গেটে গাড়ি এসে দাঁড়াতে গেট খুলে বেরিয়ে এল মালি। সে আগের দিনই শ্যামলীকে দেখেছে। বিনা বাক্যব্যয়ে গেট খুলে দিল সে। সন্ধ্যা এতটা গড়িয়ে যাবার পর শ্যামলীকে ঢুকতে দেখে কাজের মেয়েরা অবাক। খুশি ফুটে উঠেছে তাদের চোখে। শ্যামলী তাদের দিকে একটু হাসিমুখ করে রমানাথের ঘরে গেল। রমানাথ শুয়েছিলেন। শুয়ে শুয়েই বললেন, মা বুঝি তোমাকে জোর করে ডাকিয়ে আনলেন?
শ্যামলী খাটের কিনারায় হাতের উপর ভর রেখে একটু ঝুঁকে চাপা স্বরে বলল, কি ছেলেমানুষি করছেন বলুন তো আপনি?
রমানাথ বললেন, আমার কোনো কিছুই ভাল লাগছে না।
শ্যামলী বলল, সব সময় কি সব কিছু একরকম চলে? ধৈর্য ধরতে হয়, অপেক্ষা করতে হয়।
ম্লান হেসে রমানাথ বললেন, ধৈর্য ধরলে, অপেক্ষা করলে আমি সফল হব?
খাটের উপর উঠে বসে রমানাথের আরো কাছে ঘেঁষে শ্যামলী বলল, জীবনটা একটা খুব বড়ো সম্পদ। তাকে বিপন্ন করতে নেই।
শ্যামলীর নিঃশ্বাস থেকে একটা সুরভি রমানাথের মনের প্রান্তে প্রত্যন্তে ছড়িয়ে পড়ছিল।
শ্যামলী বলল, আপনি না খেয়ে আছেন শুনেই আমার চোখ দিয়ে জল পড়ছিল।
রমানাথ বলল, সত্যি আমাকে এত ভালবাসো তুমি?
শ্যামলী বলল, দাঁড়ান, আমি এক মিনিট আসছি।
এই বলে সে রান্নাঘরে গিয়ে একজন কাজের মেয়েকে বলল, একগ্লাস জল দাও তো?
মেয়েটি খুশি হয়ে বলল, তুমি দাদার কাছে গিয়ে গল্প করো না, আমি এই নিয়ে যাচ্ছি।
শ্যামলী বলল, না জলের গ্লাস আমার হাতে দাও। আর বিস্কুট কোথায় আছে?
মেয়েটি অবাক হয়ে বলল, আমি এই তোমার জন্য চা বিস্কুট নিয়েই যাচ্ছি গো!
শ্যামলী কর্তৃত্বব্যঞ্জক স্বরে বলল, একটা প্লেটে দুটো বিস্কুট এখনই দাও।
মেয়েটি অবাক হয়ে কৌটা থেকে বিস্কুট বের করে দিল। শ্যামলী রমানাথের ঘরে ফিরে শুয়ে থাকা রমানাথের খাটের পাশে দাঁড়িয়ে বলল, ও মশাই, এই জলটুকু খান তো।
রমানাথ হেসে বললেন, শ্যামলী তুমি কি করে জানলে আমার তেষ্টা পেয়েছিল?
শ্যামলী বলল, সকাল থেকে খিদে তেষ্টা চেপে রেখে হৈচৈ বাধিয়ে দিয়েছেন আপনি।
রমানাথ বললেন, সকাল থেকে কিচ্ছু খাই নি এটা বাড়িয়ে বলা কথা। তুমি জানো তোমাদের বাড়িতেই তোমার সামনে বসে জলখাবার খেয়েছি। পরে আরেকটি বার চা খেয়েছি।
শ্যামলী মুখ টিপে হেসে বলল, দাঁড়ান, বাকি জলটুকু খাবার আগে এই বিস্কুটটুকু খাইয়ে দিই।
রমানাথ বিনা আপত্তিতে শ্যামলীর হাত থেকে বিস্কুট খেতে লাগল।
শ্যামলী হেসে বলল, গান্ধীজি যখন ইয়েরওয়াড়া জেলে অনশন করছেন, তখন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছুটে গিয়ে লেবুর শরবত খাইয়ে তাঁর অনশনভঙ্গ করেছিলেন। ইয়েরওয়াড়া জেলটা বোম্বের কাছে। ১৯৩২ সালের ষোলো সেপ্টেম্বর থেকে অনশন করছিলেন গান্ধীজি। ওঁর অনশন ভাঙানোর জন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর গান লিখেছিলেন, “জীবন যখন শুকায়ে যায়, করুণা ধারায় এসো”।
রমানাথ জানতে চাইলেন, কেন উনি হাঙ্গার স্ট্রাইক করেছিলেন শ্যামলী?
শ্যামলী বলল, ব্রিটিশ সরকারের ধান্দা ছিল জাতপাতের ভিত্তিতে ভোট ভাগ করে দিয়ে ভারতকে টুকরো টুকরো করে দেওয়া। গান্ধী তার প্রতিবাদ করে অহিংস আইন অমান্য আন্দোলন গড়ে তুলতে গেলে পুলিশ তাঁকে গ্রেফতার করে ইয়েরওয়াড়া জেলে পুরে রাখে। কিছুদিন পর তিনি অনশন শুরু করেন। শরীর দ্রুত ভাঙতে থাকলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছুটলেন সেখানে। নিজের হাতে লেবুর শরবত খাইয়ে অনশন ভাঙালেন। এরও অনেক দিন আগে ১৯২৩ এ জেলের ভিতরে বন্দী নজরুল ব্রিটিশের অন্যায়ের বিরুদ্ধে যখন অনশন আন্দোলন করছেন, শরীর খুব খারাপ হয়ে পড়ছে, তখন বাঙালি সাহিত্যিকদের অনুরোধে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নজরুলকে টেলিগ্রাম করে অনুরোধ করেন অনশন তুলে নাও, আমাদের বাংলা সাহিত্যের বিকাশের জন্যে তোমাকে দরকার। তারপর তিনি নজরুলকে তাঁর বসন্ত নাটকটা উৎসর্গ করেছেন। অনেকেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের রক্তকরবী নাটকের রঞ্জন চরিত্রে নজরুলের ছায়া দেখতে চান।
রমানাথ জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্টাইলে আমার অনশন ভাঙালে?
রমানাথ বললেন, হ্যাঁ বাবা গান শুনতে ভালবাসতেন। আমাদের গ্রামোফোন ছিল।
শ্যামলী বলল, সেই চোঙওয়ালা?
রমানাথ বলল, হ্যাঁ। তা এ এসে হাত দেয়, সে এসে নাড়াচাড়া করে। অতো ঝক্কি সইবে কেন? তারপর এটা কিছুদিন হল এসেছে।
শ্যামলী বলল, এখন বলুন তো দেখি, কি খাবেন?
রমানাথ বললেন, দাঁড়াও, আমি বাথরুম থেকে আসছি।
শ্যামলী বলল, আসুন। বলে সে আবার রান্না ঘরের দিকে গেল। গিয়ে লক্ষ্য করল, বাড়ির মেয়েরা তার এই আসা নিয়ে আলোচনা করছে। সে নিয়ে কিছুই না বলে শ্যামলী জানতে চাইল, দুধ কোথায় আছে?
রাঁধুনি মেয়েটি বলল, তোমার কি চাই বলো না, আমি বানিয়ে দিচ্ছি। তুমি দাদার সাথে গল্প করো গে।
শ্যামলী বলল, না, আমি নিজের হাতে বানাব।
তারপর রান্নাঘরে আলমারির পাল্লা খুলে নিজেই হাতড়ে হাতড়ে বের করে ফেলল কাজু আর কিসমিস। তারপর আঁচলটা কোমরে জড়িয়ে, হিটার জ্বালিয়ে পায়স বানালো। একটা বড়ো পাত্রে জল নিয়ে পায়সের বাটি তাতে বসিয়ে কাজের মেয়েকে বলল, রুপোর বাটি চামচ আছে?
কাজের মেয়ে বলল, তা আছে, কিন্তু ওতে তো আমরা হাত দিই না। মা নিজের হাতে কখনো সখনো হাত দেন।
শ্যামলী বলল, আমাকে ওই বাটি চামচ বের করে দাও।
তার গলা শুনেই কাজের মেয়ে বুঝে গেল, বাটি চামচ এখুনি বের না করলে আর উপায় নেই। অন্য মেয়েরা এ ওর গা টেপাটেপি করতে করতে আড়ালে সরে গেল।
নিজের ঘরে খাটের উপর জোড়াসন করে বসেছিলেন রমানাথ। শ্যামলী এসে হেসে বলল, একটু পায়স বানিয়েছি। খেয়ে বলতে হবে, কেমন হয়েছে।
রমানাথ বললেন, শ্যামলী, তুমি এসব কি শুরু করেছ বলো তো? আমি পায়েস খাব না।
শ্যামলী বলল, আরেকটি বার খাব না বলে দেখুন তো আপনি? জানেন, গৌতম বুদ্ধ বটগাছের নিচে উপবাসে থেকে অনেক তপস্যা করছিলেন। কিন্তু কিছুতেই সাফল্য আসছিল না। তারপর সুজাতা এসে পরমান্ন দিলেন। ক্ষুধার্ত গৌতম তা সানন্দে গ্রহণ করলেন। সাধনায় সিদ্ধি মিলল।
রুপোর বাটি থেকে রুপোর চামচে করে পায়স তুলে একটু একটু করে খাইয়ে দিচ্ছিল শ্যামলী।
খাওয়ানো শেষ হতে একজন বৃদ্ধা মহিলা ঘরে ঢুকে শ্যামলীর দিকে চেয়ে কড়া স্বরে বললেন, তুমি পালবাবুর ছোট মেয়েটা না?
শ্যামলী নরম গলায় বলল, হ্যাঁ।
বৃদ্ধা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বললেন, তা তুমি এত রাতে একলা মেয়েমানুষ ওর ঘরে কি করছ?
শ্যামলী বলল, আমি ওঁর সঙ্গে একটু গল্প করছিলাম। আপনি কি আর কিছু বলবেন?
তিক্তস্বরে বৃদ্ধা বললেন, না বাছা, তোমাকে বলে কিছু লাভ নেই, হ্যাঁ রে, রমা, তোরও কি বুদ্ধি শুদ্ধি সব লোপাট হয়েছে? না হলে এই মাঝ রাত্তিরে রাঁধুনিকে ঠেলে সরিয়ে সবাইকে উদব্যস্ত করে পায়েস বানাবার এত ঘটা কিসের? বাড়িতে কি তোর পায়েস হয় না, না কি বাড়ির পায়েস মুখে আর রুচছে না?
রমানাথ বৃদ্ধার কথায় ফুঁসে উঠল। দ্যাখো মাসি, আমি খুব শান্ত ভদ্র বলে আমাকে কেঁচো মনে কোরো না। শ্যামলীকে আমি ভালবাসি। সকাল থেকে রাগ করে আমি খাই নি শুনে, ও আর থাকতে পারে নি। দৌড়ে চলে এসেছে। এতেও যদি তোমাদের আপত্তি থাকে তো বলো, আমি বাড়ি ছেড়ে বিবাগী হয়ে চলে যাই।
বৃদ্ধা বললেন, তা তুমি যদি ডাকিয়ে এনে পায়েস বানাবার ফরমাশ দিয়ে থাকো, তো আমার কিসের আপত্তি বাছা? নেহাৎ তোমার মা খুব বিরক্ত হয়ে ছটফট করছে তাই বলতে আসা। নইলে, আমার তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছে, আমার এইসব অসৈরণ কাণ্ডে থাকার দরকারটা কি?
রমানাথের মা এগিয়ে এসে বললেন, কই সেজদি, আমি আবার তোমাকে কখন কি বলতে বললাম? মেয়েটা এল বলে তবেই না রমা কিছু মুখে তুলল! আমার ছেলে এখন বড় হয়েছে। এখন তার নিজের একটা মনের মানুষ দরকার। মা মাসি হাতে পায়ে ধরলেও এখন রাগ কমবে না।
বৃদ্ধা মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বললেন, আ খেলে যা, যার জন্যে চুরি করি, সেই বলে চোর! ছ্যা ছ্যা। আমি আর এসব কথায় নেই! বলে বৃদ্ধা সরে পড়লেন।
নকুড়গিন্নি মধুমাখা স্বরে শ্যামলীকে বললেন, তা তুই কালকে চলে গেলি কেন মা? তোর তো ঘর গোছানো ছিল। নতুন জামাকাপড় আনিয়েও রেখেছিলাম। থাকলে কত গল্প করতে পারতিস।
বিরক্ত হয়ে রমানাথ মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, তুমি আর লোক হাসিও না মা। শ্যামলী কেন, কি কারণে থাকতে পারে নি, আজও থাকতে পারে না, তা তুমি খুবই ভালো করে জানো মা। ও এল, তাই দুটি মুখে দিলাম। ও চলে গেলে আলোটা নিবিয়ে আবার শুয়ে থাকব।
রমানাথের মা ভয় পেয়ে বললেন, তার চাইতে কথাবার্তা পাকা করে ফ্যাল্। আমি গুরুদেবের মত আনিয়ে নেব।
সামনের অঘ্রাণেই তোদের আমি বিয়ে দোবো, কালাশৌচ মহাগুরুনিপাত ওসব আর মানব না। তোর বাবা তো আরো আগেই বিয়ে হোক এটা চেয়েছিলেন। তাঁর ইচ্ছেই পূরণ হোক। শ্যামলী বেতের মতো সোজা দাঁড়িয়ে বলল, না জ্যেঠিমা, তা হতে পারে না। আমি গতকালই এবাড়িতে দাঁড়িয়ে কথা দিয়েছি রমানাথকে আমি বিয়ে করব না। জ্যেঠিমা, আমার কথার নড়চড় হবে না।
তার কাঁধে হাত রেখে শ্যামলী বলল, আপনি কোনো অপরাধ করেন নি। আমি সারাজীবন আপনার শুভাকাঙ্ক্ষী বন্ধু হিসেবে থেকে যাব। যখনই চাইবেন, বন্ধু হিসেবে আমাকে পাশে পাবেন। এই বলে মায়ের সামনেই রমানাথের গালে একটা চুমু এঁকে দিল।
ঘরের দরজার বাইরে মেয়েরা ভিড় করে এসেছিল, তারা সব দেখে শুনে ভারি অবাক হয়ে গেল।