সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ২)

আবেল পুরাণ: নিলস হেনরিক আবেল স্মরণলেখ
২
নিলস হেনরিক আবেল (১৮০২ – ১৮২৯) সর্বকালের বিশ্বসেরা গণিতবিদদের অন্যতম। আবেলের স্মরণে ইউরোপের নরওয়ের রাজা পৃথিবীর সেরা একজন কি দুইজন গুরুত্বপূর্ণ গণিতবিদকে আবেল পুরস্কারে সম্মানিত করেন। নোবেল পুরস্কারের ধাঁচেই গড়ে উঠেছে আবেল পুরস্কারটি।
নিলস হেনরিক আবেলের স্মরণে যে নোবেলের সমকক্ষ একটি পুরস্কারের প্রয়োজন আছে এই নিয়ে সর্বপ্রথম প্রস্তাব করেন নরওয়ের বিখ্যাত গণিতজ্ঞ মারিয়াস সোফিয়ুস লী ( ১৮৪২ – ১৮৯৯)।
লী কনটিনিউয়াস সিমেট্রি তত্ত্ব প্রণয়নে প্রমুখ ভূমিকা নিয়েছিলেন, এবং এই তত্ত্বকে জ্যামিতি ও ডিফারেনশিয়াল ইকুয়েশন নিয়ে গভীরতর চর্চায় প্রয়োগ করেছিলেন। তো, লী যখন শুনলেন আলফ্রেড বার্ণহার্ড নোবেলের টাকায় অতবড় পুরস্কার চালু হচ্ছে, পদার্থবিজ্ঞানে, রসায়নে, মেডিক্যাল সায়েন্সের মতো শাখাগুলিতে পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে, অথচ গণিতকে বিবেচনার আওতায় আনা হচ্ছে না, তখন তিনি বিশিষ্ট গণিতবিদ হিসেবে গণিতের বিকাশের স্বার্থে নোবেলের সমপর্যায়ে একটি পুরস্কার চালু করার দাবি করলেন।
মারিয়াস সোফিয়ুস লী তাঁর জীবৎকালে তাঁর দাবি নিয়ে কারো মধ্যে উল্লেখযোগ্য সাড়া পেলেন না। ১৯০২ খ্রিস্টাব্দে সুইডেন ও নরওয়ের রাজা দ্বিতীয় অস্কার ইঙ্গিতে জানালেন যে তিনি গণিতের জন্য নোবেল পুরস্কারের সঙ্গে তুলনীয় একটি পুরস্কার প্রবর্তন করতে আগ্রহী। ইতিমধ্যে ১৯০১ থেকে নোবেল পুরস্কার চালু হয়ে গিয়েছে।
১৯০১ এ পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন জার্মানির উইলহেল্ম কনরাড রন্টজেন (১৮৪৫ – ১৯২৩), রসায়নে পুরস্কৃত হয়েছেন নেদারল্যান্ডসের বিজ্ঞানী জ্যাকোবাস হেনরিকাস ভ্যান্ট হফ ( ১৮৫২ – ১৯১১) এবং মেডিসিনে পুরস্কৃত হয়েছেন জার্মান বিজ্ঞানী এমিল অ্যাডলফ ভন বেহরিং ( ১৮৫৪ – ১৯১৭)।
কিন্তু রাজার আগ্রহ সত্ত্বেও গণিতে বিশ্বমানের পুরস্কার চালু হল না, কেননা, ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে সুইডেন আর নরওয়ে আর ঐক্যবদ্ধ রইল না, বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। তাইতে গণিতের পুরস্কারের প্রসঙ্গ গেল থমকে।
শেষে প্রায় একশত বৎসর পেরিয়ে, ২০০১ খ্রিস্টাব্দে নরওয়ের সরকার স্থির করলেন যে আবেল এর সম্মানে গণিতের জন্য বিশ্বমানের পুরস্কার প্রতিষ্ঠা করা হবে, এবং তাকে গড়ে তোলা হবে নোবেল পুরস্কারের পর্যায়ে।
নরওয়ের বিজ্ঞান ও সাহিত্য আকাদেমি গণিতের পুরস্কারের যোগ্যদের খুঁজে বের করতে আবেল কমিটি তৈরি করলেন। আবেল পুরস্কারের জন্য একটি বোর্ড গঠিত হল। তার পরিচালনায় রইলেন নরওয়ের ম্যাথমেটিকাল সোসাইটি। ওঁরা আবেল সিম্পোসিয়াম গঠন করলেন। বছরে দুবার করে তাঁদের বৈঠক হবে, এমন স্থির হল।
সেটা ছিল ২০০১ খ্রিস্টাব্দের আগস্ট মাস। নরওয়ের সরকার ঘোষণা করলেন পর বৎসর ২০০২ থেকেই নিলস হেনরিক আবেল এর জন্মের দ্বিশতবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর সম্মান স্মারক হিসেবে পুরস্কার দেওয়া শুরু হবে।
এদিকে তখনো সব কমিটিগুলি নির্দিষ্ট রীতিপদ্ধতি মেনে উপযুক্ত পুরস্কার প্রাপকের নাম চূড়ান্ত করে উঠতে পারেন নি। তাই যাতে আবেলের জন্মের দ্বিশতবার্ষিকী বৃথা পেরিয়ে না যায় সেজন্য নরওয়ের গণিতবিদ অ্যাটলি সেলবার্গ ( ১৪ জুন ১৯১৭ – ৬ আগস্ট ২০০৭) কে সাম্মানিক পুরস্কার দেওয়া হয়। এটাকে ঠিক ঠিক আবেল পুরস্কার বলা ঠিক হবে না। কেননা নির্দিষ্ট রীতিপদ্ধতির ভিতর দিয়ে সেলবার্গ এর নাম উঠে আসে নি। তবে সেলবার্গ ছিলেন অত্যন্ত সমাদৃত একজন গুণী গণিতবিদ। অ্যানালিটিক্যাল নাম্বার থিওরি এবং থিওরি অফ অটোমরফিক ফর্মস নিয়ে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ অবদান ছিল। বিশেষ করে তিনি ওই থিওরি দুটির সঙ্গে স্পেকট্রাল থিওরির সঙ্গতিবিধান করেছিলেন। সেলবার্গ ইতিমধ্যেই গণিতের সেরা সেরা পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছিলেন। ১৯৫০ এ তিনি ফিল্ডস মেডেল পেয়েছেন। ১৯৮৬ তে পেয়েছেন উলফ পুরস্কার। এছাড়াও ওই ২০০২তেই তিনি আরো পেয়েছেন গাননেরাস মেডেল। সুতরাং সেলবার্গ এর গ্রহণযোগ্যতা ছিল প্রশ্নাতীত।
প্রকৃত অর্থে কঠোর বাছাই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রাপক মনোনয়ন করে আবেল পুরস্কার দেওয়া শুরু হল ২০০৩ থেকে।
একুশ বছর ধরে আবেল পুরস্কার প্রদান চলছে। বর্তমান ২০২৩ পর্যন্ত মোট ছাব্বিশজন বরেণ্য গণিতবিদ আবেল পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন।
২০০৪, ২০০৮, ২০১৫, ২০২০ এবং ২০২১ খ্রিস্টাব্দে দুজন করে গণিতবিদ মনোনীত হয়েছিলেন। এই একুশটি বছরে ছাব্বিশ জন সম্মানিত গণিতবিদদের মধ্যে একজনই মাত্র মহিলা গণিতবিদ সম্মানিত হয়েছেন। তিনি কারেন আহলেনবেক।
আমেরিকান গণিতবিদ কারেন কেসকুল্লা আহলেনবেক ( ২১ আগস্ট ১৯৪২ -) ক্যালকুলাস অফ ভ্যারিয়েশনস, জিওমেট্রিক অ্যানালিসিস, মিনিম্যাল সারফেস এবং ইয়াং-মিলস থিওরির জন্য প্রখ্যাত। ২০১৯ খ্রিস্টাব্দে আহলেনবেক কে আবেল পুরস্কারে সম্মানিত করার সময়ে জিওমেট্রিক পারশিয়াল ডিফারেনশিয়াল ইকুয়েশনস, গজ থিওরি, ইনটিগ্রেবল সিস্টেমস বিষয়ে তাঁর অনন্য অবদানের কথা উল্লেখ করা হয়। বলা হয় যে, আহলেনবেক এর গবেষণায় গণিতভিত্তিক পদার্থবিজ্ঞানে গুরুত্বপূর্ণ উন্নতি হয়েছে।
আবেল পুরস্কারে সম্মানিত গণিতবিদদের মধ্যে একজন আছেন যাঁর পরিচিতির শিকড়টি ভারতে। তিনি আমেরিকার নিউ ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের কোউর্যান্ট ইনস্টিটিউট এর সথামঙ্গলম রঙ্গ আয়েঙ্গার শ্রীনিবাস বরাধন ( ২ জানুয়ারি ১৯৪০ – )। তিনি সম্মানিত হয়েছেন প্রোব্যাবিলিটি থিওরিতে তাঁর মৌলিক অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে। বিশেষ করে তিনি লার্জ ডেভিয়েশনের ক্ষেত্রে একটি ইউনিফায়েড থিওরি গড়ে তুলেছেন।
আবেল পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানটি আয়োজিত হয় নরওয়ের অসলো বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্যাকাল্টি অফ ল’এর ডোমাস মিডিয়া ভবনের আউলা অর্থাৎ হলে। বলা দরকার, ১৯৪৭ থেকে ১৯৮৯ অবধি ওখানেই নোবেল পুরস্কার প্রদানের অনুষ্ঠানটি হত। ২০১৯ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আবেল পুরস্কারের আর্থিক মূল্যমান ছিল ছয় মিলিয়ন নরওয়েজিয়ান ক্রোনর। তারপর এর মূল্যমান আরো বাড়িয়ে সাড়ে সাত মিলিয়ন নরওয়েজিয়ান ক্রোনর করা হয়েছে। আমেরিকান ডলারে এর মূল্যায়ন করলে হয় সাড়ে আট লক্ষ ডলার।