|| কালির আঁচড় পাতা ভরে কালী মেয়ে এলো ঘরে || T3 বিশেষ সংখ্যায় প্রদীপ গুপ্ত

একটি বলি ও আবেশিত প্রেম

মধ্যরাতে অন্ধকারের বুক চিরে চিৎকার করে উঠলেন পুরোহিত — ” জয় মা “। মাথার ওপর রামদা তুলে নিয়ে একজন ক্ষীণকায় মানুষ চকিতে নামিয়ে আনলেন তার হাতদুটো। একটা অবলা প্রাণীর আর্তচিৎকারে বাতাস মথিত হলো। ফিনকী দিয়ে রক্ত ছুটে গেলো যিনি হাঁড়িকাঠে পাঠার পেছনের পাদুটো টেনে ধরে রেখেছিলেন তার হাঁ করা মুখের দিকে। সৌমির সারা শরীর থরথর করে কেঁপে উঠে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা প্রিয়মের শরীরটাকে খামচে ধরলো।

জেভিয়ার্সের ক্লাসমেট কঙ্কণার বাড়ি বীরভূমের সিঁউড়ি আর বোলপুরের মাঝের এক প্রত্যন্ত গ্রামে। বালিগঞ্জে বড়ো হওয়া সৌমির সাথে ফিজিওলজির সেকেন্ড ইয়ারের কঙ্কনার বন্ধুত্ব যেন ঠিক শরৎকাল আর কাশফুলের মতোই। সৌমি অনেকদিন থেকেই ঠিক করে রেখেছিলো এবারে কঙ্কনার বাড়ির কালিপুজোয় আসবে বলে। একে সৌমি কোনোদিনও কালিপুজোয় রাত জাগেনি, তারওপর এরকম একটা অজগ্রামে কালিপুজোর রাতে রাত জেগে পুজো দেখা, চিন্তা করলেই কেমন একটা রোমান্টিক মুড চলে এসেছিলো সৌমির। দুর্গাপুজোর পর থেকেই বেশ কয়েকবার ফোন করে কীভাবে কঙ্কনাদের বাড়ি যেতে হয় সেসব পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে জেনে নিয়েছিলো সৌমি।

প্লানমাফিক আজ দুদিন হলো সৌমি এসেছে। এই দুদিন ধরে সিঁউড়ি বোলপুর , বক্রেশ্বর চষে বেরিয়েছে দু’জনে। সাথে গাইড হিসেবে পেয়েছে কঙ্কনার মাসতুতো দাদা প্রিয়মকে। প্রিয়মদের বাড়ি অন্ডাল। বাবা কোলিয়ারীর ইঞ্জিনিয়ার। কলকাতা থেকে চাকরি করতে এসে সেই যে অন্ডালের আদিবাসী মানুষগুলোকে ভালোবেসে থেকে গেছেন আর কলকাতা মুখো হননি। অন্ডাল মোড় থেকে একটু এগিয়ে রানীগঞ্জের দিকে যেতে একটা গ্রামে জায়গাজমি কিনে বাড়ি করে থেকে গেছেন। প্রিয়ম ওর বাবামায়ের একটাই ছেলে। নীলরতন সরকার হাসপাতালের ইন্টার্ন। প্রতিবছরের মতো এবছরও মাসিবাড়ি এসেছে কালিপুজোয় আনন্দ করবে বলে। কালিপুজোর পর একেবারে কঙ্কনার হাতে অন্যান্যবারের মতো ভাইফোঁটা নিয়ে ফের রওনা দেবে কলকাতা।
সৌমিরও যেমন ছেলেধরার অভ্যেস নেই প্রিয়মেরও সেরকমই মেয়ে দেখলেই ছুকছুক করা ধাতে নেই। আর দু’জনের স্বভাবের খবরই কঙ্কনার কাছে অজানা ছিলো না। কাজেই এই তিনদিন ধরে তিনজনে মিলে হৈরে বাবুই হৈ করে ঘুরে বেড়াতে ওদের তিনজনের কারোই সেরকম কোনো অসুবিধা হয় নি। সোনাঝুরির গাছতলায় বসে সৌমির গান শুনে বাকী দু’জনেই যেরকমভাবে বুঁদ হয়ে গেছিলো, অথবা আম্রবিতানের নির্জনে প্রিয়মের গলায় শেষের কবিতার কবিতা শুনে সেই একইরকমভাবে বালিকার মতো হাততালি দিয়ে উঠেছিলো সৌমি। কিন্তু ওদের দু’জনের কারোই কখনোই মনে হয়নি যে ওরা সদ্য পরিচিত। আর সেকারণেই বক্রেশ্বর শ্মশানে ঢোকার মুখে বয়ে যাওয়া তিরতিরে নদীটা পেরোতে গিয়ে কঙ্কণা আর সৌমির দিকে একজন কিশোরের মতো জল ছিটিয়ে দিতে গিয়ে প্রিয়ম এতটুকুও কুন্ঠিত হয় নি। কিন্তু এখন…

সৌমি দু’হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে আছে প্রিয়মের শরীরটা। থরথর করে কাঁপছে সৌমির সারাটা শরীর। মেয়েদের সাথে অজস্র মিশলেও উদ্ভিন্নযৌবনা নারীর শরীরে যে একটা মাদকরসের সুবাস আছে সেটা প্রিয়মের অজানা ছিলো। প্রিয়মের চওড়া বুকে মুখ গুঁজে রেখে দিয়েছে সৌমি। সবার সচকিত চোখের সামনে প্রিয়ম অসহায় হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অথচ ও এই মুহূর্তে এতোটুকুও চাইছে না যে সৌমি ওর বুকের থেকে মুখ সরিয়ে নিক। কঙ্কনাও কী করা উচিত সেটা বুঝে উঠতে না পেরে বোকার মতো ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। অবশেষে প্রিয়ম অনিচ্ছাসত্ত্বেও সৌমির দু’কাঁধ ধরে সোজা করে দাঁড় করালো সৌমিকে। একটা হরিণশাবকের মতো সৌমির সারাটা শরীর তখনও থরথর করে কাঁপছে। সৌমিকে আলগোছে ধরে নিয়ে পাশে রাখা একটা চেয়ারে বসিয়ে দিলো প্রিয়ম। জলের জগে একজগ জল নিয়ে পরম মমতায় সৌমির মুখ ঘাড় মুছিয়ে দিতে লাগলো। সৌমি দু’চোখ মেলে চাইলো প্রিয়মের দিকে। অমাবস্যার আঁধারে জ্বলতে থাকা গ্রামবাংলার টিমটিমে ইলেক্ট্রিক বালবের আলোয় প্রিয়মের মনে হলো এতো সুন্দর চোখ ও এর আগে আর কোনোদিনও দেখেনি। পানপাতার মতো মুখের থুতনিটাকে তুলে ধরে জিজ্ঞাসা করলো — ” একটু ভালো লাগছে এখন? “

এরপরের গল্প অতি সাধারণ। শুধু একটা কথা না বললেই নয়, অনেক খ্যাপানো সত্বেও সৌমিকে কিছুতেই ভাইফোঁটা দিতে রাজী করাতে পারেনি কঙ্কণা।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।