এক নৃত্য শিল্পীর স্মৃতিচারণ – পৌলামী ব্যানার্জী – ৪

পেশা আর নেশা দুটোই একই; নৃত্য শিল্প। গুরুমা হিসেবে পেয়েছিলেন মমতাশঙ্করকে। ছোটদের জন্য গড়ে তুলেছেন নৃত্য শিক্ষার একটি স্কুল। ওঁর শিল্পী জীবনের গল্প বলার জন্য এই প্রথম হাতে তুলে নিয়েছেন কলম।

পর্ব – ৪

দীপান্বিতা দির কাছে আমি ২ বছর নৃত্য শিক্ষা লাভ করি। এরপর ১৯ বছর বয়সে অনার্স পড়ার সময় আমার বিবাহ সম্পন্ন হয়। আমার স্বামী ব্যবসায়ী হওয়া সত্বেও ‘ গীতবিতান ‘ থেকে রবীন্দ্র সঙ্গীত নিয়ে প্রচলিত পাঁচ বছরের কোর্সটি সম্পন্ন করেন। সুতরাং মধ্যবিত্ত পারিবারিক রীতি অনুযায়ী আমার নৃত্য সম্পর্কে খুব একটা বাধা আমার শশুর বাড়িতে ছিল না। পার্ট- 1 পরীক্ষার আগেই আমি বিয়ের পিড়িতে বসে ছিলাম।
উইএকরাশ স্বপ্ন কে বাস্তবায়িত করার জন্য যে উদ্যম চেষ্টার প্রয়োজন থাকে সেই উপলব্ধিটা আমি সেই বয়সে করতে পারিনি। আমার বাবা মা যেভাবে আমার পিছনে ঠেলাগাড়ি এর মতো লেগে থেকেছিল আমার ধারণা ছিল সেই ভাবেই বোধ হয় আমি সারাজীবন নির্বিঘ্নে পথ চলতে পারবো। বাস্তব জগৎ কেন তা মেনে নেবে বলুন তো ?সফল তরে আসল চাবি কাঠি সংগ্রামের মধ্যেই লুকিয়ে থাকে। এই চরম সত্য টা বুঝতে আমার অনেক দেরি হয়েগেছিল। আমার নাচের ব্যাপারে আমার শাশুরি মা, ভাসুর, ননদ, জা, সর্বোপরি আমার স্বামী সবাই এর সমর্থন ছিল। কিন্তু তথাকথিত জয়েন্ট ফ্যামিলি তে সাধারণ গৃহবধূর নিত্য প্রয়োজনীয় কাজ গুলি সম্পন্ন করে নাচ প্র্যাকটিসের সময়টা কোথাও একটা আমার জীবন থেকে হারিয়ে যাচ্ছিল। নাহ্ অভিযোগ নয় শৈশব থেকে নাচটা আমার প্রাত্যাহিক জীবনের যে এক অঙ্গ সেটা বোধ হয় আমি ভুলে গিয়েছিলাম।
যাই হোক দুবছরের মধ্যে আমি রাষ্ট্র বিজ্ঞানে অনার্স সম্পন্ন করি। এর সঙ্গে জীবনের সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ পাওয়া (মাতৃত্বের স্বাদ) লাভ করি। হ্যাঁ আমি ২০০৩ সালের মধ্যে আমার একটি কন্যা সন্তান ও একটি পুত্র সন্তান হয়। তারপরের বছর গুলি ওদের দুটোকে মানুষ করার জন্য লেগে থাকি। এক বছরের ছোটো বড় হওয়ার দরুন ওদেরকে সামলানো কিছুটা কষ্টকর হয়েছিল। কিন্তু ব্যাপার বাড়ি কাছে হওয়ার সুবাদে সেই কষ্ট অনেক টাই লাঘব হয়েছিলো।
যাই হোক এরপর প্রায় দশ বছর সম্পূর্ণ রূপ আমি নাচ থেকে বিরত ছিলাম। এই দিনগুলো আমার কাছে খুব কষ্টকর ছিল। যখনই টিভি তে কোনো নাচের অনুষ্ঠান অথবা কোনো ফাংশনে নাচের অনুষ্ঠান তখনই ভিতর থেকে একটা কান্না বেরিয়ে আসতে চাইতো। আবার মনে মনে সামনে দৃশ্যমান নৃত্যশিল্পীর কতো সমালোচনা করতাম। আর ভাবতাম এর থেকে যদি আমি নাচতে পারতাম তাহলে বোধহয় পারফরমেন্স টা আরো ভালো হতো। এমনও দিন গেছে যখন আমি টিভি দেখা ছেড়ে বাথরুমে গিয়ে কল খুলে কেঁদেছি । এই সব কান্নার তখন একটাই সান্ত্বনা ছিল আমার ছেলে মেয়ে।
কিন্তু জানেন তো আমার জীবনের অভিজ্ঞতা বলে আপনি মন থেকে কিছু চান তাহলে দেরি হলেও আপনার জীবনে তা ফিরে আসবে। আমার কাছেও সেই সুযোগ এলো। আমার ছেলে কেয়ে তখন এক স্থানীয় নার্সারি স্কুলে 3 আর 4 তে পড়ে। একদিন স্কুল থেকে ওদেরকে নিয়ে আসার সময় হঠাৎই স্কুলের কমিটির সভাপতি আমাকে দেখা করতে বলেন। নির্ধারিত দিনে যথা সময়ে আমি স্কুলের অফিস ঘরে উপস্থিত হই। এখানে বলে রাখা প্রয়োজন স্কুল কমিটির সকলেই আমার পরিবারের পূর্ব পরিচিত এবং তারা সবাই আমাকে ছোটো থেকে ভালোভাবে চিনতো। তা যাই হোক আমি যেতেই উনি সর্বপ্রথম আমাকে প্রশ্ন করেন – ‘ তুমি কি নাচ এখন একদমই করছো না ?’ আমি উত্তর দিই- ‘ ছেলেমেয়ে ছোটো থাকার জন্য আর আগের মতো প্র্যাক্টিস হয় না । ‘ এরপর উনি বললেন – ‘ না আমি ভাবছিলাম আমাদের স্কুলের প্রতি দিনের রুটিন এ একদিন করে নাচের একটা ক্লাস রাখবো। তা তুমি কি নাচের ক্লাসটা নিতে পারবে ?’ আমি তো শুনে হতবাক। না করার তো কোনো কারণই হয় না। ওই তো I-IV অবধি ছোটো ছেলে মেয়ে দের প্রতিদিন একটি করে নাচের ক্লাস নেওয়া, এটাতো কোনো ব্যাপারই না ।
বাড়িতে আলোচনা করে পরের ক্লাস থেকে স্কুলে জয়েন করলাম। নাহ্ কাজটা যতটা সহজ ভেবেছিলাম ততটা নয় । চল্লিশ – পঞ্চাশটা বাচ্চাকে চল্লিশ মিনিট ধরে ক্লাস করানো যে কতটা কষ্টকর সেটা বলাই বাহুল্য। কিন্তু একরাশ রাগ নিয়েও আমার বেশ ভালো লাগছিলো। আস্তে আস্তে নিজের জীবনের একঘেয়েমি টাও কিছুটা কেটে যাচ্ছিল। এইভাবে সাত থেকে আট মাস ক্লাস করিয়ে স্কুলে বার্ষিক অনুষ্ঠানের দিনটা উপস্থিত হয়। ওই দিনটা আমার কাছে উল্লেখযোগ্য দিন।
সেই দিন হাওড়া ‘ শরৎ সদন ‘ এ আমার নৃত্য নির্দেশনায় প্রায় চল্লিশ থেকে পঞ্চাশটি ছেলে মেয়েকে নিয়ে অনুষ্ঠিত হয় রবীন্দ্রনাথের ‘ বীরপুরুষ ‘ কবিতা অবলম্বনে ‘ বীরপুরুষ ‘ নৃত্যনাট্যটি । আমি আজও ভুলতে পারি না সেই ক্ষণটিকে যখন নৃত্যনাট্য টা শেষ হওয়ার পর সমগ্র হলটি করতালিতে ভরে উঠছিলো। স্কুলের কমিটিবর্গের , শিক্ষিকাগণের, অভিভাবক গণের অবিরত প্রশংসায় কোথাও যেন আমি আমার হারিয়ে যাওয়া মনোবলকে আবার ফিরে পেলাম। অবশ্য এই ব্যাপারে আমার স্বামীর অবদান অনস্বীকার্য।

চলবে..

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।