সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে কৌশিক চক্রবর্ত্তী (পর্ব – ১১)

কলকাতার ছড়া 

গ্রামবাংলার চোখে সেযুগের কলকাতা এক ম্লেচ্ছ নগরী। বাবুদের যথেচ্ছাচার তখন সারা বাংলার মুখে মুখে ফিরছে। তবু ঠাঁই দিয়ে কুলিয়ে ওঠা যাচ্ছে না। দলে দলে বাঙালীর দল ছুটে আসছে ইংরেজ জমিদারদের নতুন নগরীতে। তথাকথিত ব্ল্যাক টাউনে আর জায়গা দেওয়া যাচ্ছে না। মানুষের চাপে বাড়তে থাকছে কলেরা, ওলাউঠার মত মহামারী। প্রতিদিন মানুষ মরে। আবার জন্মায়ও। সেযুগেও কলকাতায় জনবসতি বৃদ্ধির হার ছিল চমকে দেবার মত। কথায় কথায় বলে রাখি, কোম্পানির কাগজ থেকে জানা যাচ্ছে, ১৭০৬ খ্রীস্টাব্দে তৎকালীন কলকাতার কালেক্টর একটা সমীক্ষা করান। তখন কলকাতার মোট আয়তন ৫০৭৭ বিঘা। তার মধ্যে মাত্র ৮৮১ বিঘা ১০ কাঠায় ঘরবাড়ি। বাকি জমির ১৫২৫ বিঘায় ধানক্ষেত। ১৭২৫ খ্রীস্টাব্দে কলকাতার জনসংখ্যা ছিল ১২০০০। কী? চিনতে পারছেন না তো? এবার দাঁড়ান। আর কয়েক বছরের মধ্যে ১৭৮৯ তে কলকাতার জনসংখ্যা গিয়ে দাঁড়ালো ৬,০০,০০০ তে। তখন কলকাতা সম্পূর্ণ ভাবে এক জনবহুল শহর এবং ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী। এমনই ছিল কলকাতার আজব পরিবর্তনের ইতিহাস, মহানগরী হয়ে ওঠবার ইতিহাস। আর তাই তখন থেকেই জনবসতি ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে কলকাতার কাছাকাছি বিভিন্ন দিকে দিকে। এহেন শহর কলকাতার বিভিন্ন জায়গাকে কেন্দ্র করে মানুষের মুখে মুখে ফিরত বহু ছড়া। যেমন কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত বলতেন –
“রেতে মশা, দিনে মাছি
এই নিয়ে কলকাতায় আছি।”
অর্থাৎ বেশ বোঝা যায় কাজের জন্য কলকাতায় ছুটে এলেও বাংলার রক্ষণশীল সমাজ কখনোই শহর কলকাতাকে বসবাসের উৎকৃষ্ট জায়গা বলে বুকে জড়িয়ে ধরতে পারেন নি। ইংরেজ জমিদারীর অন্তর্গত এই শহর ছিল বাঙালীর এক আজব কর্মস্থল। সেযুগে কলকাতা আর কালীঘাট ছিল প্রায় সমার্থক। এই তীর্থই ছিল শহরের প্রধান আকর্ষণ। কিন্তু সেখানকার পুরোহিতদের শাস্ত্রজ্ঞানকে ব্যঙ্গ করতেও ছাড়েন নি গ্রাম বাংলার রক্ষণশীল সমাজ। মুখে মুখে ফিরত –
“কালির অক্ষর নাই কো পেটে
চণ্ডী পড়েন কালীঘাটে।”
আবার কখনো শোনা যেত-
“কাক, কাঙালি, ভাট
তিন নিয়ে কালীঘাট। “
আবার কলকাতায় গড়ে ওঠা বিভিন্ন জায়গা নিয়ে ঘুরতো বহু কথ্যছড়া। যেমন –
“মশা, মাছি, ময়লা
এই নিয়ে ব্যায়লা (বেহালা)”
আবার
“গাঁজা, তাড়ি, প্রবঞ্চনা
এই তিন নিয়ে সরশুনা।”
সেযুগে কিছু কলকারখানা থাকায় লোকে কাজের জন্য ছুটতো বেলেঘাটায়। তাই বলা হত –
“যার নেই পুঁজিপাটা
সে যায় বেলেঘাটা। “
আবার চেতলার হাট নিয়ে প্রচলিত ছিল –
“আশীর্বাদ করি মাথার কাটে
মেগে খাও গে চেতলার হাটে”
তখন জনবসতি বৃদ্ধির সাথে সাথে দিকে দিকে তৈরি হল হাট। তারমধ্যে চেতলার হাটের ছিল বেশ নামডাক। প্রচুর মানুষের ভিড় লেগেই থাকতো এই হাটে। তাই মানুষের মধ্যে এইরকম প্রচলিত ছিল যে সেখানে ভিক্ষা করলেও খেয়ে-পরে দিন চলে যাবে।

অর্থাৎ এইসকল ছড়া থেকে শহর কলকাতা ও তার নব্য সমাজের প্রতি একটা সাধারণ ঘৃণা ও তাচ্ছিল্যের ভাব খুব সহজেই ফুটে ওঠে। কিন্তু তাও কর্মযোগীর শহর কলকাতা। আজও যেভাবে দলে দলে লোক কলকাতা শহরের দিকে রোজ সকালে ছুটে যায় শিয়ালদা ও হাওড়া দিয়ে, আগেও ঠিক তেমনটাই হত। আর কাজের সুবাদেই কলকাতার আশেপাশে এভাবেই গড়ে উঠলো আজকের বৃহত্তর মহানগরীর ভিত্তি।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।