আন্তর্জাতিক || পাক্ষিক পত্রপুট || এ প্রদীপ গুপ্ত

বসন্তদূত

অনেকদিন বাদে আমার সেই পাগল ভাই মুকুন্দের সাথে দেখা। ও যে কোথায় ঘাপটি মেরে বসে থাকে! সারাটা শীত ধরে!
যখন বাতাবীলেবু ফুলেরা আড়মোড়া ভেঙে বাড়ির নতুন বৌয়ের মনে একটা আনচান ভাব এনে দেয়, যখন পাড়ার কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোর পাতারা হঠাৎ করে হামাগুড়ি দিয়ে এসে শুকিয়ে যাওয়া ডালের ভেতর গোপাল ঠাকুরের মতো পা ছড়িয়ে বসে, সে সময়ই ওকে যে কে খবর পাঠায়, কে যে এসে ওর কানে কানে বলে যায় — ওহে পাগল, গায়ে জড়িয়ে রাখা সমস্ত কাঁথা কম্বল ছেড়ে তোর পুকুরের সবুজ শ্যাওলা জলে গা ধোয়ার সময় হলো, কে জানে!
–” কি রে? কেমন আছিস? “
হঠাৎ পিঠে একটা হালকা তালুর স্পর্শে চমকে উঠলাম।
–” আবার এলাম, ভেবেছিলাম হারিয়ে যাবো, কিন্তু হঠাৎ করে কী যে হলো, একটা তেড়চা সোনালি রোদ্দুর এসে দু’চোখের ভেতরে সেঁধিয়ে গেলো জানিস! আর তখুনি যেন কোত্থেকে একপাল বাতাস এসে হুড়মুড়িয়ে এসে খলখল করে হাসতে লাগলো আমাকে ঘিরে ধরে। আর একটা ন্যাংটো বাচ্চা এসে হাত ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে বলতে লাগলো, — আমাদের ফেলে কোথাও তোমার যাওয়া চলবে না গো পাগল, দেখছো না আমগাছের পাতার ফাঁকে ফাঁকে কেমন বউল এসে নতুন বউএর মতো করে উঁকি মারছে! আর মৌটুসী পাখিগুলোকে দেখেছো? “

আমি বেশ বুঝলাম আমি বড় কঠিন বাঁধনে বাঁধা পড়ে গেছি। ওকে থামাবার জন্য বললাম, –” তা তোমার শীতের বাঁকলগুলো কোথায় ছেড়ে এলে? ঠিকমতো লুকিয়ে রেখেছো তো! কেউ আবার দেখতে পেয়ে চুরি করে নেবে না তো? “
কথাটা বলেই আমি বুঝতে পারলাম আমি কী ভুলই না করে ফেলেছি। কথাটা শুনেই ও হা হা করে হেসে উঠলো। সেই হাসিতে যেন দোলা লাগলো দীঘির জলে।
–” বাঃ, বেশ বললি তো তুই, শীতের বাঁকল! দেখ, এ তোরা বুঝবি না, তোরা যেগুলোকে আমার গায়ে জড়িয়ে পেঁচিয়ে থাকতে দেখিস, সেগুলো আসলে কি সেটা জানিস? ভালোবাসা। ধর না কেন, তোকে ডেকে কেউ যদি এক কাপ চা খাওয়ায় তুই কি সেই চা কে না খেয়ে ফেলে দিতে পারবি? আবার দেখ, এই যে এখন যেখানেই যাস না কেন সর্বত্র কেমন যেন মন উতলা করা একটা মধুগন্ধী বাতাসের ছোঁওয়া। সে গন্ধে উতলা হয়ে কেউ যদি তোকে এসে বলে –” চলো না কেন, আতরের মতো একটু গন্ধ মেখে নিই সর্বশরীরে! “ তুই কি তার হাত ছাড়িয়ে দৌড়ে পালাবি সেখানে, যেখানে কোনোরকম মধুগন্ধ ভেসে বেড়ায় না ভালোবেসে! শীতে আমায় ওই ভালোবাসাগুলোই তো জাপ্টে থাকে সর্বাঙ্গে। সে ভালোবাসার ছোঁয়া যে না পেয়েছে সে কীভাবে বুঝবে বল, কোনটা বাঁকল আর কোনটা ছালচামড়া? “
আমি যে কী বলি! যতোবারই আমার সাথে ওর দেখা হয়েছে, ও আমায় ওর কথার জালে বন্দী করেছে। কথা শুনে কে বলবে যে ও একটা বদ্ধ উন্মাদ! আমি ফের বোকার মতো জিজ্ঞাসা করে বসলাম, –” সে না হয় বুঝলাম, কিন্তু এবারে বলো দেখি, সে ভালোবাসাগুলোকে কি বিদায় করে এলে, না কি কোনো জিম্মায় জমা রেখে এলে? “
–” এ জন্যই তোকে পাগল বলি জানিস! ভালোবাসা কখনও বিদায়ও করা যায় না আবার জিম্মাতেও রেখে আসা যায় না। ধর তুই যাকে বিদায় করবি ভাবছিস, দেখবি কারণে অকারণে তার দিকেই তোর মন পড়ে রয়েছে। তুই রাগ করে ভাবছিস বটে যে, আমি আর তার কথা ভাববোই না, কিন্তু দেখবি, উঠতে বসতে, শয়নে স্বপনে, দিনরাত তুই তাকে নিয়েই ভেবে চলেছিস। গালি দে তো তাকেই, শাপ শাপান্ত কর তো দেখবি সেই তাকেই, বিরক্ত হয়ে ভাবলি একটা গল্পের বই পড়ি, তো দেখবি সেই বইয়ের পাতায় তার ছবিই ফুটে উঠেছে। কখনও, কোনো একদিনের জন্য, এক পলের জন্যও তুই যদি তাকে সত্যিকারের ভালোবেসেছিস তো ব্যাস, সে ভালোবাসাকে আর বিদায় করতে পারবি না। আর জিম্মায়! আরে পাগল, যে জিনিস নিজের মনের ভেতরে জিম্মা রেখেছিস সে জিনিসকে তুই ফের অন্যের কাছে জিম্মা রাখবি কীভাবে বল দেখি! এ কি তোর সত্যিকারের হীরে জহরৎ, এ যে মনের ভাবের মানিক রে পাগল, তোর বেড়ার ঘরে সিঁধেল ঢুকতে পারে, কিন্তু ভাবের ঘরে কে চুরি করবে বল দেখি? “
কি কথা যে বলে গেল পাগলটা, আমি তার একবর্ণও বুঝলাম না, শুধু এটুকু বুঝলাম যে আমি যেদিন ওর কথাকে ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারবো সেদিন আমি পাগল হবো আর মুকুন্দ আমায় পাগল বানিয়ে দিয়ে সুস্থ হয়ে উঠবে।
–” তবে একটা কথা আমি এবারের শীতে পরিষ্কার করে বুঝেছি বুঝলি, ভালোবাসার থেকে পালিয়ে বাঁচতে হয়। দেখিস না, এই যে ভালোবাসার ঋতু এসেছে, দুদিন পরেই কোথায় উধাও হয়ে যাবে কেউ খুঁজে পাবে না। বেশীদিন কাছে থাকলে ভালোবাসা কলাই করা থালার মতো এখানে ওখানে চলটা উঠে যায় বুঝলি, তখন কেমন যেন ভালোবাসা হাঁ করে গিলতে আসে। বিচ্ছিরি দেখায়, ওই ন্যাংটো বাচ্চাটা এসে হাত ধরে টান না মারলে আমিও যে কোথায় উধাও হয়ে যেতাম কে জানে! তবে এ বসন্ত চলে গেলে আমাকে আর খুঁজে পাবিনা রে পাগল, বর্ষাকে কাঁদিয়ে আমিও ঠিক —”
ফের পিঠে একটা তালুর স্পর্শ। এক পশলা হাওয়ার মতো কে যেন ছুটে চলে গেলো সামনে থেকে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।