|| শাম্ভবী সংখ্যা ২০২১ || T3 শারদ সংখ্যায় পিয়ালী দে মিত্র

কুমারীর কুমারীত্ব



  এই গরীব ব্রাহ্মণের মেয়ে কে যে জমিদার বাড়িতে কুমারী পূজার জন্য নেওয়া হচ্ছে সেটাই আমাদের মত লোকেদের জন্য ঢের। কি বল গিন্নি!! তা আর বলতে ,আমার কতদিনের শখ ছিল আমাদের মেয়ে মা দুর্গার মত সাজবে। আর সবাই তাকে ভক্তিভরে মা দুর্গার মত পূজা করবে ।আমাদের মত গরীবের সে সাধ্য কোথায় যে তাকে এত সুন্দর করে সাজাবে। আমাদের মেয়ে রূপে লক্ষ্মী গুণে সরস্বতী। এই চণ্ডীপুর গ্রামে আমার মেয়ের মত খুব কম মেয়েই আছে।
  হ্যাঁরে বউ তোর তো এবারে খুব মজা। তোর মেয়ে দেবীর আসনে বসে আছে। আর তাকে জমিদার গিন্নি জমিদারবাবু  দেবী জ্ঞানে পূজা করছে। হ্যাঁ দিদি আমি তো ভাবতেই পারছিনা। এটা যেন আমার কাছে একটা স্বপ্ন। আনন্দে শিবানীর চোখে জল এসে গেল। ভোলানাথ মুখুজ্জে আর শিবানী মুখুজ্জে তার মেয়ে লক্ষি কে নিয়ে গর্বের অন্ত নেই। আর কেনই বা থাকবে না সত্যিই তাদের মেয়ে নামে ও কাজে  লক্ষী ।

     হ্যাঁগো আমাদের মেয়েটা কোথায় গেল? আজ নবমী চতুর্দিক আলোয় ঝলমল করছে। কিন্তু ভোলানাথ মুখুয্যের বাড়ি আঁধার। তাদের মেয়েকে আজ বিকেল থেকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সবাই এদিক ওদিক কত হন্যে হয়ে খুঁজছে। শিবানী তো বুক চাপড়ে কেঁদেই যাচ্ছে। তাকে শান্তনা দেওয়ার কোনো ভাষা নেই। হঠাৎ কতগুলো লোক হন্তদন্ত হয়ে যেন ছুটে আসছে। তাদের চোখে-মুখে ভয় আর উত্তেজনা। শিবানী পাগলের মতো কাঁদতে কাঁদতে তাদের জিজ্ঞাসা করল কি হয়েছে কি হয়েছে?? তার পরেই সে দেখতে পেল ভোলার কোলে তার ছোট্ট ফুটফুটে 10 বছরের লক্ষীকে। কে যেন তার সারা শরীরে দাগ করে দিয়েছে। তার বসন ছিন্নভিন্ন সে অচৈতন্য।শিবানীর বুঝতে অসুবিধা হলো না। সে পাগল হয়ে গেল। তার মেয়েকে বুকে জড়িয়ে অঝোর ধারায় কাঁদতে লাগল।
    তারপরেই হঠাৎ দেখা গেল জমিদার গিন্নি উদভ্রান্তের মত ছুটে আসছে। সে শিবানী আর ভোলানাথের পা জড়িয়ে ধরে বলতে লাগলো ঠাকুর মশাই আমাদের ক্ষমা করে দিন।আর এক্ষুনি লক্ষী মায়ের চিকিৎসা শুরু করুন।আমি ডাক্তার সঙ্গে করে এনেছি। এপাপ ধম্মে সইবে না। যাকে কাল অষ্টমীর দিনে দেবী জ্ঞানে পূজা করা হলো তার সাথে এই অন্যায় অবিচার মা কখনো মেনে নেবেন না। গ্রামের সবাই হতবাক হয়ে গেল। তারা বুঝতে পারছে না  এটা কি হচ্ছে এখানে।
   তারপর জমিদার গিন্নি চেঁচিয়ে উঠে  বললেন আপনারা সবাই জমিদার বাড়ী চলুন আর থানায় খবর দিন একটা। আমি সেই দোষী কে ঘরে বন্ধ করে এসেছি। তার শাস্তি না হলে আমি যে মা হয়ে কিছুতেই শান্তি পাব না। মা দুর্গা ও আমাকে কখনো ক্ষমা করবেন না। তবে আপনারা যদি এখন না যান তাহলে অনেক দেরি হয়ে যাবে। আর কিছুই করা যাবে না ।আজ 33 বছর ধরে আমিও জমিদারবাড়ির অনেক  কুকীর্তি ও অন্যায় মুখ বুজে সহ্য করে এসেছি। তবে আর নয়। তা না হলে নিজের ছেলেকেও মা হয়ে শিক্ষা দিতে পারব না।
  সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ চলে এলো। জমিদার গিন্নি পুলিশের বড় কর্তা কে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললেন একটা সুরঙ্গ পথ ধরে তারা একটা ঘরের মধ্যে গিয়ে পৌঁছলো সেখানে বছর১৭ একটি ছেলেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় পাওয়া গেল। ছেলেটি যে জমিদারবাবুর ছেলে সেটি বুঝতে কারো অসুবিধা হলো না। আর সেই ঘরে লক্ষীর পরনের কিছু ছিন্নভিন্ন কাপড়ের টুকরো  পাওয়া গেল।কারুর বুঝতে অসুবিধা হলো না ঘটনাটা কি ঘটেছে।
   তবে  জমিদারবাবু কে দেখতে পাওয়া গেল না। গিন্নিমা জমিদারবাবু কেউ একটা ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে শিকল তুলে দিয়েছিলেন। পুলিশ আসতেই  তাকে ও মুক্ত করা হল। গিন্নিমা তত্ত্বাবধানেই লক্ষ্মীকে জমিদার বাড়ির বাইরে রেখে আসা হয়েছিল। যাতে জমিদার বাড়ির কোন কর্মচারী  তার কোন ক্ষতি না করতে পারে।
   ছেলেটিকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে এই ছেলেটি জানালো লক্ষ্মী কে অমন দেবীর সাজে দেখে সে আর নিজেকে ঠিক রাখতে পারিনি। যদিও বহুদিন থেকেই তার উপরে  একটা নজর ছিল ।তাই সেই কৌশল করে জমিদার বাবুকে এবছর পুজোয় লক্ষ্মীকে কুমারী সাজানোর কথা বলেছিল। জমিদারবাবু  প্রথমে বুঝতে পারেননি।  আজকের ঘটনার কথা তিনি জানতে পেরে ছেলেকে আড়াল করার চেষ্টা করেন। জমিদারবাড়ির ছেলে লক্ষ্মীর ব্যাপারে তক্কে তক্কে ছিলেন সে বিকেলে যখন তার বন্ধুদের সাথে খেলছিল সেই সময় তাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে আরো জমিদার বাড়ি থেকে তাকে উপহার দেয়া হবে  কুমারী সাজার জন্য এই লোভ দেখিয়ে তাকে ঘরে নিয়ে আসা হয়। পুলিশের বড়বাবুকে বলতে বলতে জমিদারবাবু ছেলে আদিত্য নারায়ণ চৌধুরী কাঁদতে লাগলো। জমিদার গিন্নি তার সন্তানকে চিনতেন। আজ বিকালের পর থেকে আর ছেলের ব্যবহার আর  লক্ষ্মীর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা তার কানে আসতেই তার বুঝতে আর অসুবিধা হল না।

শিবানী জমিদার গিন্নির পা জড়িয়ে ধরে বললেন আজ আপনি যেটা করলেন সেটা দেখে অনেক মা শিক্ষা পাবে। গিন্নিমা ভোলানাথ আর শিবানী কাছে আবারো ক্ষমা চেয়ে বললেন” লক্ষীর সমস্ত দায়ভার আমার। আজ থেকে লক্ষী আমার মেয়ে। আর যে বাড়িতে লোকচক্ষুর সামনে মেয়েদের দেবী জ্ঞানে পূজা করা হয় আর আড়ালে তাদেরই লাঞ্ছনা করা হয় তাদের আর যাই হোক মা দূর্গার পূজা করা মানায় না।
তারপর থেকে শোনা যায় জমিদার বাড়িতে আর কোনদিন দুর্গা মায়ের মূর্তির আনা হয়নি। ওই নামো নামো করেই ঘটে পটে পূজা সারা হয়। যেখানে চিন্ময়ী মায়ের কোন সম্মান থাকে না সেখানে মৃন্ময়ী মায়ের পূজা বৃথা।।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।