সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে প্রদীপ গুপ্ত (পর্ব – ২০)

স্ট্যাটাস হইতে সাবধান

ডাক্তারের হাত থেকে জলের মগ ছিটকে মেঝেতে পড়ে মেঝেময় ছড়িয়ে গেলো।
— বলি তোমাকে কে কল করে এবাড়িতে নিয়ে এসেছে? আমি, নাকি ওই তোমার স্ট্যাটাসওয়ালী কবি বৌদিমণি? ন্যাকামো হচ্ছে? মেয়েমানুষ দেখলেই দেখছি নোলা থেকে জল গড়িয়ে পড়ে…
— নোলা থেকে তো নয়, মেঝেতে তো ঘটি থেকে জল গড়ালো।
— ঘটি থেকে জল গড়ালো — বলি একজন ডাক্তারের কাজ কী শুনি?
— রোগীই তো দেখছিলাম।
— ওই মানুষটার কথায় কান দেবেন না ডাক্তারবাবু। জীবনটাকে বিষ করে ছেড়েছে। আজ আমায় আমার এক ফ্যানের সামনে যে কী পরিমান অপমান করেছে সেকথা…
বলেই ফের ভ্যাঁ করে কাঁদতে বসে ফুলটুসি।
— ফ্যান! ফ্যান কাকে বলে হে ডাক্তার? আমার অবস্থা শুনে আমাকে দেখতে আসা লোক, ও থুড়ি, কবি, মানে একটা ফ্রড, আমি যে আমি, যে কিনা কবিতা পড়িনি সেরকম একটা, লেখা তো দূরস্থান, সেও যদি বুজে উঠতে পারে যে জীবনানন্দের কবিতা ঝেড়ে মেয়েমানুষ পটানোই তার কাজ, তাহলে বলো দেখি ডাক্তার একজন কবিত্রী সে কবিতা শুনে গলে যাবে কেন?
— কী যা তা কথা বলছো তুমি? জীবনানন্দের কবিতা? সে আবার কে? থাকে কোথায়? এই যে আমি এতো নন্দন চত্বরে যাতায়াত করি, কোথায়, একদিনও তো দেখিনি তাকে?
— বোঝ, বোঝ ডাক্তার কান্ডটা বোঝ দেখি একবার। জীবনানন্দ নাকি নন্দন চত্বরে কবিতা পাঠ করতে আসবেন। বুঝলে কিছু?

ডাক্তার দুজনের বাকযুদ্ধের মাঝখানে পড়ে কী করবেন বা তার কী করা উচিৎ সেটা বুঝে উঠতে পারছেন না। ব্যাগ থেকে স্টেথোস্কোপ আর প্রেসার মাপার যন্ত্রটাকে নিয়ে ধীরপায়ে তলাপাত্রের দিকে এগিয়ে এলেন।
— বলি এ কবিতাটা শুনেছেন — চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখে তার শ্রাবস্তির কারুকার্য —
ডাক্তারবাবু সমানে মন হাতড়ে যাচ্ছেন, কোথায় শুনেছেন ভাবছেন, কিন্তু কিছুতেই মনে করতে পারছেন না। শেষে মনে পড়লো, পাড়ার ছেলেরা এবারে যখন একজন সামাজিক মানুষ হিসেবে তাকে সম্বর্ধনা দিয়েছিলো। সেইবার একজন তরুণ এ কবিতাটা পাঠ করেছিলো। কবিতাপাঠের মধ্যে এমন কিছু লাইন আছে বলেই যেন মনে হচ্ছে তলাপাত্রের। আর হ্যাঁ, কবির নামও এরকম বিবেকানন্দ না জীবনানন্দ জাতীয়ই কিছু একটা বলেছিলো বটে।
— হ্যাঁ, শুনেছি বলেই তো মনে হচ্ছে মিষ্টার তলাপাত্র।
— দেখুন ডাক্তারবাবু, আজ আমার যতটুকু উন্নতি, সে উন্নতির কারণ হচ্ছে পড়াশোনা। আপনারও তাই, ঠিকমতো ডাক্তারিশাস্ত্র অধ্যয়ন না করলে আজ আপনি নিশ্চয়ই এই স্টেথো গলায় ঝোলাতে পারতেন না, ঠিক সেরকমভাবে ঠিকমতো কবিতা লিখতে হলেও পড়াশোনাটা মাস্ট। শুধু ওই ধুলোয় আঁচল লুটিয়ে নন্দনে গেলেই হাজব্যান্ডের পকেট খালি করা যায়, সেলফি তোলা যায়, কিন্তু কবি হওয়া…
টেবিলে সাজিয়ে রাখা ফুলদানীটা আছড়ে পড়লো দেওয়ালের গায়ে, দেওয়ালে ঝুলিয়ে রাখা ফুলটুসির ছবিটার গায়ে, ফ্রেমে আটকে থাকা কাঁচ টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়লো মেঝের ওপর।
— আমি টাকা ধ্বংস করতে নন্দনে যাই! আমি সেলফি তুলতে নন্দনে যাই? আজ সব কিছু ভেঙে গুড়োগুড়ো করে ফেলবো। এ সংসারে আগুন জ্বেলে দেবো আমি।
ফুলটুসির চিৎকার আছড়ে গিয়ে পড়লো সামনের রাস্তায়। ডাক্তার ব্যাগ গুছিয়ে কোনোরকমে পালিয়ে বাঁচলেন। আর তলাপাত্র স্থির মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রইলেন ফুলটুসির মুখোমুখি।

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।