রোববারের আড্ডা শুধু গালগল্প করে সময় কাটানোর মাধ্যে সীমাবদ্ধ নেই, আমাদের জীবনচর্চার একটি অপরিহার্য অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ফলত এই নিদারুন লকডাউনের সময়ও তার আকর্ষণ কাটিয়ে উঠতে পারিনি। যথাযথ নিয়ম মেনে, মাস্কে মুখ ঢেকে নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে নিয়ম করে বসি। ঘন্টাখানেক সময় গল্পগুজব, হাসিঠাট্টায় অতিবাহিত করে যে যার বাড়ি ফিরে যায়।
গত রোববারও বসেছিলাম। রাজ্যের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি, বিশেষ করে মমতা ব্যানার্জির অভাবনীয় সাফল্য, বিজেপি-র আশানুরূপ সিট না পাওয়া, বাম-কংগ্রেসের সমূলে বিনাশ, ইত্যাদি বিষয়গুলির চুলচেরা বিশ্লেষণ সেরে করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউয়ের ভয়াবহতা নিয়ে কথা হচ্ছিল। বৌদি চা নিয়ে এলেন। যথারীতি দুই বুড়োকে দিয়ে শেষে আমার কাছে এসে ফিক করে হেসে উঠে বললেন, ঠাকুরপো আজ বাজারে কী হয়েছিল জান?
মদনদা হা হা করে তেড়ে উঠলেন, খবরদার ওকথা এখানে তুলবে না।
– কেন তুলবে না? গল্প করার জন্যই তো এখানে আসা। আজ না হয় বাজারের গল্পই হবে। বলো বৌঠান কী হয়েছিল বাজারে? নলিনী দাদু একরাশ আগ্রহ নিয়ে বৌদির দিকে তাকালেন। রহস্যের গন্ধ পেয়ে আমিও নড়েচড়ে বসলাম।
– সে এক কেলেঙ্কারি দাদা। আপনার বন্ধু…..
– বলো বলো। ঢাকঢোল পিটিয়ে গ্রামের সবাইকে শুনিয়ে এসো মদন বুড়ো আজ….। গরম তাওয়ায় দেওয়া চাল যেমন চড়চড় করে ফুটে, মদনদাও তেমনি ফেটে পড়লেন।
– আহা মদন! তোমাকে তো কিছু বলা হয়নি, তুমি চটছো কেন?
– কেন চটব না শুনি? ভুল মানুষ মাত্রের হয়। তাই বলে সে কথা সবাইকে বলে বেড়াতে হবে।
– কাকে বলেছি আমি? আত্মপক্ষ সমর্থন করে বললেন বৌদি। তাতে দাদার রাগ যেন আরও বেড়ে গেলো। মুখ বিকৃত করে খেকিয়ে উঠলেন, থাক আর দাঁত ক্যালাতে হবে না। যাও এখান থেকে।
এবার বৌদি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেললেন। আহত কেউটের মতো ফোঁস করে উঠে বললেন, এখন লজ্জা পাচ্ছো? বলি পরস্ত্রীর হাত ধরার সময় কোথায় ছিলো তোমার এতো লজ্জা?
– বলো কী বৌঠান! আমাদের মদন এই কাজ করেছে? ছি ছি! গোল গোল চোখ করে বললেন নলিনী দাদু।
– নলিনী তুমি যা ভাবছো আসল ঘটনা তা নয়। নিছক একটা অ্যাকসিডেন্ট। আর তাই নিয়ে একটা হুলুস্থুলু কাণ্ড ঘটে গেলো ভরা বাজারে।
– হ্যাঁ হ্যাঁ! বলো কী হয়েছিল? বললেন নলিনী দাদু।
– ক’দিন থেকে শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না।
শুরু করেই স্বভাবসিদ্ধ ঢঙে খুকখুক করে কেসে উঠলেন দাদা। এই অবসরে বৌদি টুক করে বৈঠকখানা থেকে বেরিয়ে পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকলেন। মদনদা বলতে থাকলেন, গিন্নি ডাক্তার দেখানোর জন্য বারবার তাগাদা দিচ্ছিল। আমিও ভেবে দেখলাম রোগবালাই নিয়ে হেলাফেলা করা ঠিক নয়। তাই সকাল সকাল গিন্নিকে বগলদাবা করে বেরিয়ে পড়লুম।
– তারপর!
– আঠারো-বিশজন রুগী অপেক্ষা করছিল, নাম লিখিয়ে আমিও তাদের দলে শামিল হলাম। একটু পরে ডাক্তারবাবু এসে রুগী দেখা শুরু করলেন। একে একে ভিতরে যাচ্ছে আর প্রেসক্রিপশন হাতে বেরিয়ে আছে।
একসময় আমার পালা এল। গিন্নিকে বেঞ্চে বসিয়ে রেখে ভিতরে গেলাম। ডাক্তারবাবু কী হয়েছে জানতে চাইলে সবকিছু খুলে বললাম। তখন তিনি পেট টিপে, কল লাগিয়ে পরীক্ষা করে দেখে প্রেসক্রিপশন লিখে দিলেন। ফিজ মিটিয়ে দিয়ে চেম্বার থেকে বেরিয়ে ঔষধে দোকানে গেলাম।
থামলেন মদনদা। টেবিলের উপর থেকে গ্লাসটা তুলে নিয়ে অল্প পরিমানে জল ঢেলে গলা ভিজিয়ে নিয়ে পুনরায় বলতে থাকলেন, গিন্নি বেঞ্চে বসে ছিল। ওকে ডেকে নিয়ে বাস স্ট্যাণ্ডের দিকে হাঁটতে শুরু করলাম। মাঝপথে কিছু ফল কিনলাম। তখন পর্যন্ত সবকিছু ঠিক ছিল। সমস্যা দেখা দিলো বাসে উঠার সময়, কিছুতেই উঠবে না সে।
– কেন! কেন? আমার কথায় নিদারুন বিরক্ত হলেন মদনদা। হনুর মতো মুখ বিকৃত করে বললেন, এই জন্য শালা তোর কপালে মেয়ে জুটছে না? উজবুক কোথাকারের।
মদনদার কথা বলার ধরণ দেখে দাদু খিকখিক করে হেসে উঠলেন। ঘেন্নায় আমার পিত্তি জ্বলে গেলো। শালা মদনা, বুড়ো ভাম। কথায় কথায় শুধু বিয়ের খোঁটা দেওয়া? একদিন ঠিক বিয়ে করে দেখিয়ে দেব পেঁচো বাড়ুজ্জ্যে তোমার থেকে কম যায় না।
বড়দের সামনে এসব কথা মুখে আনতে নেই। তাছাড়াও মজলিস থেকে বিতাড়িত হবার সমূহ সম্ভবনা রয়েছে, যা আমি মোটেও চাই না। কাজে কাজেই মনের ঝাল মনে মিটিয়ে নিয়ে পরিতুষ্ট চিত্তে মিহি করে বললাম, বৌদি হঠাৎ রেগে গেলেন কেন দাদা?
– সেটিই তো রহস্য! বাসে উঠছে না দেখে হাত ধরে টানতে সে বাজখাই গলায় চিৎকার করে উঠলো, কে আপনি? আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছেন?
– সেকি! বৌদি আপনাকে এমন ব্যবহার দিলেন? বিস্ময়ে আমার মুখের কপাট এতটা ফাঁক হয়ে গেল, একটি চড়ুই পাখি অনায়াসে ওই ফাঁক গলে অন্দর-বাহার করতে পারে। পাছে মদনদা রেগে গিয়ে হাঁ গর্তে লাঠির গুঁতো মেরে বসেন, সেই ভয়ে তাড়াতাড়ি হাত দিয়ে মুখ চেপে ধরলাম।
মদনদা বলতে থাকলেন, মহিলার গলার স্বর শুনে বুঝতে পারি গড়বড় হয়ে গেছে। গিন্নির বদলে অন্য কাউকে….
– কিন্তু মদন মহিলা কেন প্রথমেই প্রতিবাদ করলেন না? জিজ্ঞাসা করলেন নলিনী দাদু।
উত্তরে দাদা যা বললেন তার সার সংক্ষেপ মোটামুটি এই রকম, ভদ্রমহিলার ডায়াবেটিসের অসুখ। ডাক্তার ব্লাড টেস্ট করার সুপারিশ করলে মহিলার স্বামী তাঁকে বসিয়ে রেখে ল্যাব টেকনিশিয়ানকে ডাকতে গিয়েছিলেন। মজার বিষয় হলো দাদা বৌদিকে যেখানে বসিয়ে রেখে ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকেছিলেন, ভদ্রমহিলা সেই জায়গাতেই বসেছিলেন। ঔষধ কিনে ফিরে এসে দাদা ডাকলে, মহিলা ল্যাবের লোক ভেবে আপত্তি না করে তাঁর পিছন পিছন হাঁটতে শুরু করেন।
বাস স্ট্যাণ্ডের কাছেই আশাদীপ ডায়গোনস্টিক সেন্টার। ভদ্রমহিলা ভেবেছিলেন তাঁকে সেখানেই নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। কিন্তু বাসে উঠতে বলায় ভুল লোকের পাল্লায় পড়েছেন বুঝতে পেরে চেঁচামেচি শুরু করেন। এই অবসরে বাস স্ট্যাণ্ডে উপস্থিত জনতা বিনামূল্যে বিনোদনের সূযোগ পেয়ে দাদাকে ঘিরে ধরে বিক্ষোভ দেখাতে থাকে। ধীরে ধীরে জনতার রায়ে তিনি নারী পাচারকারী চক্রের পাণ্ডায় পরিনত হয়ে গেলেন। তখন কেউ কেউ মেরে হাত-পা ভেঙে দিতে চাইল, কেউ বা পুলিশে দেবার সুপারিশ করে।
এক নাগাড়ে অনেক কথা বলে দাদা হাপিয়ে উঠেছেন। কাতলা মাছের মতো মস্ত হাঁ করে কয়েক ঢোক বাতাস গিলে ঘোঁত করে শ্বাস ছেড়ে বললেন, আমার অবস্থা তখন শিকারির জালে আটকা পড়া অসহায় শুয়োরের মতো। যত বলি ভুল হয়েছে, ব্যাটারা ততই খোঁচা মারে। ভাগ্যিস….
– সেইসময় এসে পৌঁচেছিলাম। ভদ্রমহিলার স্বামীও খুঁজতে খুঁজতে হাজির হয়েছিলেন। দুজনে মিলে অনুরোধ উপরোধ করে লোকজনকে শান্ত করি। বলতে বলতে পাশের ঘর থেকে এঘরে চলে এলেন বৌদি।
– সে না হয় বুঝলাম। কিন্তু তুমি কেন ওই মহিলাকে জায়গা ছাড়তে গেলে বৌঠান?
দাদুর কথা লুফে নিয়ে মদনদা তর্জনী খাড়া করে বললেন, ঠিক বলেছো নলিনী। বুড়ি জায়গা না ছাড়লে আমাকে এতো দুর্ভোগ পোহাতে হতো না। তারপর সরাসরি বৌদিকে চার্জ করে বসলেন, কোথায় গিয়েছিলে তুমি? বল বল।
– বেশী মুখ নাড়িও না। আমি না হয় বাথরুমে গিয়েছিলাম। তাই বলে তুমি পরস্ত্রীকে ধরে টানাহ্যাঁচড়া করবে?
– আমি মোটেও তা করিনি। শুধু হাতটা ধরে বলেছিলাম উঠে এস।
– মাছ খাওনি কিন্তু ঝোলের পেয়ালায় চুমুক দিয়েছ। চরিত্রহীন, মিচকে শয়তান। তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, এই বয়সেও মেয়েমানুষ দেখে বেল্লেলাপনার শখ গেল না।
– নলিনী। নলি…..। মদনদা রাগের চোটে কথা শেষ করতে পারলেন না। মাটির কলসীর পাছার মতো চুলহীন মসৃণ মাথাটা দু’হাতে চেপে ধরে মোরগের মতো কঁক কঁক করে উঠলেন। ঘাবড়ে গিয়ে দাদু ছুটে এসে দাদার পিঠে হাত বোলাতে শুরু করলেন।
– মদন কি হল তোমার, শরীর খারাপ করছে?
– আমি রেগে যাচ্ছি নলিনী। চোখ কুতকুত করে বললেন মদনদা।
– বলো কি হে!
– দেখো দেখো, রাগে আমার শরীরের সব লোম খাড়া হয়ে উঠেছে।
মদনদার আপদমস্তক চোখ বুলিয়ে সত্যি সত্যি লোম খাড়া হয়েছে কি না দেখে নিলেন দাদু। তারপর টেবিল থেকে জলের গ্লাসটা তুলে নিয়ে বন্ধুর হাতে ধরিয়ে দিলেন। বিনাবাক্য ব্যয়ে তিনি গ্লাসের সবটুকু জল এক নিশ্বাসে পান করে মোষের মতো ফোঁস করে শ্বাস ছেড়ে বললেন, বুড়িকে বলো আর যেন একটাও কথা না বলে। তা নাহলে ওকে খুন করে আমি ফাঁসিতে ঝুলব।
– ওরে আমার….
– থাক বৌঠান অনেক হয়েছে। তুমি আর কোন কথা বল না। বৌদি চিৎকার করে উঠলে দাদু তাকে প্রতিহত করলেন।
এতবড়ো ভুল কী করে হয়? ডাক্তার কি বললেন, ভয়ের কোন ব্যাপার আছে কি না, ইত্যাদি বৌদির জানতে চাওয়া স্বাভাবিক। সাথের মহিলাকে এইসব কথা জিজ্ঞাসা করতে না শুনে দাদার সন্দেহ হল না কেন? তাছাড়া ডাক্তারের চেম্বার থেকে বাস স্ট্যাণ্ড পর্যন্ত একসাথে হেঁটে এলেন, এর মধ্যে কী উনি একবারও বৌদির মুখের দিকে তাকাননি?
প্রশ্নগুলো আমার পেটের ভিতর নৃত্য করছিল। দাদা একটু স্বাভাবিক হতে তা ছুড়ে দিলাম। সঙ্গে সঙ্গে কোন উত্তর করলেন না তিনি। চেয়ার থেকে উঠে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন। কিছুক্ষণ বাদে একখানা ফটো ফ্রেমের প্রায় পুরোটা গামছায় ঢেকে নিয়ে এসে আমার মুখের সামনে ধরে জিজ্ঞাসা করলেন, ছবির এই লোকটা কে বল দেখিনি?
– চিনতে পারছি না।
– কেন?
– পুরোটা ঢেকে রেখেছেন। কপাল দেখে কী মানুষ চেনা যায়?
আমার উত্তর শুনে দাদার মুখমণ্ডল জুরে খুশির বাতাস বয়ে গেল। ঠোট চওড়া করে বললেন, আমার সাথেও একই ঘটনা ঘটেছে। মহিলা কপাল বাদে পুরো মুখমণ্ডল মাস্ক দিয়ে ঢেকে রেখেছিলেন।
– ওহ্ মাস্কের মস্করা! হো হো করে হেসে উঠলেন নলিনী দাদু।
– ঘটনাটা তোমার দৃষ্টিতে মস্করা মনে হতেই পারে। কিন্তু আমি আজ চরম শিক্ষা পেয়েছি ভায়া। মাস্ক শুধু জীবন বাঁচায় না, কখনও তা জীবন নাশের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
একথা শুনে দাদু টিকটিক করে মাথা নাড়লেন। চেষ্টা করেও আমি কিছু বলতে পারলাম না। ফস করে এক ছটাক বাতাসা নির্গত হয়ে বৈঠকখানার জানালা গলে মহাশূন্যে লীন হয়ে গেলো।