সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে প্রদীপ গুপ্ত (পর্ব – ৬)

স্ট্যাটাস হইতে সাবধান

হজা এখন প্রায় হাফ পাগল। নাওয়াখাওয়ার ঠিক নেই, পাড়ার রোয়াকেও খুব একটা দেখা যায় না ওকে, ওদের পাড়া থেকে একটু এগিয়ে গেলেই যে মজা – পচা খালটা দুর্গন্ধ কালো জল বুকে ধরে বুক চিতিয়ে পড়ে আছে, তার পাড়ে একটা প্রাচীন বটগাছের নীচে একটা ছোট্ট কালীমন্দিরে এক ন্যালাখ্যাপা রক্তবসন পরিহিত তান্ত্রিকের বাস। ওই তান্ত্রিকের ঠেকেই এখন হত্যে দিয়ে পড়ে রয়েছে হজা। চিলিমের পর চিলিম ধোঁয়া উড়িয়ে, দুচোখ রক্তবর্ণ করে থরহরি বাবার পা জড়িয়ে ধরে মাঝেমধ্যেই হিস্টিরিয়া রোগীদের মতো চিৎকার করে উঠছে — আমি ট্রাক চালাবো বাবা, যেভাবেই হোক আমাকে ফুলটুসি ট্রাকের ড্রাইভার বানিয়ে দাও, আমি জন্মজন্মান্তর ধরে তোমার কেনা গোলাম হয়ে থাকবো বাবা থরহরি।
সমানে গাঁজার পুরিয়ার সাপ্লাই পেয়ে আর গাহাতপা টিপে দেওয়ার আরামে চোখ বুজে আসে বৃদ্ধ থরহরির। ওর সেই প্রৌঢ়কালের কথা মনে পড়ে যায়। কী দিনটাই না ছিলো তখন! এই খালটাও এরকম মজে দুর্গন্ধ ছড়াতো না, তপ্তকাঞ্চনবর্ণ থরহরি রক্তাম্বর পড়ে হাতে ত্রিশূল নিয়ে যখন – ” জয় মা কালি ” বলে হুঙ্কার ছাড়তেন, তখন দুচার কিলোমিটার দূর থেকে আসা গেরস্ত বউ থেকে শুরু করে কলেজের ছাত্রীরাও মাটিতে লুটিয়ে পড়ে প্রণাম সারতেন। কোন বন্ধ্যা মহিলার সন্তান হচ্ছে না, কার স্বামী রোজ মাল খেয়ে এসে বৌকে ধরে পেটায়, বশীকরণ, পরীক্ষায় পাশ করিয়ে দেওয়া — আহা, সেসব দিনের স্মৃতি যেন বর্ষার মেঘের মতো এসে ওর ঢুলুঢুলু চোখে আশ্রয় নেয়, ওর খুব ইচ্ছা করে সেইসব সোনার দিনগুলোতে ফিরে যেতে, ফিরেও যায় হয়তোবা। মনের ভুলেই হজার মাথায় হাত রেখে বলে ওঠেন,
— হবে হবে, শুধু ট্রাক কেন রে, তুই প্লেনও চালাবি রে হজা।
— না বাবা, আমি প্লেন চালাতে চাইনা , চাইবোও না কোনোদিনও , আমি শুধু ফুলটুসি —
কথা শেষ করতে পারেনা হজা, থরহরি বাবার নাসিকাগর্জনের শব্দে থেমে যায় হজা।
পরেরদিন গাঁজা না নিয়েই চলে এলো হজা। হাতে দুধের প্যাকেট। এসে ঘরের এক কোণায় আসন পাতে হজা। ভক্তিভরে দুধের প্যাকেটটাকে ত্রিশূলের ওপর ঢালতে ঢালতে বিড়বিড় করতে থাকে — জয় বাবা ব্যোমভোলে, জয় মা কালি। আমার কামনাবাসনা চরিতার্থ করো। আমাকে ফুলটুসি ট্রাকের ড্রাইভার করে দাও জগদীশ্বর।

হঠাৎ করে হজার এই পরিবর্তনে চমকে ওঠেন থরহরিবাবা। কিছুটা সময় নেন ব্যাপারটা বোঝার জন্য। তারপর হুঙ্কার দিয়ে ওঠেন।
— ওরে শালা, আমি ওদের ডাইরেক্ট এজেন্ট, আমাকে এড়িয়ে ওদের ঘুষ দিলেই কি ওরা তোর কথা শুনবে?
— তোমার কানে তো জল ঢুকছে না কিছুতেই, তাই তো এজেন্টকে ছেড়ে ডাইরেক্ট লাইন করছি।
— সেসব বোঝা যাবে, আগে গ্যাঁজা সাজ।
— আনিনি
— আনিনি মানে?
— এ কদিন এনে তো দেখলাম, তুমি শুধু গ্যাঁজাতেই টান মারো, কাজের কাজ কিছুই করো না।আগে কাজ করে দাও, তারপর গ্যাঁজা টেনো।
— আরে ছাগল, বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁওয়া না দিলে বুদ্ধি খুলবে কেন?
— সে আমি জানি, বুদ্ধির গোড়ায় ধোঁওয়া দিলে ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে নিজের এজেন্সি রিনিউ করাও। আজ আগে বলবে তারপরই আনতে যাবো।
থরহরি চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ কী জানি চিন্তা করেন।
— এদিকে আয়, আসন গেঁড়ে বোস দিখিনি। তোকে আজ আমি ট্রাক ড্রাইভার বানিয়েই ছাড়বো।

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।