T3 || রবি আলোয় একাই ১০০ || সংখ্যায় প্রদীপ গুপ্ত

ফেস্টুন

পাড়ার মোড়েই ফেস্টুনটা ঝুলছিলো। বলু সকালবেলা রাস্তার থেকে কুড়িয়ে পাওয়া কাগজ, প্লাস্টিকের বোতল, প্লাস্টিকের ক্যারিব্যাগ আরও হাজার কয়েক আইটেম পাশের পাড়ার মোটার দোকানে বিক্রি করে ফিরে আসার সময়েই লক্ষ্য করেছিলো ফেস্টুনটাকে। একটা মোটামুটি দশ বাই ছয়ের ব্যানার। দেখে থেকেই চোখটা লোভে জ্বলজ্বল করছিলো বলুর। এটাকে বেচে কিছু না হোক কুড়ি তিরিশ টাকা মিলবেই। মোটা এর আগেও এ সাইজের ব্যানারের জন্য ওকে কুড়ির নীচে কোনোদিনই দিয়ে দেখেনি। আজ দুপুরেই ব্যানারটাকে ছক করে দেবে বলে নিজেকেই নিজে একবার চোখ মেরে নিলো বলু। খুশীর চোটে মনে মনে একটা হিন্দি গানের দু’লাইনও গেয়ে নিলো জোরে জোরে।

যা রোদ উঠেছে, এই রোদে কুকুরগুলিও রাস্তায় নেই একটাও। মাথায় একটা গামছা পেঁচিয়ে তরতর করে লাইটপোস্টে উঠতে থাকে বলু। শুভ কাজে দেরী করতে নেই। ব্যানারের দড়িটাকে ধরে একটা হ্যাঁচকা টান দেয় ও।
পাটের দড়ি হলে কি হবে! শক্ত আছে। দু’পা আর বাঁ হাত দিয়ে লাইটপোস্টটা আঁকড়ে ধরে লুঙ্গির খুঁট থেকে চাকুটা বের করে বলু। ডান হাত আর দাঁত দিয়ে চাকুটাকে খুলে নেয় চটপট। তারপর ওটা দিয়ে সুতলিটাকে পোঁচ দিতেই কোণটা ঝুলে পড়ে। নীচের দিকের সুতলিটাকেও একই কায়দায় বাগে আনে ও। এরপর বেড়ালের ক্ষিপ্রতায় অন্যদিকের বাঁধনটাকেও কেটে দেয় বলু।
আঃ, এক মুহূর্ত একটু জিভ বের করে হাঁপিয়ে নেয়। আজকাল অপারেশনগুলো করতে গিয়ে যেন, একটু আধটু হাঁফ ধরে যায় ওর।
ঝটপট ভাঁজ করতে থাকে ব্যানারটা। একটা দাড়িওয়ালা বুড়ো ব্যানারটার মধ্য থেকে ওর দিকে তাকিয়ে ওর কাজকর্ম দেখতে থাকে।
ব্যানারটা নিয়ে ও তাড়াতাড়ি পা চালায়। নার্সিংহোমের পেছনের কচুবনের ভেতরে একটা গর্তমতো জায়গায় সন্তর্পণে লুকিয়ে রাখে ব্যানারটাকে। ব্যাস, কুড়িটাকা আয়ের রাস্তা নিশ্চিত করে ফেলে বলু।

–” বাবা, তুমি কি মোড়ের থেকে ব্যানারটা নিয়েছো? ”
–” ওই, শোন্ , আমি কি চোর নাকি, এ্যাঁ? ”
নেড়ের ওপর খেঁকিয়ে ওঠে ও। নেড়ে কপালগুণে ওর ছেলে। ব্যাটা খাটনির পয়সায় খাবে পড়বে ফের —
–” তাহলে তুমি নাওনি বলছো? শিওর তো? ”
–” উঁঃ, আবার ইংরিজি ঝাড়ছে দেখো, বাপকে কেউ ওভাবে চার্জ করে নাকি? এই তুই লেখাপড়া শিখছিস? গতরের রক্ত জল করা পয়সায় –”
— ” ওকে, নাওনি, ব্যাস, কমপ্লিট। অতো কেওস করার কি হয়েছে? “

–” দেখি, দেখি, আরে ওই ব্যানারটা দেখা নারে, হতচ্ছাড়া। ওটাই কি –”
মোটাদার উৎসাহ দেখে মনে মনে ছক কষে নেয় বলু। বুঝতে পারে মোটাদার কোনো ইন্টারেস্ট আছে।
–” দ্যাকো, ওটার জন্য আমি একশো টাকা দাম ঠিক করে এসেচি, দুলালবাবুর দোকানে। তুমি যদি একশো দাও তো বলো। নইলে –”
–” নইলে? নইলে কি? পাড়ার ছেলেদের খপর দিয়ে দেবো যে ব্যানারটা তুইই ঝেড়েছিস। ওরা রবীন্দ না কি একটা করবে বলে –”
–” ওই শোনো, যাও, খবর দিলে দাও গে যাও, — ওরা রোজ তোমার দোকানে মাল ছাপ্লাই দেবে না, বুজেচো? মাসে তিনশো পঁইষট্টি দিন আমাকেই তোমার পুজোয় লাগবে বুজেচো? ওই একশো না হলে আমি দেবোনা, ব্যাস। কথা কমপিলিট। “

নাঃ, বেটা ভগবানটা ততটা খারাপ না, মাঝে মাঝে গরীবদেরও দেখে ও, এইতো, আজই তো কেমন কড়কড়ে একশো টাকা। একটা আস্ত বাংলার বোতলই জুটিয়ে দিলো কেমন করে, দেখলি তো রে বলু, আর তুই কিনা, মালটাকে উঠতে বসতে —

পাড়ার মোড়ে ঢুকতেই একটা মাইকের আওয়াজ ওর কানে এলো। মোড়ের মাথায় একটা স্টেজ, সেখানে টাঙানো রয়েছে — আরে, এটা সেই ব্যানারটা না? হ্যাঁ সেটাই তো। সেই দাড়িওয়ালা বুড়োটা কেমন যেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওর দিকে, আর স্টেজে মাইক হাতে কি সব বলে চলেছে — কে? কে ওটা? ওর সেই সবজান্তা ছেলেটা না? হ্যাঁ ওটা তো নেড়েই, ওর নিজের রক্তের ছেলে নাড়ু, নারায়ণ –
–” যে কবির কবিতা, আজ থেকে একশো বছরেরও বেশী বছর ধরে –”
নেড়ে কি সব বলে যাচ্ছে, আর ওর কানে বাজছে নেড়ের কথাগুলো —
–” বাবা, তুমি কি মোড়ের থেকে ব্যানারটাকে নিয়েছো? “

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।