সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে মৌসুমী নন্দী (যাপন চিত্র পর্ব ৬)

বুদ্ধ বনাম লাফিং বুদ্ধ

বিকালের নক্ষত্রের কাছে আমরা সবাই আজো ঋণী ৷শাশ্বত রাত্রির বুকচিরে ক্লান্ত মানুষের মনে নিজের আদলে কল্পনায় তৈরী করে কত শত ভাস্কর্য ৷ যদি আমাদের সকলের কাছে থাকতো একটা আঁতুড়ঘর যেখানে মাত্রা ঠিক রাখার কোনো দায়িত্ব থাকতো না বা কিছু ভুল হলে ডিলিট করে বা মুছে ফেলে আবার নতুন করে লেখা যেতো তাহলে হয়তো এই দুই হাজার বিশ সালটাকে সবাই মুছে ফেলে নতুন করে সাজাতো সুখ সমৃদ্ধিতে ৷ এইবছরটা তো প্রায় শেষের দিকেই কিন্তু এইবছরটা আমাদের প্রত্যেকের জীবনেই আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছে ৷ আমরা হারিয়েওছি অনেক প্রিয় মানুষদের ৷ অনেকে রুজিরোজগারের জালে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছেন ৷ কেউ কেউ মানসিক হতাশায় ভুগছেন ৷ জানি না আগামী বছর আমাদের জন্য কি নিয়ে আসবে ! প্রার্থনা করি আগামী বছর আমাদের সকলের জন্য সুখসমৃদ্ধি নিয়ে আসুক ৷
লকডাউন আর করোনা অতিমারীর কারনে ডিপ্রেশনের চরম সীমায় পৌঁছে আমার ছেলের বায়নাতে যদিও অনেকবার গেছি তবুও আবার একবার চলে গেলাম শৈলশহরের রাণী দার্জিলিং ৷ যাবার পথে বুদ্ধ মনাস্ট্রি দেখে ছেলে বলল মা এখানে লাফিং বুদ্ধ থাকেন ৷ ব্যাপারটা বুঝিয়ে উঠতে কিছু সময় লাগলেও একসময় বুঝাতে সক্ষম হলাম লাফিং বুদ্ধ ও গৌতম বুদ্ধ দুই জন আলাদা ব্যক্তি ৷ ওর মতো হয়তো অনেকেই একই ভুল করেন তাদের জন্যই আমার এইবারের উপস্হাপন ৷
আমরা অনেকেই চীনের বৌদ্ধ ভিক্ষু লাফিং বুদ্ধকে মহামানব গৌতম বুদ্ধ ভেবে ভুল করি। তাই আসুন মহামানব বুদ্ধ সম্পর্কে বিকৃত জ্ঞান পরিহার করতে লাফিং বুদ্ধ সম্পর্কে জেনে নিই।
চীনে মহামানব বুদ্ধের ধর্ম প্রচারিত হওয়ার পর দক্ষিণ ভারতীয় বৌদ্ধ ভিক্ষু বোধিধর্মের নিকট হতে চীনা বৌদ্ধ ভিক্ষুরা ধ্যান (চীনা ভাষায় চান) শিক্ষা লাভ করেন। সেসময় চীন ভিয়েতনাম কোরিয়া হয়ে বৌদ্ধধর্ম প্রচারিত হয়েছিল জাপানেও।
আনুমানিক দশম শতাব্দীতে চীনে একজন চান সন্ন্যাসী বা বৌদ্ধ ভিক্ষু ছিলেন, নাম “কেইশি”। তিনি মূলত চীনের জেইজিয়াং প্রদেশের উত্তরে অবস্থিত “ ফেঙা” শহরের বাসিন্দা ছিলেন। চীনের লোকাচার মতে জানা যায়, কেইশি বেশ স্থূলকায় ও মুণ্ডিত মস্তকের ছিলেন। তার ছিল থলথলে ভুঁড়ি আর স্ফিত কান। লম্বা ঢিলেঢোলা পোশাক পড়তেন। গলায় জপমালা। কাঁধে সব সময় থাকত একটা কাপড়ের ব্যাগ আর হাতে একটা হাতপাখা রাখতেন। এই ধ্যান বা চান সন্ন্যাসীকেই চীনে বুদাই বা পুতাই, ভিয়েতনামে বোডাই, জাপানে হোতেই নামে ডাকা হয়। পশ্চিমা বিশ্বে তিনি “ লাফিং বুদ্ধ ” বা “মোটা বুদ্ধ নামে পরিচিত।
অনেকে এই লাফিং বুদ্ধকে গৌতম বুদ্ধ বলে মনে করেন। গৌতম বুদ্ধ ছিলেন খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দীর মানুষ; যেখানে লাফিং বুদ্ধ ছিলেন দশম শতাব্দীর মানুষ। গৌতম বুদ্ধ ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের মানুষ ও বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক অন্যদিকে লাফিং বুদ্ধ ছিলেন চীনা বংশোদ্ভূত বুদ্ধ শিষ্য বা ধ্যানী সন্যাসী। আশা করি এখন আর কেউ লাফিং বুদ্ধকে মহামানব গৌতম বুদ্ধের ভিন্নরূপ ভেবে ভুল করবেন না।
এক অদ্ভুত স্বভাবের সন্ন্যাসী এই লাফিং বুদ্ধ চীনের বিভিন্ন গ্রামে ঘুরে বেড়াতেন। তার কাঁধের ঝোলা সব সময় খাবার, পানিয় বা কোন না কোন উপহারে ভর্তি থাকত। সেখান থেকে তিনি ছোট ছেলে মেয়েদের বিভিন্ন সময় বিভিন্ন কিছু দিতেন। তাকে দেখলেই ছোট ছেলেমেয়েরা তার পেছনে পেছনে ঘুরত, তাকে ঘিরে থাকত। তার বিভিন্ন মূর্তিতে তার সাথে ছোট ছেলেমেয়েদেরও দেখা যায়।
তার আরেকটি অদ্ভুত বৈশিষ্ট হল, তিনি বিভিন্ন গ্রামে গিয়ে যে কোন এক জায়গায় দাঁড়িয়ে একাই হাসা শুরু করতেন। তার হাসি এত ছোঁয়াচের মত ছিল যে, তার সাথে সাথে একে একে সবাই হাসতে শুরু করত কিছু না ভেবেই। সারা গ্রাম হাসত এই বৌদ্ধ ভিক্ষুর সাথে। হাসি শেষে গ্রামের মানুষ দেখত, তাদের অনেক হালকা লাগছে। কষ্ট কমে গেছে। গ্রামের মানুষ আগ্রহ নিয়ে তাঁর আসার অপেক্ষায় থাকত। তিনি আবার তেমন কথা বলতেন না, কিন্তু তিনি বুদ্ধের বানী এক নাগাড়ে মুখস্থ বলতে পারতেন।
চীন-জাপানের লোকাচারে তার একটি অদ্ভুত স্বভাবের কথা কথিত আছে যে, তিনি নির্ভুলভাবে যে কারও সম্পর্কে ভাগ্য গণনা করতে পারতেন। তবে যারা নাকি সত্য জানতে চাইত না, তাদের তিনি কিছু বলতেন না। লোকাচার মতে, তাঁকে সৌভাগ্যের দেবতা মনে করা হয়। তাই বিভিন্ন মন্দির, রেস্টুরেন্ট ও বাড়িতে তাই তাঁর ছবি দেখা যায়। ধর্মীয় বিশ্বাস নয়, তবে লোকাচার মতে মনে করা হয়, লাফিং বুদ্ধের এর পেটে হাত ঘষলে সুখ, অর্থ আর সমৃদ্ধি আসে।
বৌদ্ধ ভিক্ষু অত্যন্ত সবল মানুষ ছিলেন, এত হাসতে পারতেন, তবু ও ক্লান্ত হতেন না। শোনা যায়, তিনি ঘুমের মাঝে ও হাসতেন। হাসি তার প্রাকৃতিক স্বভাবের মতই ছিল। তিনি কোন কৌতুক বা অন্য এর ওপর হাসতেন না। তিনি নিজের ওপর হাসতেন। তার কোন নিজস্ব মতবাদ, আদর্শ, দর্শন ছিল না। তাকে ধর্ম, দর্শন, জ্ঞান নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ও তিনি শুধুই হাসতেন। হাসিতেই তিনি সবার মন জয় করে নিতেন, দুঃখ ভুলিয়ে দিতেন। মূলত হাসিতে দুঃখ জয় করাই ছিল লাফিং বুদ্ধের দর্শন।
আসুন আমরা সবাই আগামী ২০২১ যাতে আমাদের সকলের জীবনে সুখ সমৃদ্ধি নিয়ে আসে তারজন্য লাফিং বুদ্ধের শরণাগত হয় ৷ বাড়ীতে নিয়ে আসি হাস্যরত বুদ্ধের ভিন্নরূপ বা প্রতিকৃতি ৷ কথায় আছে বিশ্বাসে মেলায় বস্তু তর্কে বহুদূর ৷ আজ এই পর্যন্তই ৷ সকলে খুব খুব ভালো থাকবেন ৷ আবার আসব আপনাদের সামনে অন্য কোনো উপস্হাপন নিয়ে ৷
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।