।। ত্রিতাপহারিণী ২০২০।। T3 শারদ সংখ্যায় শুভশ্রী সাহা

পাদশাহি

দুপুর বেলা এইসময় রোদ গড়িয়ে এলে আগ্রা দূর্গের খাস বেগমমহলে ভিড় ফাঁকা থাকে। খাওয়া দাওয়া সেরে পাহারাদার তাতারনীরা বিশ্রাম করে। বাদশা মেগম আর্জুমন্দ বেগম যখন বেঁচেছিলেন তিনি দুপুর বেলায় খাস বেগম মহলেরছাদে কবুতর ওড়াতেন নয় হাত পা ছড়িয়ে চত্ত্বরের গোলাপবাগে ফোয়ারার ধারে বসে গল্প শুনতেন রেশম পথের, নয়ত তুর্কীস্থানের। তিনি যবে থেকে চলে গেছেন, পাদশাহ বেগম হয়েছেন হিন্দুস্থানের বাদশার চোখের মণি তার বড় কন্যা জাহানারা। তিনি স্বভাব গম্ভীর মানুষ, খাস দাস দাসী ছাড়া বড় একটা কেউ তার ধারে কাছে থাকে না। তিনি তো শুধু জেনানা মহলের প্রধান নন, মনসবদার ও বটে,বাদশার হুকুমতের পহেলা আওরত, এমনকি হিন্দুস্থানের ভবিষ্যত সম্রাট শাহজাদা দারাশুকোও তার কথায় উঠে বসে, একমাত্র ছোটবোন গহরআরা তার বড় আদরের ছোটবোন যখন তখন আসে। মেজবোন রোশেনারার সাথে তার কালভদ্রে দেখা হয়। আর দেখা হলেই বা কি, এড়িয়ে যায় রোশেনারা। তার মহলে অবাধ পুরুষ গমন নাচ গান সুরা সাকির গল্প জাহানারা কানে আসে শুধু। আব্বাহুজুর জানতে চাইলে চুপ থাকেন বড়ে শাহজাদী! কি দরকার বলে! আগ্রা দূর্গের জেনানা মহল এখন খুব শান্ত, নিস্তরঙ্গ শীতকালের যমুনার মতো।
চকরোজ দরওয়াজার কাছে শাহজাদী রোশেনারার মহল। হিন্দুস্থানের মুঘল বাদশার সবচেয়ে বৃহৎ সংসার তাদের এই জেনানা মহল। সব দরওয়াজা দিয়ে স
ঘোড়সওয়ার কাছে এলে রোশেনারা নিজের মহলের অলিন্দ পেরিয়ে চত্ত্বরের খিলানে পা দিলেন। চিনতে ভুল হলো না তার, খিজির খাঁ। তার আব্বা হুজুরের পেয়ারের লোক আর তার ভাইজান আওরঙজেবের বেপনাহ নফরতের লোক! নিশ্চয় কোনো খবর আছে নয়ত সোজা বাদশাহুজুরের দেওয়ান ই খাসে গিয়ে উঠবে কেন! কিন্তু কি খবর! ফুফাজান খলিলুল্লাহকে বড় দরকার এখন।
সোফিয়া! ইরানী তাতারনী ছুটে এলো তার কাছে।
— যাহ খলিল্লুলাহ খান সাহেব কে খবর দে। কাল রাতে যেন আমার মহলে আসেন।
— জ্বি জনাব
রোশেনারা ভাবতে বসল। আব্বা হুজুর ডাক পাঠিয়েছেন ছোটে শাহজাদাকে, তাকে দশহাজারী মনসবদারী, সোনা রুপা জহরত নজরানা দেওয়া হবে তামাম হিন্দুস্থানের চোখ দেওয়ান ই খাসে ইরানি তুরানি অভিজাত, সেপাহী সালার, ফৌজদার মনসবদার সবার সামনেই সম্মানিত হবেন ছোটে শাহজাদা, তাহলে খিজির খাঁ সেই খান্দেশ থেকে আবার ছুটে আসছে কেন! ভাইজানও তো এখন খান্দেশেই!
সোফিয়া ছুটে ছুটে জেনানা মহল শিশ মহল আঙুরি বাগ পেরিয়ে দেওয়ান ই খাসে এসে দেখল দরবারে কই, খিজির খাঁ সেখান থেকে উপরের খাসমহলে উঠে গেছেন। উজিরে ই আজম সাদাত খান আগেই চলে এসেছেন, এসেছেন বৃদ্ধ মোহাব্বত খাঁও। সোফিয়া বিস্তারিত জানালে ভ্রু কুঁচকালো রোশেনারার।
— বাদশা হুজুর, আপনি কি আর একবার ভেবে দেখবেন!
বাদশা থমথমে মুখে বসে ছিলেন, মাথা উঁচু করে দৃঢ গলায় বললেন, না!
উজিরে আজম চুপ করে গেলেন।
— হুজুরে আলা খবর আছে বাদশাহ আপনার কাছে দিল্লীর কাছাকাছি আসতে চাইবেন! দক্ষিণে থেকে উনি এদিকে গুছোতে পারছেন না, তার লক্ষ্য—
— কি!! বজ্রের মত মুখ থেকে বেরিয়ে এল বাদশার
— শাহাজাদা দারাশুকোর মওত!
মুহূর্তে মনে হল বাদশাহ জ্ঞান শূন্য হয়ে গেলেন যেন! দারাশুকো! তার তাজের মণি, মুঘল সলতানাতের পহেলা চিরাগ! হায় হায় এর থেকে তার নিজের কলিজাও যে দেওয়া অনেক সোজা–
— খিজির খাঁ, শাহজাদা আওরঙ্গজেবের জন্মের আগে আমি স্বপ্নে সাপ দেখেছিলাম। মরহুম বেগমজানকে বলিনি কোনদিন! পরে ইরানী মতে জনম কুন্ডলী করাতে বলেছিলেন ইরানি ফকিরসাহেব এই সন্তান হতেই মুঘলিয়াতের যেমন গর্ব মুঘল বাদশার বড় ক্ষতি!
উজিরে আজম সাদাত খান মাথা নিচু করলেন, কারণ সম্পর্কে তিনি শাহজাদাদের মামা। মরহুম বাদশা বেগমের আপন ভাই।
ইরানি অভিজাতদের দলপতি।
— এই চিঠি শীলমোহর করে দিচ্ছি আপনি সুবাদার আওরঙ্গজেবকে দেবেন। আর যেমন করে হোক তাকে আগ্রাতে আনার ব্যবস্থা করুন।
— উজিরে ই আজম, আপনি পরের কাজ জানেন! চারভাই যদি মিলে মিশে না থাকতে পারে, আমাকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
— — বাদশা হুজুর, মরহুম বাদশা বেগমের কথা একটিবার ভাবুন!
— আপনার ভগ্নী হতে পারেন, তিনি চার শাহজাদার আম্মীজান! আমি তার কাছে জবান দিয়েছি তার সব সন্তানকে ভালোরাখার জন্য! নি:শর্ত ক্ষমা চাইলেই, শাহী পরোয়ানায় ক্ষমা পাবেন শাহজাদা!
বাদশার আজ মন ভালো নেই। রেশমের ডরিতে টান দিয়েই বললেন, মেহজবিন বেগমকে প্রস্তুত হতে বলো। জাঁফর খাকে খবর দাও, শাহী নৌবারা প্রস্তুত করতে যমুনায় যাবো।
বাদশার এমন এমন হয় আজকাল। দিলশাদ ছুটে চলে গেল ব্যবস্থা করতে।
পরের দিন, গভীর রাতে খলিল্লুলা খা সাহেব রোশনারার মহলে এলেন।
— খাঁ সাহেব, খোঁজ করুন আজ খিজির খাঁ এসেছিলেন আব্বা হুজুরের খাসমহলে। খান্দেশ ছেড়ে তিনি আগ্রায় এলেন কি করতে তাও মুঘল বাদশার কাছে! ছোটে শাহজাদার আসার কথা এখানে— দাওয়াতে খতরা নেই তো!
— শাহজাদী রোশেনারা! আপনার কমবক্ত ফুফাজানের কান এড়াতে কেউ পারবেন না!
— মতলব!
রোশেনারার কাছে নিজেকে কমবক্ত বলার কারণ আছে। খলিলুল্লার বেগম মেহেজবিন, মরহুম বাদশা বেগম মমতাজমহলের আপন বোন। সে এখন বাদশার বিবি বনে প্রাসাদে, দূর্গে নদীতে বাদশার খিদমতগারে লেগে আছে। লোকে দেখছে কিন্তু বাদশাকে বলবে কে! কার সাধ্য! তাই লোকের আঙ্গুল খলিলুল্লুরার মর্দাণীর উপর। রোশেনারাও কমবক্ত আদমী বলতে কসুর করেননি তাকে!
— কাজের কথা বলুন! রোশেনারা গম্ভীর হলেন।
— আপনি শাহজাদা আওরঙজেবকে আগ্রায় আসতে বারণ করুন। খিজির খাঁ রওনা হবার আগেই আপনার লোক পাঠান!
— কেন! আব্বাহুজুর মনসবদারী দেবেন বলে ওয়াদা করেছেন ভাইজানকে।
— বেশক করতে পারেন! কিন্তু আগে বন্দী করবেন! নি:শর্ত ক্ষমা চাইলেও তার জায়গা হবে এবার হিন্দুস্থানের বাইরে কাবুল কান্দাহারে! আগ্রার তখত তার নসীব হবে না আর!
রোশেনারা বসে পড়লেন কেদারায়! কে দিতে পারে এমন বুদ্ধি! দাঁতে দাঁত চিপলেন শাহজাদী।
— আপনি ইব্রাহিম রেজাকে পাঠান। শাহজাদার বফাদার সিপাহী! পাখির থেকেও আগে চলে! দিল্লীতে শাহজাদার নিজের লোক হলো অনেক ইরানি অভিজাতরা। খিজির খাঁর ব্যবস্থা তারাই করবে।
— আপনি এখনি পাঠান তাকে আমার কাছে!
— যো হুকুম শাহজাদী!
–শুনুন, আপনি কি করে জানতে পারলেন! কথাটা যদি মিথ্যা হয়!
খলিলুল্লাহ খান দাঁড়ালেন, হাসলেন, বললেন
— মেহেজবিন! কাল বাদশা হুজুরের সাথে যমুনায় শাহী নৌবারায় ছিল। খিদমদগারি বাদশার করলেও, এখনো বিবি আমারই আছে শাহজাদী! রোশেনারা স্তব্ধ হয়ে গেলেন।
খিজির খাঁ পত্র নিয়ে খান্দেশে যাবার মুখে নিহত হলেন। কে বা কারা তাকে হত্যা করলো,জানাই গেল না। আওরঙ্গজেব নিজেই পত্র পাঠিয়ে জানালেন, বর্ষা পেরিয়েই তিনি আসবেন আগ্রায়। তার বড়ি বেগম দিলরস বানু বল সন্তান সম্ভবা, এখন পথ বিপদসঙ্কুল। মুঘল সম্রাট বুঝে গেলেন ছোটে মিঁয়া ধরা দেবার বান্দা নন।
তার পনের দিন বাদে, রোশেনারা আসির গড় দূর্গে বেড়াতে এলেন। রাতের বেলা বোরখা পড়ে যে হাবসী পাহারাদার এলো তার খোলা তরোয়াল দেখেই—
— ভাইজান, আপনি এখানে নিজে এসেছেন! আমি তো ভাবলাম আপনার পয়গম নিয়ে আসবে কেউ!
রোশেনারা জড়িয়ে ধরলো তার প্রিয় ভাইজান কে। ভাইজান তার গলায় দশলাখি জহরতের হার পরিয়ে দিলে।
— ইনশা আল্লাহ! আমি যেদিন আগ্রার তখতে বসব, সেদিন তুমি হীরে জহরতে মোড়া থাকবে! আর তোমার মোহাব্বত!
— হীরে জহরত! মোহাব্বত! কি হবে আমার!
শাহজাদা বিস্মিত হলেন, তাহলে কি চাও শাহজাদী!
— পাদশাহ বেগমদারী!
শাহজাদা চমকে গেলেন একেবারে! –তাহলে বড়ি দিদি জাহানারা আর —-
— পাদশাহ বেগমদারী আর তার মনসবদারী, বিষয় খাস জমিন তালুক, দূর্গ, কিলা সব, সব আমার হবে। মুঘল সলতনাতের পহেলা আওরত শাহজাদী জাহানারাকে আমি আমার পায়ের তলায় দেখতে চাই!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।