সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে প্রদীপ গুপ্ত

বাউল রাজা

দ্বিতীয় খন্ড (ষট্পঞ্চাশৎ পর্ব)

দাঁতন করতে করতে পথের ধারে ফুটে থাকা কিছু দ্রোণফুল আর করবীফুল তুলে এনে দাওয়ার ওপর আলগোছে রাখলাম। দেখি সবাই আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। দাওয়ার নীচে রাখা বালতির জল ঘটিতে তুলে মুখ কুলি করে, মুখ ধুয়ে দড়িতে ঝোলানো গামছায় মুখ মুছে ঘরে এসে ঢুকলাম। কিটব্যাগ খুলে একটা ছোট বাউলবেশী রবিঠাকুরের বাঁধানো ছবি বের করে বারান্দায় এসে ছুটকিকে একটা মোড়া দিতে বললাম। ছুটকি ঘরে ঢুকে একটা নীল কভার দেওয়া মোড়া এনে বারান্দায় রাখলো। এতো দ্রুত ও নিঃশব্দে কাজগুলো করে যাচ্ছিলাম যে সবাই শুধু দেখেই যাচ্ছিলো, একটা কথাও কেউ মুখ দিয়ে বের করার সময় পেলো না। মোড়াটাকে দেওয়ালের গায়ে রেখে রবিঠাকুরের ছবিটা তার ওপর রেখে কানাইদার কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। দেখি, কানাইদার মুখ জুড়ে একটা অদ্ভুত দুষ্টুমিভরা হাসি। একতারাটাকে ধরে তিনি একটা সুর বাজিয়ে চলেছেন। সুরটা আমার ভীষণ চেনা, কিন্তু পদটা ধরা দিচ্ছে না কিছুতেই।
–” কানাইদা, একটু উঠতে হবে গো।”
–” এই দেকো দিকিনি, সবে সুরটা ধরিচি আর তুমি একুনি… “
–” একটুখানি প্লিজ। “
বলে কানাইদার হাত স্পর্শ করতেই কানাইদা একতারাটাকে রেখে উঠে দাঁড়ালেন। দাঁড়িয়ে আমার দিকে করপুট বাড়িয়ে দিলেন।
মানুষটাকে যতোই দেখি কেবলই অবাক হই। ফুলগুলো নিয়ে ওর করপুটতলে রাখতেই কানাইদা তার থেকে অল্প দুটো ফুল নিয়ে বাকিটা আমায় ফেরত দিলেন।
–” ও ধুবদাদা, এসো গো। মা কিষ্ণা, ইদিকে আয় দেকি, অ ছুটকি তুইও বা বাকি থাকবি কেনে রে, তুই ও আয়, পদীপদাদাকে কি আমি এমনি এমনি বলি যে তিনি আলোর আদার! এই একটা জিনিসেরই খুব অভাব চিলো আমার ঠাঁয়ে। হ্যাঁগো পদীপদা, ছপিটাকে এট্টুসখানি ডানদিকে সরাও দিনি, নবীন রবির আলোয় রাঙা হোক আমার বাউল রাজার মুখ। “
আমি তাকিয়ে দেখলাম, সত্যি সত্যিই আমি যেখানে মোড়াটাকে রেখেছি, তার একটু ডানদিকেই, ছাতিমের পাতার ফাঁক গলে সূর্যের একটা চৌখুপী আলো দাঁড়িয়ে আছে। আশ্চর্যজনকভাবে পাতাগুলো এতোটাই স্থির হয়ে আছে যে আলোটাও যেন মঞ্চে প্রক্ষেপিত আলোর মতোই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কানাইদা ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে অঞ্জলি দেওয়ার মতো করে ফুলগুলোকে ছবিটার পায়ের সামনে রেখে ধ্রুবদাকে ফুল দিতে ডাকলেন। একে একে সবাই এসে ফুল দিলো। ছুটকি গিয়ে কোন ফাঁকে আরও কিছু ফুল তুলে নিয়ে এসেছে। বাউলনিও ধুপদানিতে দুটো ধূপকাঠি জ্বেলে দিয়েছে। এতো সুন্দর সহৃদয়তার সাথে বিষয়টা ঘটলো যেন সবাই মিলে নিরুচ্চারে পূজা সমাপন করলাম।
–” অ মা কিষ্ণা, এ পুজোর যা উপাচার সেটা বাকি রাকবি রে মা? ধরে ফেল দিকিনি.. “
বলেই তিনি সেই সুরটা ফের বাজাতে শুরু করলেন। কৃষ্ণভামা ছবিটার সামনে হাঁটু মুড়ে বসে দু’চোখ বন্ধ করলো।

–” আমার তরী ছিলো চেনার কূলে
বাঁধন যে তার গেলো খুলে
তারে হাওয়ায় হাওয়ায় নিয়ে গেলো
কোন অচেনার ধারে–
পথিক সবাই পেরিয়ে গেলো ঘাটের কিনারাতে
আমি সে কোন আকুল আলোয় দিশাহারা রাতে…
সেই পথ হারানোর অধীর টানে
অকূলে পথ আপনি টানে
দিক ভোলাবার পাগল আমার
হাসে অন্ধকারে…
ও চাঁদ,
চোখের জলে লাগলো জোয়ার
দুখের পারাবারে
হলো কানায় কানায় কানাকানি
এই পারে ওই পারে
ও চাঁদ…”

সমস্ত পরিবেশ স্তব্ধ। বাউলনি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে রবিঠাকুরের ছবির দিকে। আর কানাইদার দু’চোখের কোল বেয়ে যেন বর্ষার ধারা বইছে। আমি অপরাধীর মতো দাঁড়িয়ে আছি। ছুটকিও বাউলনির কোল ঘেঁসে বসে। একমাত্র ধ্রুবদা দাওয়া ছেড়ে ঘরে গিয়ে ঢুকেছেন।
গানটা শুনে কানাইদা কাঁদছেন কেন ? আর তিনি আগে থাকতেই এ গানের সুর ভাজছিলেনই বা কেন? এটা কি এমনিই একটা সমাপতন, নাকি তিনি আগে থেকেই জানতেন, কী হতে যাচ্ছে! আর কী আশ্চর্য, কৃষ্ণভামার দুঃখে তাঁর বুক ভেসে যাচ্ছে। এতো প্রেম ! তাঁর সাধনসঙ্গিনীর অন্যের আসন্ন বিরহের কাতরতাতেও সন্তাপে তাঁর বুক ভেঙে যাচ্ছে! এ দৃশ্য কি আমাকে কিছু শিখতে বলছে? না কি আমাকে মায়ার দড়িতে বেঁধে ফেলার এ এক পূর্বপরিকল্পিত চক্রান্ত!
–” আরে ছুটকি, একটু চা করবি তো নাকি? অন্তত একটু চা খাইয়া রওনা দেই। “
কৃষ্ণভামা শশব্যস্ত হয়ে উঠে রান্নাঘরের দিকে চলে গেলো। ধ্রুবদার কথা যেন কানেই যায়নি, কানাইদা এমনি একটা ভাব নিয়ে একতারা বাজিয়েই চললেন।

এনামেলের থালায় গরম গরম লুচি আর বাটিতে করে আলুভাজা নিয়ে ছুটকি এসে আসন পেতে দিলো। কানাইদা, একতারাটাকে রেখে এসে বসলেন। স্তব্ধতার ঘোর এখনও কাটেনি।
— ” আইজ আর ট্রেন পামু না। লোকালে লোকালে যাইতে হইবো। “

ধ্রুবদা হয়তো এই অস্বস্তিকর পরিবেশটাকে ভাঙতে চাইছেন। কিন্তু কেউ ওঁর কথার পিঠে কথা বললো না।
খাওয়া হলে হাতমুখ ধুয়ে ধ্রুবদা ঘর থেকে ওঁর কাঁধে ঝোলানো ব্যাগটাকে নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন।
–” কিরে, তর হইলো? আরে একটু তাড়াতাড়ি কর রে ভাই। “
আমি উঠে মুখ ধুয়ে ব্যাগ নিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। ছুটকির মাথায় হাত বুলিয়ে ওর শণের মতো চুলগুলোকে আঙুল দিয়ে একটু ঘেঁটে দিলাম।
–” আবার এসো কেনে গো দাদাবাবু… “
ছুটকির কথায় আমি ঘাড় নাড়লাম। ধ্রুবদা বারান্দা থেকে উঠোনে নেমে এলেন।
–” আসি গো কানাইদা, ভালো থাইক্কো, এইখানে আইলে আর যাইতে ইচ্ছা করে না গো। কিন্তু যাইতে তো হইবোই, ন্যাইলে সাইট বন্দ হইয়া যাইবো গা। “
–” দাঁড়াও, আমারও এটটু যেতে হপে। একসাতেই যাই চলো… “

ওঁরা একটু এগিয়ে গেছেন, আমি এসে বাউলনির দুটো হাত ধরলাম। –” আমাদের কি আর দেখা হবে না?”
কৃষ্ণভামা মাটির দিকে তাকিয়ে রইলো।
–” তুমি কি সত্যিই কখনও আর —“
আমার দুচোখে ওর দুচোখ।
–” তুমি এতোটুকুও কষ্ট পাও, সেটা আমি সহ্য করতে পারবুনি গো, ঠাকুর। তুমি সত্যিই আর এসো নি গো। তোমার মন করবীফুলের মতোই নরম গো, মায়ার ছলনা বোজো না। “
দু’জনেই দু’জনের দিকে অপলক তাকিয়ে রইলাম।
–” এবেরে এসো গো ঠাকুর। ওরা অনেকটা এইগে গেচে। মনরে শক্ত করো দিকি। আমি তোমার নকের যুগ্যি নই কো । আমাদের মতো মেয়েরে মনে রেকে কষ্ট পেতে নিই। যাও — তুমি এবেরে এগোও গো ঠাকুর –“

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।