সাপ্তাহিক ধারাবাহিক কথা সাগরে নীলম সামন্ত (পর্ব – ৪)

মহাভারতের মহা-নির্মাণ (সত্যবতী পর্ব ২)

 

এরপরের অংশে দেখা যাচ্ছে নিয়মকানুন মেনে সত্যবতী ও শান্তনুর বিবাহ হল। তারপর তাদের দুটি পুত্র সন্তানের জন্ম হয়। চিত্রাঙ্গদ ও বিচিত্রবীর্য। কনিষ্ঠ পুত্র বিচিত্রবীর্যের যৌবনলাভের আগেই শান্তনুর মৃত্যু হয়। ভীষ্ম সত্যবতীর মতানুসারে চিত্রাঙ্গদকে রাজ পদে প্রতিষ্ঠিত করে। কিন্তু সত্যবতীর এই সন্তান রাজপদে অভিষিক্ত হলেও বেশিদিন টিকতে পারেনি। গন্ধর্বরাজের সঙ্গে যুদ্ধ চলাকালে চিত্রাঙ্গদ নিহত হয়। আসলে চিত্রাঙ্গদ অত্যন্ত বলবান এবং অহংকারীও ছিলেন। নিজেকে এত শক্তিশালী এবং বুদ্ধিমান মনে করতেন বাকি সকলকে তার নগন্য মনে হত। সে কারণে গন্ধর্বরাজ একদিন তাকে বললেন “সবাইকে নিকৃষ্ট ভাবো, আমার নাম আর তোমার নাম এক। তুমিও চিত্রাঙ্গদ আমিও চিত্রাঙ্গদ। আমার সাথে যুদ্ধ কর দেখি কে জয়ী হয়।” অহংকার মানুষের পতনের কারণ। চিত্রাঙ্গদ এই বচনের বাইরে বের হতে পারেননি। সত্যবতী নিজের সন্তানকে খুব ভালোভাবেই চিনতেন। তাই তিনি ভাবতেন তার পুত্রকে যদি কোন দক্ষ শাসক চলো না না করেন তবে তার রাজত্ব অকালেই বিপথে যাবে। আর এও ভালো ভাবে জানতেন দেবব্রত তথা ভীষ্ম’র মতো সুচারু, বুদ্ধিমান, দূরদর্শিতার সম্পন্ন ব্যক্তি ছাড়া এই রাজ্য পরিচালনা করা সম্ভব নয়। তাই পেছন থেকে রাজ্য পরিচালনা করার ভার তিনি তাঁর হাতেই দিলেন। তবে চিত্রাঙ্গদের ফুরিয়ে যাওয়া আটকাতে পারেননি৷ এই হয়তো তাঁর নিয়তি ছিল। নইলে বাকি মহাভারত কিভাবেই বা রচনা হত?

ভীষ্ম’র কথাতেই চিত্রাঙ্গদের মৃত্যুর পর কনিষ্ঠ সন্তান বিচিত্রবীর্যকে সিংহাসনে বসান কিন্তু তখন তার বয়স অত্যন্ত কম ছিল তাই বলা যায় বিচিত্রবীর্যকে পুতুল-মুখ হিসেবে সামনে রেখে রাজ্য পরিচালনা ভীষ্মই করতেন।

এ এক অদ্ভুত বিচার। সত্যবতীর বিচার। বিবাহের মুহূর্ত থেকেই তিনি ভীষ্মকে এক প্রকার পঙ্গু করে রেখে দিলেন। নানান শব্দ দিয়ে তার জীবনের সুখ স্বাচ্ছন্দ ভোগ বিলাস সবই কেড়ে নিলেন বলতে গেলে অকারণ সংসার সন্ন্যাসী হতে বাধ্য করলেন অথচ যখন দেখলেন তাঁর সন্তানরা অপারগ তখন সিংহাসনের স্বার্থে তাকে ব্যবহার করতে একটুও কুণ্ঠা বোধ করেননি। আবার ভীষ্মর কথাই ভাবি। তিনি কেনইবা সত্যবতীর কথা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতেন শুধু কি তাঁর বাবাকে খুশি রাখতে চেয়েছিলেন বলে এবং হস্তিনাপুরের সুচিন্তক হিসেবে নাকি অন্য কিছু? যে মোহিনীমায়ায় শান্তনু ধরা পড়েছিলেন সেই একই জালে ভীষ্মও কি ফেঁসে গিয়েছিলেন? এসব মহাকাব্য লেখা নেই আমার মনে হওয়া প্রশ্ন মাত্র। যার উত্তর ও অজানা।

সিংহাসনে উপনীত হওয়ার বেশ কিছু বছর পর বিচিত্রবীর্যর বিবাহ পরিকল্পনা করা হয়। সেহেতু সত্যবতীর অনুরোধে স্বয়ংবর থেকে ভীষ্ম জিতে আনলেন কাশিরাজ কন্যাদ্বয়কে। অম্বিকা ও অম্বালিকা। এই বিবাহের সুখ বেশিদিন ভোগ করেনি হস্তিনাপুর সিংহাসন তথা রাজ পরিবার। বিয়ের প্রায় সাত বছর পরেই বিচিত্রবীর্য যক্ষা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। এক অদ্ভুত সর্বহারা সময়ের মধ্যে সত্যবতী ফেঁসে যান। মহাকাব্যের বর্ণনা অনুযায়ী জানতে পারি তাঁর স্বামী শান্তনুর মৃত্যুর পর তিনি যতখানি ভেঙ্গে পড়েছিলেন তার থেকে অনেক বেশি অসহায় হয়ে পড়েছিলেন দুই পুত্রের মৃত্যুর পর কারণ ছোটপুত্রের মৃত্যুর আগে কোন পুত্রবধুই সন্তানসম্ভবা বা সন্তান প্রসব করেননি। সত্যবতীর বাবা যে কূটকৌশল প্রয়োগ করে সত্যবতী ও শান্তনুর বংশধর রাজ সিংহাসনে বিরাজ করার ব্যবস্থা করেছিলেন তা ব্যর্থ হয়েছিল। এই অবস্থায় সত্যবতী সমস্যার সমাধান করতে অর্থাৎ সিংহাসনের জন্য বংশধর আনতে ভীষ্মরই শরণাপন্ন হন। তিনি প্রথমে ভীষ্মকে অনুরোধ করেন বিয়ে করে সিংহাসনে উপনীত হতে অথবা তাঁর দুই পুত্রবধূ অম্বিকা ও অম্বালিকার গর্ভে সন্তান দান করতে। ভীষ্ম তাঁর প্রতিজ্ঞার কথা মনে করিয়ে দেন। তিনি অনড়। উপায় না পেয়ে সত্যবতী ভীষ্মকে তাঁর প্রথম পুত্র ব্যাসদেবের কথা বলেন। অনুরোধ করলে ব্যাসদেবই তাঁর ভ্রাতৃবধূদের গর্ভে সন্তান উৎপাদন করতে পারবেন।

ব্যাসদেবের ডাক পড়ল। ব্যাসদেব এই প্রস্তাবে রাজি হলে সত্যবতী প্রথমে তাঁকে বিচিত্রবীর্যের জ্যেষ্ঠা পত্নী অম্বিকার কাছে পাঠালেন। অম্বিকা ব্যাসদেবের কৃষ্ণ বর্ণ, আগুনের মতো বহ্নিমান চোখ এবং জটাজুট দেখে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। ব্যাসদেব ঘর থেকে বেরিয়ে এসে সত্যবতীকে জানালেন, অম্বিকার এক মহাবলবান, বিদ্বান ও বুদ্ধিমান পুত্র হবে। কিন্তু যেহেতু ব্যাসকে দেখে অম্বিকা চোখ বন্ধ করে ফেলেছিলেন, সেহেতু সেই পুত্র অন্ধ হবে। যথাকালে অম্বিকার গর্ভে ধৃতরাষ্ট্রের জন্ম হয়। এরপর বিচিত্রবীর্যের দ্বিতীয়া স্ত্রী অম্বালিকার পালা। তিনি ব্যাসের ভীতিপ্রদ রূপ দেখে পাণ্ডুবর্ণ ধারণ করেন। এই কারণে তাঁর পুত্র পাণ্ডুবর্ণ নিয়ে জন্মায়। তবে ব্যাস এ কথাও বলেছিলেন যে, ধৃতরাষ্ট্র শতপুত্রের এবং পাণ্ডু মহা গুণবান পঞ্চপুত্রের পিতা হবেন। দুই পুত্র ত্রুটিযুক্ত হওয়ায় সত্যবতী অম্বিকাকে আবার ব্যাসদেবের কাছে পাঠান। কিন্তু অম্বিকা নিজে না গিয়ে এক রূপবতী দাসীকে পাঠালেন। সেই দাসীর পরিচর্যায় তুষ্ট হয়ে ব্যাসদেব তাঁকে জানান যে, তাঁর গর্ভস্থ পুত্র ধর্মাত্মা এবং পরম বুদ্ধিমান হবে। সেই দাসীর গর্ভে বিদুর জন্মগ্রহণ করেন।

রাজমাতা হয়ে রাজ্যের ভার নিলেও শেষপর্যন্ত তার বংশরক্ষা এবং রাজ্য কোনোটাই সঠিকরূপ পায়নি। কারণ সিংহাসনে শান্তনু ও সত্যবতীর কেউ বসলেন না। যিনি বসলেন তিনি ব্যাসদেবের সন্তান। এদিক থেকে সত্যবতীও ভাগ্যবিড়ম্বিত। কারণ যাকে আশ্রয় করে সিংহাসন রক্ষা করতে গেছেন, সেই তাঁকে ছেড়ে পরপারে চলে গেছে।চিত্রাঙ্গদ, বিচিত্রবীর্যের মৃত্যু তাকে স্থবির করে দেয় কিন্তু তারপরও ধৃতরাষ্ট্র, পাণ্ডুর প্রতি তার অগাধ ভালোবাসা নিয়ে নতুনভাবে হস্তিনাপুরের স্বপ্ন দেখতে শুরু করে। তবে ধৃতরাষ্ট্র জন্মান্ধ, ঋষির অভিশাপে পাণ্ডুর মৃত্যু হয়। আর সত্যবতীর ভাগ্যে যুক্ত হয় আরও একটি কালো অধ্যায়। বংশরক্ষায় যে বীজ তিনি বুনেছেন একদিন, তা কৌরব ও পাণ্ডব ভাগ হয়ে মহাভারতের মহাযুদ্ধের ঘোষণা করে। সত্যবতীর অগ্রযাত্রা অশুভের বিরুদ্ধে হলেও কোথাও চরিত্রটির স্বাভাবিকভাবে জীবনযাপনের চিত্র পাওয়া যায়নি। শান্তনুর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সত্যবতীর জীবনে শুরু হয় হস্তিনাপুর রাজ্যকে রক্ষার দায় কিন্তু শেষপর্যন্ত সত্যবতী ভীষ্ম কেউই সংঘর্ষ এড়িয়ে যেতে পারেনি। তাই সত্যবতীকেও ভাগ্যবিড়ম্বিত হিসেবেই উপস্থাপন করেছেন কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন।

এই সমস্ত ঘটনা হেতু বারবার প্রমাণ হয় সত্যবতীর দূরদর্শিতা এবং বুদ্ধিমত্তা। তিনি কোন পর্যায়েই আবেগে ভেসে যায়নি। প্রয়োজনে অবৈধতাকেউ বৈধ রূপ দিয়েছেন। তাঁকে সুবিধাবাদীও বলা যায়। খুব ভুল বলছি কি? ভেবে দেখুন নিজের স্বপ্ন পূরণ করতে নিজের সুবিধার্থে ভীষ্মকে ব্রহ্মচর্যের প্রতিজ্ঞা করালেন আবার তাকে যথেচ্ছ ব্যবহার করলেন এমনকি নিজের প্রয়োজনে প্রতিজ্ঞা ত্যাগের কথাও বললেন। তার স্বপ্ন ব্যর্থ হলেও তাঁর লোভ দুর্ভাগ্যের নৌকায় ভেসে গেলেও রাজ্যের প্রতি, সিংহাসনের প্রতি তাঁর দায় তিনি ভোলেননি। সঠিক সময়ে ব্যাসদেবকেউ কাজে লাগিয়ে ফেললেন। ব্যাসদেবও কাকের বাসায় কোকিলের ডিম পাড়ার মতো সন্তান দিলেন। সত্যবতী নিজের প্রয়োজনে যখন যাকে যেমনভাবে পেরেছেন সেভাবেই ব্যবহার করেছেন। তবে এতে কার কতটা ক্ষতি হয়েছে সেই বিচার না করেও একটা জিনিস স্পষ্ট, সিংহাসনের কথা তিনি ভেবেছেন, রাজ্যের কথা তিনি ভেবেছেন। রাজ্যবাসীকে তিনি অপারগ কারোর হাতে তুলে দিতে চাননি। অতএব বলা যায় স্বার্থপর হলেও তিনি যথার্থ রাজমাতা। যথার্থ বলছি তার একটা বিশেষ কারণও দেখুন, ব্যাসদেবের পুত্র হিসেবে জন্মগ্রহণ করলেও ধৃতরাষ্ট্র পান্ডু বিদুর এরা বিচিত্রবীর্যের সন্তান হিসেবেই বড় হলেন। যে কারণে পরবর্তীকালে সিংহাসন বিনা সমস্যায় রাজা পেয়েছে।

তবে রাজমাতা হলেও সত্যবতীর শেষ জীবন তাঁর জ্যেষ্ঠপুত্র ব্যাসদেবের পরামর্শে সন্নাস জীবনে সাধনা করে কাটে। কারণ ব্যাসদেব জানতেন কুরুক্ষেত্রের এই লড়াইয়ের ফলস্বরূপ ভাইয়ে ভাইয়ে যুদ্ধ, প্রাণনাশ, আসলে তো সত্যবতীরই আপনজনের ক্ষয়। জীবনের আর কত ক্ষয় তিনি সহ্য করবেন? নিজের মায়ের মানসিক শান্তিপূর্ণ জীবন কামনা করেই ব্যাসদেব মা কে অরন্যের মাঝে এক কুটিরে নিয়ে যান৷ ও সাধনায় মনোনিবেশ করতে বললেন। ধীরে ধীরে সত্যবতীও সংসারের মায়া ত্যাগ করলেন৷ ওই সাধনার মধ্যেই নিজেকে ভালো রাখায় মনোনিবেশ করলেন।

এতখানি জানার পর কি মনে হচ্ছে জানেন? সত্যবতীকে এমন কিছু গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র হিসেবে কৃষ্ণ দ্বৈপায়ন না দেখালেও সত্যবতী ও তার বাবার সিদ্ধান্তের কারণেই হস্তিনাপুরের বাকি পরিনতি৷ তাই বলা যায় মহাভারতকে একটি বিশালাকার নৌকা ভেবে নিলে সত্যবতী অন্যতম বৈঠা। তাঁর এরূপ সিদ্ধান্ত ছাড়া মহাভারত কি আজকের এই মহাভারত হত? তাই মহাভারত যদি একটা মালা হত। তবে সত্যবতী অতিপ্রয়োজনীয় একটি পুঁতি কিংবা মালার ধারক যাকে ছিঁড়ে বাদ দিতে গেলে বাকি মালাটাই সুতো ছেঁড়া হয়ে ছড়িয়ে যাবে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।