক্ষে সম্ভব নয় ।  খবরটা ভালো । তাই গৃহিনীকে উৎসাহ দেবার জন্যই বললাম,
–   আজকাল শাশুড়িদেরও তাহলে সুমতি হচ্ছে , কিবলো !
– হবেনা । সবাই কি তোমার মায়ের মতো । কথায় কথায় খোঁটা দেবে ।
– এই দেখো, আবার মাকে টানো কেন । কে ময়না, কোথাকার ময়নার শাশুড়ি , তারসঙ্গে মায়ের কি সম্পর্ক
– কে ময়না মানে, দুনিয়ার খবর রাখো আর ময়না কে মনে নেই !
–  নামটা চেনা চেনা লাগছে । হ্যাঁ মনে পড়েছে । তোমার মায়ের ছোট না মেজ কাকার মেয়ে ।
– মরন দশা , কিছু হোল তো আমার বাপের বাড়িকে টানা । মা ছেলে দুটোই সমান ।
– অপরাধ হয়েগেছে হে দেবী । এবার দয়াকরে বলবে ময়নাটা কে ।
– ন্যাকা চন্ডী , ময়না কে জানেননা , কৃষ্ণকথা সিরিয়ালের নায়িকা । গান শুনলে বুকটা জুড়িয়ে যায় । শুরুহোল বলে, শেষ না হওয়া পর্যন্ত আজ একটুও নড়ছি না আমি । এখুনি চায়ের জন্য বায়না জুড়ে দিওনা , সিরিয়াল শেষ হলে তবে চা ।
আমি বুক খামচে বসে পড়লাম । সিরিয়ালের চরিত্র বাস্তব জীবনে ঢুকে যেভাবে গৃহশান্তির দফারফা করেদিচ্ছে , সেটা ভাবতেই বুকটা ধড়পড় করে উঠলো ।বুঝলাম খেলা দেখা আজ কপালে নেই । তবুও বুকে সাহস এনে বললাম ,
– আজ সিরিয়াল না দেখলেই নয়, এতবড় একটা ম্যাচ , একটু দেখবো না ।
– তা দেখবে বৈকি , আমি একটু টিভি দেখলে ওনার বুক পুড়ে যায় ।  দুদিন বাদে ছেলের পরীক্ষা , পড়াবে কে শুনি ?
– সে নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না ।
– না না, আমার ছেলে আমি ভাববো না , যত ভাববেন উনি আর ওনার মা ।
– আরে না রে বাবা , সেটা বলিনি ।  ছেলেকে আমিই পড়াবো । কিন্তু, কথায় কথায় মাকে কেন টানো, সে নিজে গ্রামের বাড়িতে নিজের মতো আছে, তোমাকে তো তার সেবাও করতে হয়না ।
এবার  আমাকে সম্পুর্ন অবাক করে ,  ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে দিল বৌ ।  কি করবো কিছুই খুঁজে পেলাম না । খুব আস্তে আস্তে তার মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম,
– আহা , কি হোল আবার । কাঁদছো কেন ?
– হতে আর বাকি রইলোটা কি, এতদিন যে কথাটা বলোনি সেটাওতো বলেদিলে । আমি শ্বশুর শাশুড়ির সেবা করিনা । গ্রামের ঘরে তাদের ফেলে রেখে এখানে সুখ করছি । ছেলেকে আলাদা করে দিয়েছি তাদের থেকে ।
– এ সব আবার কখন বললাম !
– বলোনি , তবে বলতে সেটাই চাও সব সময় । বোকা বলে কি আমার বুদ্ধিনেই । যাও কিছুই দেখবো না আমি , দেখো তোমার খেলা । বলেই সঙ্গে সঙ্গে চ্যানেল চেন্জ আর বিরাট কোহলি আউট । মাথার ওপর বাজ পড়লো । এতটা রান কে করবে এবার ! একদিকে ক্যাপ্টেন আউট তারওপর গৃহের ক্যাপ্টেনের এমন ঝোড়ো ব্যাটিং । সাতে পাঁচে খেলা দেখার ইচ্ছেটাই মরে গেল  । কোন কথা না বলে, চ্যানেল চেন্জ করে আমি চুপচাপ পাশের ঘরে ছেলের পাশে গিয়ে বসে পড়লাম ।
ছেলে দুলে দুলে পড়া করছে । আমাকে দেখে বললো ,
– দুজনে বিশ্বকাপ তো জমিয়ে দিয়েছো । কিন্তু ডিফেন্স করে পার পাবেনা , মায়ের ইয়র্কার বুমরার চেয়েও টাফ।
– তোকে আর পাকামী করতে হবে না । পড় মন দিয়ে ।
ছেলের পাশে বসেও মন সেই খেলায় ।মনটা উসখুস করছে , কি জানি আবার উইকেট পড়লো নাকি । একবার ভাবছি যাই  টিভির সামনে , কিন্তু রিসেন্ট খেলে আসা বাউন্সার গুলোর কথা মনে পড়তেই ইচ্ছেটা চাপা দিয়ে ফেললাম । হটাৎ করেই উড়ন্ত চিলের মতো বউয়ের প্রবেশ ,
– ভীষন খুশি গো আমি ভীষণ খুশি, ডাক্তার বলেছে পমপমের সব রিপোর্ট নর্মাল । মা হতে পারবে পমপম ।
খেলা দেখতে না পাওয়ার জ্বালাটা ছিলোই, তারওপর আবার সিরিয়ালের এক কিম্ভুত চরিত্রের নাম শুনে মাথা গরম হয়ে গেল , পুরো নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বলে ফেললাম,
– আরে রাখতো তোমার খুশি । দুনিয়ার ফালতু  সিরিয়ালের এর ওর খুশিতে খুশি তোমার।খালি অবাস্তব সব চিন্তাভাবনা ।
– কি বললে তুমি , সিরিয়াল ! পমপম সিরিয়ালের চরিত্র , নিজের একমাত্র শালীর নামটা পর্যন্ত মনে নেই । বলি মনে মনে কার ধ্যান করছো । দুদিন বাদে আমি যে তোমার বৌ সেটাওতো ভুলে যাবে দেখছি । অফিসে কারোকে আবার মনে ধরলো নাকি ?
– সে যাই হোক, ছেলের সামনে একদম ফালতু কথা বলবেনা ।
– ও , শালীর অসুখ ফালতু কথা ।  বুঝেছি, মনে রং ধরেছে । আমি বেশিদিন আর এ বাড়িতে নেই ।
আর থাকতে পারলাম না , উঠে দাঁড়িয়ে দু হাত জোড় করে বললাম ,
– চলো , ও ঘরে চলো, আমাদের বয়স বাড়ছে , ছেলের সামনে ঝগড়া করা কি মানায় আমাদের ।
কথাটা শুনেই বৌ একেবারে চুপ হয়ে গেল । সুবোধ বালকের মতো আমার হাত ধরে এলো পাশের ঘরে ।  টিভির চ্যানেল চেন্জ করে বললো ,
– ঠিকই বলেছো গো, আমাদের আর এ সব মানায়না , তুমি খেলা দেখো , আমি চা নিয়ে আসছি ।
দুর্যোগ কেটে একটু নীল আকাশ দেখতে পেলাম যেন । এদিকে তখন ইন্ডিয়াকে জিততে গেলে ৪৫ বলে ৯০ রান দরকার ।  টাফ টার্গেট , একটাই আশা ক্রিজে দুজনই বিগ হিটার । একটু গুছিয়ে বসতেই ছেলে এসে বললো,
– বাবা তোমাকে ম্যাপ-পয়েন্টিংয়ের জন্য ম্যাপ আনতে বলেছিলাম এনেছো ? কাল ক্লাস টেস্ট ।
সত্যি তো, ভেবেছিলাম ফেরার পথে কিনে নেবো । ম্যাচের স্কোর দেখে সব ভুলেগেছি । বললাম,
– এই রে , এক্কেবারে ভুলে গেছি । কি হবে এবার !
দেখলাম চায়ের কাপ হাতে বৌ দরজায় দাঁড়িয়ে, চায়ের কাপটা ঠক করে টেবিলে নামিয়ে বললো,
– আজকাল সংসারের কোন কাজটা মনে থাকে তোমার ?
আমি কারোকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে , ফুলটস বলে ছক্কার মতো স্পিডে, লাফ মেরে ঘরের বাইরে এলাম । ঘড়িতে দেখলাম ৯ টা বাজতে পাঁচ , বাড়িথেকে বইখাতার দোকানের দূরত্ব প্রায় এক কিলোমিটার । দোকান ৯ টায় বন্ধকরে । একটা ছুট লাগালে হয়তো দোকান বন্ধের আগে ঠিক পৌঁছাতে পারবো । লাগালাম ছুট । পিচের রাস্তায় ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে দৌড়াতে ভাবলাম , বিশ্বকাপের ক্রিকেট পিচের বর্তমান টার্গেট , আমার টার্গেটের তুলনায় নেহাত নস্যি ।
( সংকল্প পত্রিকায় অধিক শব্দে ” বিশ্বকাপ ” নামে প্রকাশিত )
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।