।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় নন্দিনী চট্টোপাধ্যায়

গন্ধ

বিরে মণ্ডলের একখানা ছোট্ট মুরগি খামার আছে । ওই খামারখানাই তার জান প্রাণ । মোরগ মুরগি গুলোকে সে তার নিজের চাইতেও বেশি ভালবাসে । ওরা ছাড়া তিনকুলে আছে কে তার ? বছর পাঁচেক আগে মাটা মরেছে। এদিকে বিয়ে থাও করে নি বিরে , বা বলা ভাল যে তাকেই কেউ বিয়ে করতে কস্মিনকালে রাজি হয়নি । পাত্রীই জুটল না তার কপালে।আর জুটবেই বা কিকরে ? বিরের নামে বাজারে যে সব কথা ঘুরে বেড়ায় সেইসব শুনে কোন মেয়েই বিরেকে বিয়ে করতে রাজি হ্য় না ।লোকে বলে বিরে মানুষ তো নয় , বিরে নিজেই হল গিয়ে একখানা ঢাউস মোরগা । সারাক্ষন একা একাই ককর ককর করছে , মুরগি নিয়ে ঘাঁটছে , খুঁটে খুঁটে ডিম তুলে জাল কৌটোয় রাখছে আর বাজারে সেই ডিম বেচে দেদার কামাচ্ছে । বাড়িতে এত ডিম কিন্তু বিরে তার হাড় কেপ্পন স্বভাবের জন্য কক্ষনো একখানা ডিমও মুখে তোলে না ।একবেলা দুটো নিরিমিস্যি ফুটিয়ে নেয় আর রাতের বেলা মুড়ি চিবিয়ে দিব্যি কাটিয়ে দেয় ।ওদিকে আবার সাত জন্মে চান করে না । সাবান খরচের ভয়ে জামা কাপড় কাচে না ।গা থেকে উৎকট দুর্গন্ধ বেরোয় । মুরগি আর কুকুর ছাড়া তার কাছে কেউ ঘেঁষে না ।তা এহেন বিরেকে কোন ভালোমানুষের মেয়ে বিয়ে করতে রাজি হবে ?
তাই বিরে একেবারে একা। সে এ গাঁয়ের কাউকে পছন্দ করে না আর তাকেও কেউ চায়না। সে আর তার সাধের মুরগিগুলো , এই নিয়েই তার সুখ দুখখের সংসার ।নানান নামে সে মুরগিদের ডাকে । দয়া মায়া আহ্লাদী সুখী সোহাগী আদুরি ছুটকি লাল মণি নীল মণি এমনি সব নাম দিয়েছে সে মুরগিদের আর দুখানা মোরগেরও দুখানা জবরদস্ত নাম দিয়েছে সে — মনের মানুষ আর চিন্তারাম ।কেউ যদি কখনও বলে—-অ ভাই বিরে মুরগিদের নাম নয় বুজলুম কিন্তু মোরগ দুটোর অমন ধারা নাম দিলে কেন ?
বিরে চট করে সেখান থেকে কেটে পড়ে। মোরগ মুরগিদের নামে কোনও আলোচনা সমালোচনা সে কক্ষনো শুনবে না। মুরগিদের সে যা খুসি বলে ডাকবে তাতে কার বাপের কি ? যতই পয়সার খাঁই তার থাকুক না কেন আজ পর্যন্ত সে শুধু মুরগির ডিম বিক্রি করে , মোটা টাকা পেলেও কোনও গোটা মুরগি বিক্রি করার কথা ভুলেও ভাবতে পারে না বিরে।মুরগিরা অসুস্থ হয়ে গেলে সে রাত জেগে সেবা করে ।ওরা আরাম না পেলে সে একফোঁটা শান্তি পায়না।আর কি আশ্চর্য পাড়ার কুকুর বেড়ালগুলো অবধি বিরের খামারের ধার মাড়ায় না ।বিরে বলে—- হু হু বাবা এ হল বিরে মণ্ডলের মুরগি।সে দিকে হাত বাড়ানো সোজা কথা নয় ।আসল ব্যাপারটা হল পাড়ার বেশ কটা তাগড়া কুকুর ভুলো পটকা বিশে আর লালুকে বিরে প্রচুর খাইয়ে টাইয়ে একেবারে হাত করে নিয়েছে। বিরে বাজারে গেলেও বিরের মুরগি খামারের অলিখিত পাহারাদার হয়ে দাঁড়ায় ওরাই এবং বিরে একেবারে নিশ্চিন্তে থাকে। কোন লোক যদি মুরগি চুরি করার ধান্দায় ঘোরে বিরে নিশ্চিত জানে যে ভুলো আর বিশে তাকে কামড়ে দেবেই দেবে।তবুও সাবধানের মার নেই। বিরে নিজেও যতটা সম্ভব কান খাড়া রাখে।
একদিন রাত্রে তখন সময় আন্দাজ রাত দশটা হবে একটা মৃদু খসখস আওয়াজ পেয়ে বিরে সতর্ক হয়ে উঠলো । লাঠিটা বাগিয়ে ধরে ধীরে ধীরে প্রায় নিঃশব্দে সেও মুরগি খামারের পিছন দিকটায় গিয়ে হাজির হল। আবছা চাঁদের আলোয় কি যেন একটা জিনিস নড়ে উঠলো ।শিয়াল ফিয়াল নয়তো ! বিশে ভুলো পটকার নজর এড়িয়ে ঢুকে পড়েছে হয়তো বা ! এমনিতে বিরে খুব ভিতু। আরশোলা দেখলেও তার গা কেমন করে । সেখানে শিয়াল ! কিন্তু বিরের আদরের মুরগিদের ভাল মন্দের প্রশ্ন ।যা থাকে কপালে এই না ভেবে লাঠি খানা মাথার ওপর তুলে যেই না জম্পেশ একটা আঘাত করতে যাবে অমনি যেন মাটি ফুঁড়ে এক ছয় ফুটিয়া মানুষ মূর্তি তিড়িং করে এক লাফ দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়ল । রাম রাম রাম রাম। রাত বিরেতে এসব কি ? এতো ভূত প্রেত না হয়ে যায় না ! বিরের গলা দিয়ে স্বর ফোটে না তবু কোনমতে ভাঙা গলায় চেঁচিয়ে উঠলো কে?কে ওখানে ?
—–আজ্ঞে আমি বাবু বেচারাম হালুইকর।
লোকটার গলার স্বরটা এতটাই বেচারি বেচারি যে তাকে কিছুতেই ভুত বা চোর কিছুই ভাবা গেল না । কিন্তু লোকটা তো এ গ্রামের লোক নয় । তাহলে এই রাত বিরেতে কোত্থেকে এসে উদয় হল? বিরে কিন্তু লোকটার ওপর বেশ খুসি হয়ে উঠল । আর যাই হোক এ লোকটা তাকে বাবু বলে ডেকেছে । নইলে সারাটা জম্ম এই বিরে , এই ব্যাটা বিরে, মোরগা বিরে গন্ধ বিরে শুনে শুনে কান পচে গিয়েছিল তার ।বিরে মোলায়েম করে বলল
—-এতো মুরগি খামার। রাত বিরেতে এখেনে কেন বাপু ? হালুইকর তো হাটে বাজারে যাও বিক্কিরি বাটা হবে। যাও দিকিনি এখান থেকে। যাও ।
লোকটা কাঁচুমাচু হয়ে বলল—– বাবু , পদবি আমার হালুইকর কিন্তু আমি মিষ্টি বিক্রি করিনা। আমার বাপ পিতাম মিষ্টির ব্যবসা করেছে ঠিকই কিন্তু আমি ওসব ছেড়ে দিইচি ।এখন মানুষ মিষ্টি অত খায় না । ও ব্যবসায় লাভ কম । তাই আমি ধূপ কাঠির ব্যবসা করি।
বিরে বিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে বলল—- তা আমার কাছে কী চাই ? আমি ধূপ কাঠি জ্বালাই না।
শুনে লোকটা কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল —–তাহলে এখন কোথায় যাব বাবু ? এ গাঁয়ে নানান বাড়ীতে ধূপ বিক্রির জন্য গেলাম । কেঊ কিনল না গো ধূপ ।পথের ধারে চুপচাপ বসেছিলাম তখন একটা চ্যাংড়া মতন ছোকরা এসে বলল যে বীরেন বাবুর বাড়ী চলে যাও ।বড়লোক মানুষ । বিক্রি বাটা ভালোই হবে তোমার ।তাই আপনার বাড়ি এলাম বাবু।
বিরেনবাবু ! বেচারামের মুখে নিজের নামখানা শুনে মনে মনে বড্ড খুশি হয়ে উঠল বিরে। আহা তার নাম যে বিরেন মণ্ডল এ কথাটা তো সে ভুলেই বসে আছে। ট্যাঁকসো দেওয়া আর ভোট দেওয়া এই দুই সময় ছাড়া সে বিলকুল ভুলে যায় যে তার সত্যিকারের নাম হল বিরেন মণ্ডল ।তবে এই বেচারামকে নিয়ে এখন কি করা যায় ? রাত বিরেতে মানুষকে খেদিয়ে দেওয়াটা কি ভাল ? বিশেষ এ লোকটা যখন বিরেকেই মুরুব্বি ঠাউরে বসে আছে ।অন্য সময় হলে সে হয়ত ওই চ্যাংড়া ছোকরার বাপান্ত করে ছাড়ত কিন্তু আজ তার মন ফুরফুরে আছে । সে শ্রীযুক্ত বিরেন চন্দ্র মণ্ডল। বেচারাম হালুইকরের জন্য কি করা যায় ভেবে দেখতেই হবে । সে বলল —তোমাকে এত রাতে খেতে দিতে পারব না বাপু । কারন আমি নিজেই দুটি খানি মুড়ি খাই। তোমার যদি ইচ্ছে করে তাহলে ওই দাওয়াটায় শুয়ে পড়তে পার ।শোবার জন্য চাদর বালিশ আর টাঙাবার জন্য মশারি আমি দেব তোমাকে । কি খুসি তো ?
—-খুসি মানে ? খুব খুসি বাবু।
বেচারাম প্রায় পায়ে পড়ে গেল ।চাদর মশারি বের করার সময় বিরের দুর্গন্ধে অভ্যস্ত নাকেই বোটকা গন্ধ লাগছিল।কিন্তু বেচারাম দেখা গেল অকুতোভয় । কোন দুর্গন্ধই তাকে কাবু করতে পারল না । বিরে শুতে যাওয়ার সময় ভাবল আহা বেচারাম বড় ভাল মানুষ । সবার চেয়ে আলাদা। ওর কাছ থেকে ক খানা ধুপের প্যাকেট কাল নিতেই হবে ।বিরে ঘুমিয়ে পড়ল ।ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে জীবনে এই প্রথমবার সে স্বপ্ন দেখতে লাগল ।অপূর্ব সব সুগন্ধ তাকে ঘিরে পাক খাচ্ছে আর সে ভেসে যাচ্ছে হাওয়ার চেয়েও হাল্কা কোন দোলনায় ।চমৎকার একটি ঘুম হল তার ।ঘুম ভাঙতেই চোখে পড়ল চারখানা আরসোলাকে। শুঁড় উঁচিয়ে তেড়ে আসছে তার দিকে। অন্য সময় হলে আরশোলা তাড়াতে গিয়ে তার গা কাঁপে কিন্তু আজ সেসবের কিছুই হল না। এক খানা ঝাড়ন দিয়ে ওদের তাড়িয়ে দিয়ে মুরগিদের খেতে দিল সে । নীলমণি কে একটু আদর করল চিন্তারামকে একটু ধমকে দিল তারপর তার মনে পড়লো আরে বেচারাম কোথায় গেলো ? ধূপ বিক্রি করতে এর মধ্যেই বেরিয়ে পড়ল নাকি ? সে হাঁকল —ও বেচারাম বেচারাম গো । অমনি পেছন থেকে বেচারাম বলে উঠলো —-এই যে বাবু আমি এখানে ।
—-আরে আমি তোমাকে দেখতে পেলাম না কেন ? তুমি কখন এখানে এলে ?
—-আজ্ঞে বাবু আমি তো সব সময়ই আপনার পেছনে আছি ।
কেমন যেন কৃত কৃতার্থ ভাব ওর কথায় । সবসময় পিছনে আছে ? এ কথার মানে কি ?এমনিতে দুর্গন্ধের ভয়ে দরকার ছাড়া কেউ তার কাছে ঘেঁষে না ।বিরে মুখে বলল —-বেচারাম তোমার কাছে কি কি ধূপ আছে দেখাও দিকি। আমি ক খানা নেব। কত দাম হবে বল ঠিক করে।
বিরে মনে মনে ভাবে আহা বেচারাম একটা ভাল মানুষ ও যদি দুটো পয়সা বেশিও চায় বিরে ওকে আজ সে পয়সা দেবে। লাভ লোকসানের কথা ভাববে না।কিন্তু লোকটা বিরাট জিভ কেটে বলে —-বাবু আপনার কাছ থেকে কি পয়সা নিতে পারি ? আপনি আমায় এত যতন করে কাল শুতে দিলেন থাকতে দিলেন ।আমি বরং আপনাকে ভালবেসে ক খান ধুপের প্যাকেট দিয়ে যাচ্ছি । সাঁঝের বেলায় জ্বালাবেন । আমাকে মনে রাখবেন। তাহলেই আমি খুসি হবো বাবু ।
লোকটা আর দাঁড়ায় না । ধাঁ করে চলে যায় । যাওয়ার আগে বিরের হাতে ক খানা ধুপের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে যায় । বিরে আপাদমস্তক শিউরে ওঠে ! আপনাকে ভালবেসে ! বলে কি লোকটা ! বিরে তাড়াতাড়ি ঘরে গিয়ে তার মায়ের ফটো খানার সামনে একটা ধূপ জ্বালিয়ে দেয় । অপূর্ব এক সুবাস আচ্ছন্ন করে চারপাশটাকে । এই প্রথমবার বিরে বাজারে ডিম বিক্রি করতে যায় না । বসে বসে অন্যরকম কিছু কথা ভাবে । এ রকম ভাবনা তার মনে আগে কক্ষনো আসে নি । আস্তে আস্তে কেমন যেন বদলে যায় সে । তার মন বদলায় জীবনকে দেখার চোখ বদলায় ক্রমশ সে অন্য মানুষ হয়ে ওঠে । মায়ের ফটোর সামনে প্রতিদিন একটা করে ধুপ জ্বালাতে ভোলে না সে আর ক্রমাগত বদলে যায় ।
দারুন ফিটফাট থাকে সে এখন । ডিম বেচে যে টাকা সে জমিয়েছিল সে টাকা দিয়ে গ্রামের বাচ্চাদের জন্য একটা একতলা স্কুল বাড়ি বানিয়ে দিয়েছে সে । গ্রামের লোকেরা এখন তাকে ভারি মান্য করে আর সবচেয়ে আশ্চর্য কথাটা হল এই যে এ গ্রামের সবচেয়ে সুন্দরী মেয়ে বীণা বিরের প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছে । বিরের অবস্থাও তথৈবচ । এই আষাঢ়েই চার হাত এক হওয়ার কথা আছে ।বীণা এখন মাঝে সাঝে বিরের বাড়িতে আসে । ভাবী সংসারের একটু গোছগাছ করে আর দয়া মায়া আহ্লাদি সুখিদের সঙ্গে এন্তার খেলে ।বিরের বুক ভালবাসায় টলমল করে ।আকাশ বাতাস মাটি বৃক্ষলতা ঢেলে দেয় সুগন্ধ ।অদৃশ্য এক ধূপ ওয়ালার রেখে যাওয়া অনিঃশেষ সুরভি ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।