T3 || ১লা বৈশাখ || বিশেষ সংখ্যায় পিয়াংকী

ঈশ্বর স্থাপন এবং এক আঁচল নক্ষত্রদান

হে সর্বকালজ্ঞ,

এসো এসো শাঁখে, অবশেষে সময় এসে দাঁড়াল। তোমার জোনাকি-জন্ম। চারদিকে শোরগোল, মহল্লাবাসীদের উল্লাস। এ দুয়ার ও দুয়ারে কানাঘুঁষো। হাজারখানেক চলাচলের ভিতর থেকে সকলেই তাই গুছিয়ে তুলতে ব্যস্ত মুঠো মুঠো জুঁই। নির্ধারিত আয়ুটুকু নিয়েই সে আসছে, সামান্য ডুবুরির আশ্রয়, অথবা বিশ্রাম নেবার অছিলায় নোঙর । নৌকো গড়ার সময় হলে কেই বা বাঁচিয়ে রাখতে পেরেছে বৈভব?

একজোড়া ঘোলাটে হলুদ চোখ, আপাতত নিযুত-কোটি জন্মের ক্রেতা। এই জন্ম যার দয়ায় সে গোধূলি, রাত,ভোর, মধ্যাহ্ন,বিকেল। তার নামেই বুকের ইঞ্চিখানেক গাঢ় শীতল অন্ধকার। এক ইঞ্চির সেই অন্ধকারের তুমি কি একটা অশোক? নাকি শিবের আকন্দ? উত্তর পাই না বলেই হয়ত আরও গভীর আরও রহস্যময় হয়ে উঠছে বাগানবাড়ি।
এই তো বৈশাখ দাঁড়িয়ে, নৈবেদ্য আর পুষ্পপত্রে ভরা তার একুলওকুল। পানসুপুরিতে তেলগোলা সিঁদুরের দায়। প্রতিটি সম্পর্কই তো আসলে একটি জুঁইফুলগাছ।একটা একটা করে দিন পেরিয়ে যাবার পথে প্রতিটি ঘর বাড়িই সামান্য কিছু আয়োজনের মহড়া । তুমিই প্রকৃত সিংহপুরুষ, যোগান দিয়েছ সমস্ত উপকরণ। সংসার পাতা ভোর। বিগত দিনের চশমার কাচ মুছে এসেছ বসতবাড়ির উত্তরমূখী ঘরে। এরপর ধীরে ধীরে সেই কাচে বায়ুমন্ডল মেনে ধুলো বালি মেঘ জলীয়বাষ্প জমেছে , উনুন জ্বালার পর সেই ধোঁয়াতেই তুমি ধুয়ে নিয়েছ মায়াসংসারের সমস্ত বাসনকোসন

আজ বৈশাখে গাছগাছড়ায় ভরা ঘন আন্দোলন। ঘনিষ্ঠ মুহূর্ত যেভাবে পেঁচিয়ে থাকে ঠিক সেভাবেই আদিম শিকড়রা রাত হয়ে গেছে যৌথ-উপন্যাসে।ওখানে পৌঁছতে গেলে আদম আর ইভের উনুন লাগে, লাগে বালি লাগে মেঘ লাগে বৃষ্টি। ধনাত্মক হোক বা,ঋণাত্মক যুক্ত থাকাটাই তো জীবন। বহমানতা।চিরাচরিত প্রত্যয়। একটি ক্ষমাশীল নদী। জল বয়ে যায়। কেও ছুঁই কেও পারে বসে দেখি, না ছুঁয়েও মেপে নিই জলতল। যেভাবে সব দরজা খুলে দিয়ে হাজার দুয়ারী হ্যালুসিনেট করে দেয় যাবতীয় ইতিহাস, অভাব যেভাবে খুলে রাখে পোশাকের রঙ,তেমনি কোন এক বিকেলে চঞ্চল চড়ুইএর মতো স্পর্শ বেঁধে দেয় আমাদের যাবতীয় রক্ষণাবেক্ষণ।
কুঁজো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা একটি ছেলের গা বেয়ে এখন নদীখাত, খড়কুটো গোছানো কাঁধে জমছে সে জমিয়ে চলেছে জল, ক্রমাগত। স্পর্শ এখন ভীষণ স্পষ্ট, এখন ঠোঁটের ওপর জাতক-জাতিকার নিষ্পাপ ধর্মচুম্বন।

নিত্যনৈমিত্তিক বাড়িঘর কলতলা চিলেকোঠা সিঁড়ি আর রাত শেষ হলে বিছানায় তরলের মাপঝোপ। নদী আজকাল কৈফিয়ত চায় না,বলে না “তোমরা কবে প্রথম দেখা করেছিলে”। এখন ঘোষণা করার সময়। এখন মেয়েটির খোলাপিঠ আর কোঁকড়ানো চুলে বসতবাড়ি সাজানোর সময়। ছেলেটির হাতে উল্কি আঁকার সময়। চওড়া বুকে তাই বিছিয়ে রাখা রাস্তা। অনায়াস যাতায়াত, রাতের মায়াময়তা , এত জাগতে নেই সেটুকুও কি তুমি জানো না ? নেশা হয়। রাত আর প্রেমিকা কোন কোন দিন অকারণ সমার্থক হয়ে যায়
মহল্লায় এখন অনেক মানুষ। সারাদিন পাখির কিচিরমিচির। যা কিছু আদিম তার ওপর এই চুম্বকীয় টান। অনেকটা জিভের সাথে জিভের স্পর্শ। স্পষ্ট নয় তবু চোখ ফেড়ে দেখতে হয় কোথায় কতটা ক্ষতি হয়ে গেল। সব ক্ষতি অবশ্য নথিভুক্ত হয় না কিছু ফুলছাপ শাড়ি হয়ে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ায় সংসারের আনাচে-কানাচে…

আমি জানি, তুমি রোজ চুরি হয়ে যাও নিয়মমাফিক। আলু পটল কেনো। খুচরো পয়সার হিসেব করে ঘরে নিয়ে জমায়েত করো খাজুরাহো নৃত্য। নদীর এপারে বসে বসে গোধুলি গুনি।এক দুই তিন চার পাঁচ ছয়……..অনন্ত এ জার্নাল। শেষ হবে ভাবতে ভাবতেই পরের দিন ভোর আসে। চুপচাপ চুল বাঁধি। আঁটোসাটো করে গুছিয়ে ফেলি নতুন অভিযোগ অভিমান। “কাবেরী নদী জলে কে গো বালিকা” বললেও তুমি কি কিছু বুঝতে পারো না সম্রাট? নাকি বুঝেও আবছা হাসির আড়ালে লুকিয়ে ফেলতে চাও ঋণের খসড়া ? কতপ্রকারে বুঝিয়েছি আমার কাছে ঋণ কিছু নেই তোমার, এ আমাদের একত্রীকরণ বৈ কিচ্ছু নয়।

দূরে বসে আছে যে তার দু’চোখে বিবাহ পূর্ববর্তী আয়োজন। তাকাও। দেখো তার গায়ে লাল তসর ঘন কাজল চোখে আদিম এক পুরুষের খোঁজ। আঁচিল ক্ষনস্থায়ী আর তিল জন্মগত। আর্যপুত্র তোমার টিকালো নাক, বুকের খাদ, ঈশ্বরের মতো চরণ, গভীর নাভি, শিল্পী-আঙুল আর দুই ভুরুতে উপশম। যে রাস্তা খুঁড়ে আমার নামে রোজ পুঁতে রাখো হ্যারিকেন, এই দেখো তার আলোতেই এখন তাম্রবর্ণ চাঁদ। নাভিশ্বাস উঠে আসছে সম্রাট। যা বলা যায়নি উপাদানহীন সেসব প্রলাপকেও তুমি জল বাতাস দিয়েছ দু’বেলা। তুমি ব্যাতিক্রমী একদিন যাকে বৃক্ষ বলে পুজো দিয়ে শুরু করেছিলাম এ অনন্ত যাত্রায় আজ সেইই নিজের জাদুবলে রাজাধিরাজ।

… হে জাতক, বৈশাখের এ প্রথম ভোরে তোমাকে স্থাপন করলাম চন্দনগন্ধে সিংহাসনে। এবার কি তবে চরণ ছুঁয়ে প্রণাম করবার অধিকার পেতে পারে সে?

ইতি
সামান্য এক মেয়ে

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।