পেশা আর নেশা দুটোই একই; নৃত্য শিল্প।
গুরুমা হিসেবে পেয়েছিলেন মমতাশঙ্করকে। ছোটদের জন্য গড়ে তুলেছেন নৃত্য শিক্ষার একটি স্কুল। ওঁর শিল্পী জীবনের গল্প বলার জন্য এই প্রথম হাতে তুলে নিয়েছেন কলম।
অন্তিম পর্ব
২০১৭ সালটি আমার জীবনে নিঃসন্দেহে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি বছর। গ্র্যাজুয়েশনের চোদ্দো বছর পর আমি রবীন্দ্রভারতী তে ভর্তি হই এম. এ করার উদ্দেশ্যে৷ এই সময়ের একটা ঘটনা খুব মনে পড়ে যাচ্ছে – যেদিন আমি ইউনিভার্সিটির অফিসঘরে ভর্তির লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম সবাই যেনাে আমার দিকে একটু কৌতূহল বশত তাকিয়েছিল৷ আমারও একটু অসস্তি বােধ হচ্ছিল এটা ভেবে যে কি করে এই বয়স ছােট ছেলেমেয়েদের সঙ্গে একসাথে পড়াশােনা করবাে? রেজিষ্ট্রেশন অফিস ঘরের কাকু তাে সরাসরি জিজ্ঞাসা করেই ফেললেন—“এত বছর কি করছিলে?” আমি সরাসরি উত্তর দিই –“সংসার করছিলাম”, পাশে দন্ডায়মান স্বামী আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসে। রবীন্দ্রভারতী তে প্রথম দিনের ক্লাসের অভিজ্ঞতা আমার কাছে বেশ স্মরণীয়৷ আমরা সবাই (রবীন্দ্রভারতী এর নিজস্ব ছাত্র ছাত্রী এবং বাইরে থেকে আগত ছাত্রছাত্রী) ইউনিভার্সিটি এর “উদয়শঙ্কর’ হলঘরে বসেছিলাম। হলঘরে যাওয়ার আগে পর্যন্ত আমার মধ্যে যে দ্বিধা সংকোচটা কাজ করেছিল আকস্মিকভাবে তার অবসান ঘটে যখন সব ছাত্র ছাত্রীদের সঙ্গে আলাপ হয়৷
হ্যাঁ বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রী আমার থেকে বয়সে ছােট হলেও প্রায় দশবারাে জন আমার সমবয়সী ছিলাম। ওই “শিং ভেঙে বাছুরের দলে ঢােকা” বিষয়টির চিন্তা থেকে কিছুটা স্বস্তি পেলাম৷
২০১৭-২০১৯ এই দুবছরে আমি রবীন্দ্রভারতী থেকে ওড়িশি নৃত্যে মাস্টার্স কোর্স সম্পন্ন করি৷ এই দুবছরের অভিজ্ঞতা শুধু আমার নৃত্য জীবনকে নয় আমার প্রাত্যাহিক জীবনকেও অনেক পরিণত করে তুলেছে৷ এখানে ভর্তি হওয়ার আগে নৃত্যের থিওরি সম্পর্কে আমি খুব বেশি অবগত ছিলাম না। বলাই বাহুল্য আমার ধারণা ছিল নৃত্য মানেই স্টেজে উঠে দর্শকের মন রঞ্জন করা। কিন্তু নৃত্যের যে সম্পূর্ণ আলাদা একটা জগৎ আছে। জা যুগযুগধরে সমাজের ক্রম বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে নিজস্ব কৌশলগত বিবর্তনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে সবসময় নিজ নির্দিষ্ট স্থানে নির্ধারন করে রেখেছে৷ এই ধারণা সম্পর্কে আমি অবগত হলাম এখানে আসার পর৷ নৃত্য মানেই যে শুধু দর্শকের মনােরঞ্জন করা তা নয়, তার সঙ্গে সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িয়ে আছে এর ইতিহাস। প্রাচীন হিন্দু মন্দির গাত্র গুলি তে বিভিন্ন নর্তক নর্তকীর নৃত্যের ভঙ্গিমা শুধু যে বিভিন্ন যুগের নৃত্য গীতি শিল্প সস্কৃতি এর সাক্ষ্য বহন করে তা নয় তা ভারতের ভাস্কর্যের অপূর্ব এক নিদর্শন হয়ে আছে। সত্যি বলতে কি শাস্ত্রীয় নৃত্যের শিল্পী হিসেবে পরিচয় দেওয়ার পূর্বে আমার মনে প্রতেকেরেই বােধ হয় নাট্য শাস্ত্র , অভিনয় দর্পণ প্রভৃতি গ্রন্থগুলাে সম্পর্কে কিছুটা ধারণা থাকা প্রয়ােজন৷
নির্দ্বিধায় স্বীকার করতেই হয় কলেজ জীবনের এই দুবছরের অভিজ্ঞতা নানা মজাদার ঘটনায় পরিপূর্ণ। বসন্ত উৎসব থেকে শুরু করে পঁচিশে বৈশাখ কিংবা শারােৎসব কলেজে প্রায় সন্ধে পর্যন্ত রিহার্সাল যােগদান করা বা কলেজ কান্টিনে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া আবার পরীক্ষার সময় বন্ধুদের সাথে নানা আলােচনা করা প্রভৃতি ঘটনা গুলাে আমার কাছে চির সবুজ। মাঝে মাঝে মনে হয় যদি সেই দিনগুলােকে আবার ফিরে পেতাম।
শিল্প বলতে যদি বােঝায় শিল্পের সাধনা করা তাহলে আমি একজন নৃত্য শিল্পী হিসেবে আমি এখনও নৃত্যের সাধনা করে যাচ্ছি৷ একজন সম্পূর্ণ রূপ সংসারী মানুষ হয়ে স্বাভাবিক ভাবেই এই সাধনার পথে অনেক বাধার সঙ্গে
যুঝে সফলতার স্বাদ পাওয়া সম্ভব নয়৷ সর্বোপরি নির্দ্বিধায় স্বীকার করতেই হবে নৃত্য প্রাত্যাহিক জীবনের অঙ্গ জা বাদ দিলে আমি অস্তিত্ব হীন৷