|| গ্রন্থাগার: মরণ হতে যেন জাগে || লিখেছেন মৃদুল শ্রীমানী

জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর। বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন। চাকরীসূত্রে ও দৈনন্দিন কাজের অভিজ্ঞতায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের সমস্যা সমাধানে তাঁর লেখনী সোচ্চার।

গ্রন্থাগার: মরণ হতে যেন জাগে

গ্রন্থাগার মানবসভ‍্যতার অনন্য সম্পদ। বহুদিন ধরেই মানুষ লিখিত আকারে মনের ভাব প্রকাশ করেছে। আর তা সংরক্ষণ করার চেষ্টা করেছে। অমূল্য গ্রন্থরাজির মধ‍্যে রয়ে গিয়েছে মানবের জ্ঞানের ভাণ্ডার।
আজকের দিনে সরকার ও রাষ্ট্র সাধারণ মানুষের সুবিধার কথা ভেবে গ্রন্থাগার গড়ে তোলে। সাধারণ মানুষের উদ্যোগেও গ্রন্থাগার হয়। বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গড়ে ওঠে গ্রন্থাগার। অফিস কাছারিতেও গ্রন্থাগার থাকে। বিশেষায়িত গ্রন্থাগার থাকে গবেষণা প্রতিষ্ঠানে। আর ধর্মমন্দিরেও প্রাচীন পু়ঁথি রক্ষিত হয়।
নামজাদা পণ্ডিত গবেষকদের ব‍্যক্তিগত আগ্রহে নিজস্ব গ্রন্থাগার গড়ে ওঠে। নেপোলিয়নের নিজস্ব বইয়ের সংগ্রহ ছিল। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ‍্যাসাগর  মহাশয়ের পুস্তক সংগ্রহ লোকে কৌতূহলভরে দেখতে আসত। আর ধারে এবং ভারে সারা পৃথিবীতে উল্লেখযোগ্য ব‍্যক্তিগত গ্রন্থ সংগ্রহ ছিল টমাস জেফারসন এর, সেই যিনি আমেরিকার স্বাধীনতার সনদের মূল খসড়া করেছিলেন।
 তবে ব‍্যক্তিগত সংগ্রহ যতই মূল‍্যবান হোক না কেন পৃথিবীর সেরা গ্রন্থাগারের সংগ্রহের তুলনায় তা নেহাতই অকিঞ্চিৎকর। পৃথিবীর বড় বড় লাইব্রেরিগুলি শুধুমাত্র পুস্তকসংখ‍্যার হিসেবেই দেখনসই নয়, বিষয়বস্তুর বৈচিত্র্যে ও ব‍্যাপকতায়, বই কেনা ও সংরক্ষণ করার বাজেটে ও কর্মীসংখ‍্যার বিচারেও তারা অনেক এগিয়ে।
আজকের পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি যাকে বলা হয়, তা হল ব্রিটিশ লাইব্রেরি। দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের লাইব্রেরি অফ কংগ্রেস। তৃতীয় স্থানে রয়েছে চীনের সাংহাই লাইব্রেরি। নিউইয়র্কের পাবলিক লাইব্রেরি বিশ্বের মধ‍্য চতুর্থ। ফ্রান্সের ঐতিহ্যমণ্ডিত লাইব্রেরি বিবলিওথেক নাশিওনেল বড়ত্বের হিসেবে সামান্য একটু পিছনে থাকলেও চালু সর্ববৃহৎ লাইব্রেরিগুলির মধ‍্যে সর্বাপেক্ষা প্রাচীন। আজ থেকে ৫৬০ বৎসর আগে ১৪৬১ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ডেনমার্কের লাইব্রেরিও বেশ প্রাচীন। ১৬৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত। রাশিয়ার আকাদেমি অফ সায়েন্সেস এর লাইব্রেরি স্থাপন করা হয়েছিল ১৭১৪ সালে। রাশিয়ার জাতীয় লাইব্রেরির বয়স হল ২২৬ বৎসর। প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৭৯৫ সালে।

আজ যেটা রাশিয়ার স্টেট লাইব্রেরি সেটাই ছিল রাশিয়ার সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি। নাম ছিল লাইব্রেরি অফ দি মস্কো পাবলিক মিউজিয়াম বা রুমিয়ানতসেভ লাইব্রেরি। প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল ১৮৬২ সালের ১ জানুয়ারি তারিখে। তারপর ১৯২৫ সালে একে পরিচিত করানো হল ভি আই লেনিন স্টেট লাইব্রেরি নামে। ১৯৯২ সালে বরিস ইয়েলতসিন এর ডিক্রিতে এর নাম হয়ে গেল রাশিয়ান স্টেট লাইব্রেরি।
 আজকের বিশ্বের সবচেয়ে বড় লাইব্রেরিটি আগে ব্রিটিশ মিউজিয়ামের অংশ ছিল। এই মিউজিয়ামের রিডিং রুমে কার্ল মার্কস, অস্কার ওয়াইল্ড, মহাত্মা গান্ধী, রুডিয়ার্ড কিপলিং, জর্জ অরওয়েল, মার্ক টোয়েন, লেনিন এবং এইচ জি ওয়েলস এর মতো স্বনামধন্য ব‍্যক্তিগণ পাঠাভ্যাস করেছেন।
পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন লাইব্রেরিটি ছিল অসুরবাণীপালের। খ্রীস্টপূর্ব সপ্তম শতাব্দীর বিস্ময় এটি। মাটির টালির উপর কিউনিফর্ম বা কীলক লিপিতে ছাপ তুলে পুড়িয়ে পাকা করা ত্রিশহাজার ট‍্যাবলেট। এখানেই ছিল চার হাজার বছরের পুরোনো গিলগামেশ মহাকাব‍্য।
 ইরাকের নিনেভে শহরের এই লাইব্রেরি আবিষ্কার করেছিলেন অস্টেন হেনরি লায়ার্ড। তিনি সেনাখেরিব (৭০৫ – ৬৮১ খ্রী পূ) এর সংগ্রহ খুঁজে পান। কিছু কাল পরে তাঁর ছাত্র হরমুযদ রানাম রাজা অসুরবাণীপাল (৬৬৮ – ৬২৭ খ্রী পূ) এর সংগ্রহ খুঁজে পান।
 ইরাকের অন‍্যান‍্য সুপ্রাচীন লাইব্রেরিগুলি হল নিপ্পুর উপাসনাগৃহের সংগ্রহ, নুজি এবং হাউস অফ উইজডম।
আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরিটিও ছিল বিখ‍্যাত। ভারতের সুপ্রাচীন লাইব্রেরিগুলির মধ‍্যে বিখ্যাত ছিল তক্ষশীলা, নালন্দা, বিক্রমশীলা, কাঞ্চিপুরম, শারদাপীঠের গ্রন্থসংগ্রহ।
আবার ফিরে আসি আজকের লাইব্রেরি বিষয়ক কথায়। ১৭৮৩ সালে জেমস ম‍্যাডিসন একটি বৃহৎ ও সর্বার্থসাধক লাইব্রেরির কথা ভেবেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন নবগঠিত আধুনিক রাষ্ট্রের নেতাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও কার্যপদ্ধতি আধুনিক করে গড়ে দিতে লাইব্রেরি একটা উজ্জ্বল ভূমিকা নিক। জন অ্যাডামস প্রেসিডেন্ট পদে এসে সেই ইচ্ছার রূপায়ণ করলেন। ১৮০০ সালের ২৪ এপ্রিল আমেরিকার কংগ্রেসের এই লাইব্রেরি যাত্রা শুরু করে। রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ও রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের বিশেষ আগ্রহে এই লাইব্রেরি গড়ে ওঠায় প্রথম থেকেই তহবিল ও অন‍্যান‍্য সুযোগের সমস‍্যা ছিল না। এই লাইব্রেরিকে বিশেষ ভাবে বিকশিত ও পুষ্পিত করে তুললেন টমাস জেফারসন।
জেফারসন (১৩ এপ্রিল ১৭৪৩ – ০৪ জুলাই ১৮২৬) ছিলেন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের তৃতীয় রাষ্ট্রপতি। কিন্তু তাতেই তাঁর পরিচয় সীমিত ছিল না। তিনি ছিলেন আদ‍্যন্ত একজন দেশনায়ক যাঁকে প্রকৃত অর্থে স্টেটসম‍্যান বলা যায়। রাজনৈতিক দলের পরিচয়ে তিনি ছিলেন ডেমোক্র‍্যাটিক রিপাবলিকান। আর আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটনের সময়ে ১৭৯০ থেকে ১৭৯৩ অবধি তিনি আমেরিকার সেক্রেটারি অফ স্টেট ছিলেন। দ্বিতীয় রাষ্ট্রপতি জন অ্যাডামস এর সময়ে ১৭৯৭ থেকে ১৮০১ অবধি তিনি ছিলেন উপরাষ্ট্রপতি। আমেরিকার দ্বিতীয় ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন জেফারসন।
 জন অ্যাডামসের আগ্রহে জেফারসনকে আমেরিকার স্বাধীনতা সনদের মূল খসড়া তৈরি করার দায়িত্বভার অর্পণ করা হয়। সেটিকে সম্পাদনায় একটু সহযোগিতা করেছিলেন জন অ্যাডামস ও বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন।

এই জেফারসন ছিলেন জ্ঞানরাজ‍্যের তাপস। রাজনৈতিক সমাজনৈতিক দর্শনের সক্রিয় চর্চার পাশাপাশি তিনি ছিলেন কূটনৈতিক ব‍্যক্তিত্ব, আইনজীবী, আর্কিটেক্ট, মিউজিসিয়ান। ভাষাতত্ত্বে জেফারসনের প্রবল অনুরাগ ছিল। এছাড়া জরিপবিদ‍্যা, গণিত, উদ‍্যানবিদ‍্যা, বলবিদ‍্যা, ধর্মতত্ত্ব এমনকি ফলিত কৃষিবিজ্ঞান, পশুপালন প্রভৃতিতে তাঁর প্রগাঢ় অধিকার ছিল। আমেরিকার তৃতীয় রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হবার পর তিনি আমেরিকান ফিলজফিক‍্যাল সোসাইটির প্রেসিডেন্ট হন, এবং সুদীর্ঘ পঁয়ত্রিশ বৎসর কাল তিনি সেই পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন। এই জ্ঞানতাপসের নিজস্ব পুস্তক সংগ্রহ ছিল বিরাট। কংগ্রেসের লাইব্রেরির কাজকর্ম কিভাবে সংগঠিত হবে, পুস্তক সংগ্রহ কিভাবে বিন‍্যস্ত হবে, তা জেফারসন স্থির করে দিয়েছিলেন। জেফারসনের বিপুল ও মূল‍্যবান ব‍্যক্তিগত সংগ্রহ এই কংগ্রেস লাইব্রেরির অঙ্গীভূত হয়।
আজ থেকে ২২১ বৎসর পূর্বে ১৮০০ সালের ২৪ এপ্রিল এই আমেরিকান কংগ্রেসের লাইব্রেরি প্রতিষ্ঠিত হয়। এটিই বাস্তব পক্ষে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় গ্রন্থাগার। এটিই সে দেশের প্রাচীনতম ফেডারেল সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান। ওয়াশিংটন ডিসি শহরের ক‍্যাপিটল হিল এলাকায় তিনটি ভবনে এই লাইব্রেরি আমেরিকার কংগ্রেসের সদস্যদের রিসার্চ লাইব্রেরি হিসেবে গড়ে উঠেছে। সারা পৃথিবীর বিভিন্ন কোণ থেকে সংগৃহীত বই এখানে এসেছে। এখানে সাড়ে চারশ’রও বেশি সংখ্যক ভাষায় লেখা বই রয়েছে। এই সময়ে এই লাইব্রেরির সংগ্রহে আটত্রিশ মিলিয়ন পুস্তক ও ১৬৭ মিলিয়ন সাংস্কৃতিক সম্ভার। ৩১০৫ জন কর্মী এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন। বর্তমানে এই লাইব্রেরির বার্ষিক বাজেট ৬৮৪.০৪ মিলিয়ন ডলার।
নানাবিধ কারণে কংগ্রেসের এই লাইব্রেরি সারা পৃথিবীর সবসেরা লাইব্রেরিগুলির অন‍্যতম। সারা পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সংখ‍্যক আইনের বইয়ের সংগ্রহ রয়েছে এখানে। তার সংখ‍্যা হল ২.৯ মিলিয়ন। বিরল গ্রন্থের বিপুলতম সংগ্রহ ও এখানে। একশত সংখ্যক অত‍্যন্ত বিরল শিশুপাঠ‍্য পুস্তকের সংগ্রহ এখানে রয়েছে। পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট সাইজের বই যার মাপ ১/২৫ ইঞ্চি বাই ১/২৫ ইঞ্চি, তা যেমন এখানে রয়েছে, তেমনই পৃথিবীর সবচাইতে বড় সাইজের বই, যার মাপ পাঁচ ফুট বাই সাত ফুট, সেটিও এখানে রয়েছে। এখানে রয়েছে গুটেনবার্গ বাইবেল। রয়েছে ৭৭০ খ্রীস্টাব্দে ছাপ তোলা বৌদ্ধসূত্র। এমনকি খ্রীস্টপূর্ব ২০৪০ এর কিউনিফর্ম ট‍্যাবলেট।
আমেরিকার নবজাগরণে অসন্তুষ্ট হয়ে পূর্বতন প্রভু ও শাসক ব্রিটিশ সরকার ১৮১২ সালে এই নবগঠিত রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণা করে। একে বলা হয় ১৮১২-র যুদ্ধ। এই যুদ্ধে ব্রিটিশ বাহিনী আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবন ধ্বংস করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। তার মধ‍্যে অন‍্যতম ছিল আমেরিকার কংগ্রেসের লাইব্রেরিটি। ১৮১৪ সালের ২৪ আগস্ট তারিখে ব্রিটিশ বাহিনী এই লাইব্রেরিটি পুড়িয়ে দিয়েছিল। জেফারসন প্রমুখের বিপুল চেষ্টায় ১৮১৫ সালের জানুয়ারির ৩০ তারিখে এই প্রতিষ্ঠান পুনর্জীবিত হয়। জেফারসনের ব‍্যক্তিগত সংগ্রহের ৬৪৮৭টি বই এই লাইব্রেরি ২৩৯৫০ ডলার মূল্যে সংগ্রহ করেন। অগ্নি দুর্ঘটনা কংগ্রেসের এই লাইব্রেরিকে ছাড়ে নি। ১৮৫১ সালের ১৪ ডিসেম্বর তারিখে এই প্রতিষ্ঠান পুনরায় আগুনের কবলে পড়ে।
ব্রিটিশ সরকারের অধীনে ব্রিটিশ বাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে কংগ্রেসের লাইব্রেরি ধ্বংস করেছিল। তারিখটা চব্বিশ আগস্ট, ১৮১৪। ঠিক তার শতবার্ষিকীতে ১৯১৪ সালের ২৫ আগস্ট তারিখে বেলজিয়ামের লুভ‍্যাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিকে ইচ্ছাকৃতভাবে ধ্বংস করেছিল জার্মান বাহিনী। অথচ অনেক আগে থেকেই যুদ্ধ পরিস্থিতিতে বেলজিয়াম নিরপেক্ষ থাকতে চেয়ে ঘোষণা করেছিল এবং সে বাবদে ১৮৩৯ সালে লণ্ডন চুক্তি সম্পাদন করেছিল। প্রাশিয়া তাতে স্বাক্ষর ও করেছিল। কিন্তু জার্মান চ‍্যান্সেলর থিওবল্ড ভন বেথমান হলওয়েগ সমস্ত প্রোটোকল উড়িয়ে দিয়ে লণ্ডন চুক্তিকে ছেঁড়া কাগজের চাইতে বেশি সম্মান না দেখিয়ে বেলজিয়ামের উপর দিয়ে সেনাবাহিনী চালিয়ে দেন ও সেই বাহিনী যথেচ্ছভাবে ধ্বংসলীলা চালায়।
লুভ‍্যাঁ বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিতে ছিল ২৩০,০০০ টি মূল‍্যবান গ্রন্থ, ৯৫০টি পুঁথিপত্র ও ৮০০ ইনকিউবুলা বা প্রাচীন মুদ্রিত বস্তু। জার্মান গুণ্ডামিতে সক‌লই ভস্মস্তুপে পরিণত হয়।
ইচ্ছাকৃতভাবে লাইব্রেরি পোড়ানোর ইতিহাস বহু প্রাচীন। বিখ্যাত রোম সম্রাট জুলিয়াস সীজার পম্পেই এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে ৪৮ খ্রীস্টপূর্বাব্দে আলেকজান্দ্রিয়ার অসামান্য লাইব্রেরি দগ্ধ করান। তাঁর সেনাবাহিনীকে দিয়ে এই কাজ করানো হয়। অনেক চেষ্টায় আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরি পুনর্গঠিত হলে ২৭২ খ্রীস্টাব্দে রোম সম্রাট অরেলিয়ান আবার তা দগ্ধ করান। আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরির দুটি অংশ ছিল, অন্তর্বিভাগের নাম ছিল মৌসিওন, আর বহির্বিভাগের নাম ছিল সেরাপিউম। দুটিই ধ্বংস করা হয়।
মিশরের ঐতিহ্যবাহী নগরী আলেকজান্দ্রিয়াতে একটি রিসার্চ ইনস্টিটিউশনের লাইব্রেরি হিসেবেই আলেকজান্দ্রিয়ার গ্রন্থাগার গড়ে উঠেছিল। মৌসিওন ছিল নয়জন মিউজ দেবীর উদ্দেশে উৎসর্গীকৃত। এটিই ছিল মূল ও প্রধান গ্রন্থাগার। এথেন্সের বিশিষ্ট চিন্তাবিদ দিমিত্রিয়াস অফ থ‍্যালেরিয়াম দেশ থেকে নির্বাসিত হয়ে আলেকজান্দ্রিয়ায় অবস্থান করার সময়ে সেখানে একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরির কথা ভাবেন। তিনি এ ব‍্যাপারে সম্রাট প্রথম টলেমি সোটারকে প্রস্তাব দিলে সম্রাট তা গ্রহণ করে পরিকল্পনার কথা ভাবেন। দ্বিতীয় টলেমি ফিলাডেলফাসের আমলে মূল লাইব্রেরি গড়ে ওঠে। এই মহতী প্রতিষ্ঠানে জেনোডোটাস অফ এফেসুস কাজ করেছেন। তিনি পিনাকেস নামে বিশ্বের প্রথম লাইব্রেরি ক‍্যাটালগ বানিয়েছিলেন। এখানে কাজ করেছেন অ্যাপোলোনিয়াস অফ রোডস। কাজ করেছেন এরাটোস্থেনিস, অ্যারিস্টোফানেস এবং অ্যারিস্টার্কাস প্রমুখ বিদগ্ধ মানুষেরা। তৃতীয় টলেমি ইউয়েরগেটেস এর আমলে মিশরীয় দেবতা সেরাপিস এর প্রতি শ্রদ্ধায় সেরাপিউম নামে উপ গ্রন্থাগারটি গড়ে ওঠে।
আলেকজান্দ্রিয়ার লাইব্রেরিটি ধ্বংস করার বহু পরে তাকে পুনর্গঠনের কাজ হয়েছে। আলেকজান্দ্রিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট ছিলেন লটফাই ডাউয়িডার। তিনি ১৯৭৪ সালে একটি পুনর্গঠন প্রস্তাব দেন। মিশরের রাষ্ট্র কর্তৃপক্ষের তরফে ইউনেসকোর কাছে এই পুনর্গঠন বাবদে একটি অনুরোধ জানানো হলে ইউনেসকো ১৯৮৮ সালে তা গ্রহণ করেন। তারপর মিশরের প্রেসিডেন্ট হোসনি মুবারকের চেষ্টায় বিবলিওথেক আলেকজান্দ্রিয়ার নবজন্ম হল ২০০২ সালে।
প্রাচীন ভারতের উল্লেখযোগ্য গ্রন্থাগার ছিল নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধ লাইব্রেরি ছিল। লাইব্রেরির নাম ছিল ধর্মগুঞ্জ । এর অর্থ হল সত‍্যের পর্বত।   নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে চৈনিক জ্ঞানতাপস হিউয়েন সাং এসেছিলেন। আরো অনেক দিন আগে এসেছিলেন ভগবান গৌতম বুদ্ধ। তারও আগে এসেছিলেন মহাবীর জিন। শোনা যায় তিনি নালন্দায় চৌদ্দটি বর্ষা ঋতু যাপন করেছিলেন। পঞ্চম শতাব্দী থেকে নবম শতাব্দী অবধি এই বিশ্ববিদ্যালয়ের গৌরবময় যুগ। তারপর অন‍্যান‍্য স্থানে আরো বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে উঠলে নালন্দার সুনামে ঘাটতি শুরু হয়। প্রথমে হুণরা এই বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণ করে এই ধর্মগুঞ্জ লাইব্রেরিকে ধ্বংস করে। কিছুকাল পরে আবার গড়ে তোলা হলে গৌড়রাজের বাহিনী নালন্দা পুনরায় ধ্বংস করে। সর্বশেষ ও সর্বাত্মক আক্রমণটি করেছিলেন বখতিয়ার খিলজি। তাঁর আক্রমণে নালন্দা শেষ হয়ে যায়।
 তুর্ক আফগান সমরনায়ক ইখতিয়ার আল দীন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খিলজি ১২০০ খ্রীস্টাব্দে শুধুমাত্র নালন্দা ধ্বংস করে তৃপ্তি লাভ করেন নি। ওদন্তপুরী এবং বিক্রমশীলা মহাবিহারও তাঁর ধ্বংসলীলার শিকার হয়েছে।
গত ২০১৪ সালে নোবেল জয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেনকে চ‍্যান্সেলর করে নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়েছে।
আক্রান্ত হয়ে ধ্বংস হবার ইতিহাস আছে বিশ্বের অন‍্যতম প্রাচীন  বিশ্ববিদ্যালয় তক্ষশীলার। এটি খ্রীস্ট জন্মের হাজার বছর আগে গড়ে উঠেছিল। এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ‍্যাপনা করেছেন পাণিনি, চাণক্য, কুমারলতা, এবং বসুবন্ধু প্রমুখ। বিখ্যাত ছাত্রদের মধ‍্যে ছিলেন কোশলরাজ পসেনদি, এবং সেই পসেনদির সেনাপতি বন্ধুলমল্ল। অঙ্গুলিমাল, জীবক, চরক, এবং চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এখানে ছাত্র হিসাবে পড়াশুনা করেছেন।
হুণরাজ তোরামানার আক্রমণে তক্ষশীলা ধ্বংস হয়ে যায়।
রাজনৈতিক দলের ক্ষুদ্র স্বার্থ চরিতার্থ করতে গ্রন্থাগারে অগ্নিসংযোগ করার ইতিহাস পশ্চিমবঙ্গে বিরল নয়। সরকারি রাজনৈতিক দলের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখানোর সহজিয়া রাস্তা এই লাইব্রেরি পোড়ানো সেদিনের বিরোধী আজকের শাসকের পছন্দের কাজ। বিজ্ঞ ও বিদ‍্যোৎসাহী মানুষ স্থানীয় গ্রন্থাগারকে রাজনৈতিক দলের নিম্ন রুচির শিকার হওয়া থেকে বাঁচাবেন।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।