ক্যাফে ধারাবাহিকে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৬)

অ্যাটমের গহন কথা

আর্নেস্ট রাদারফোর্ড ১৯১১ খ্রিস্টাব্দের প্রথম সলভে কনফারেন্সে যোগদান করেছিলেন। সেখানে ম‍্যাক্স প্ল‍্যাঙ্ক ও তরুণ বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন উপস্থিত ছিলেন। সলভে কনফারেন্সের প্রথম সমাবেশটি শুধুমাত্র পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ক সমস‍্যা সমাধানের জন‍্যই নির্দিষ্ট ছিল। সমাবেশের আলোচ‍্য বিষয় ছিল রেডিয়েশন এবং কোয়ান্টা। সলভে কনফারেন্সে পরমাণুর গঠন নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা হয়েছিল। আলোচনা করেছিলেন ম‍্যাক্স প্ল‍্যাঙ্ক এবং সমাবেশের চেয়ারম্যান হেনড্রিক আনতুন লোরেঞ্জ। রাদারফোর্ডের দেওয়া পরমাণু মডেল বাতিল হয়ে যাওয়াতে ম‍্যাক্স প্ল‍্যাঙ্ক বলেছিলেন: ধ্রুপদী তাপগতিবিদ‍্যায় পরিচিত ধারণা না হলেও পরমাণুর অভ‍্যন্তরে ইলেকট্রনের গতিধর্ম বুঝতে বোঝাতে কোয়ান্টাম ধারণা চর্চা প্রয়োজন। হেনড্রিক লোরেঞ্জ বলেছিলেন, পরমাণুর সাইজ বুঝতে প্ল‍্যাঙ্কের ধ্রুবক নিয়ে ভাবা দরকার। এইসূত্রে লোরেঞ্জ আর্থার এরিক হাসের পরমাণু মডেলের কথা উপস্থাপনা করেন।

রাদারফোর্ডের ছাত্র নিলস বোর প্রথম সলভে কনফারেন্সের কার্যবিবরণী তন্নিষ্ঠভাবে পাঠ করে বিশেষ করে ম‍্যাক্স প্ল‍্যাঙ্কের আলোচনার লিখিতরূপটি গভীরভাবে চর্চা করেছিলেন। নিলস বোর ম‍্যাক্স প্ল‍্যাঙ্কের বক্তব্য পাঠে এতটাই প্রভাবিত হয়েছিলেন যে পরমাণুর গঠন নিয়ে তাঁর প্রথম গবেষণাপত্রে প্ল‍্যাঙ্কের বক্তব্য উদ্ধৃত করেছিলেন। তাঁর গবেষণাপত্রের পাদটীকা লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সলভে কনফারেন্সের কার্যবিবরণী ও প্ল‍্যাঙ্ক ও লোরেঞ্জ এর বক্তব্য ও আর্থার এরিক হাসের দেওয়া পরমাণু মডেলের দ্বারা তিনি প্রবলভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন।
তাঁর গবেষণা পত্রে আর্থার এরিক হাস এর প্রসঙ্গ সতেরবার এসেছে। এছাড়াও জন উইলিয়াম নিকলসনের অ্যাটমিক তত্ত্ব যে বোরকে প্রভাবিত করেছিল, তা বহু ইতিহাসবিদই মনে করেন।
 স্পষ্টতই নিলস বোর রাদারফোর্ডের ধারণার সঙ্গে কোয়ান্টাম ধারণার মেলবন্ধন চেয়েছিলেন।
বিংশ শতাব্দীর গোড়ায় কোয়ান্টাম তত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞানের জগতে একটা বৈপ্লবিক পরিবর্তন সংঘটিত করে। দুই জার্মান তাত্ত্বিক পদার্থবিজ্ঞানী ম‍্যাক্স প্ল‍্যাঙ্ক ( ২৩ এপ্রিল ১৮৫৮ – ০৪ অক্টোবর ১৯৪৭) এবং অ্যালবার্ট আইনস্টাইন ( ১৪ মার্চ ১৮৭৯ – ১৮ এপ্রিল ১৯৫৫), দুই অসামান্য প্রতিভাধর ব‍্যক্তিত্ব, দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, আলো আলাদা আলাদা বিচ্ছিন্ন ভাবে বিকিরিত হয় অথবা শোষিত হয়। এই আলাদা আলাদা বিচ্ছিন্ন অংশগুলিকে বহুবচনে “কোয়ান্টা” এবং একবচনে “কোয়ান্টাম” বলে। কোয়ান্টাম কথাটার অর্থ “কতটা?” বিদ‍্যুতের কোয়ান্টা, তারই সংক্ষিপ্ত রূপ কোয়ান্টা কথাটা নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী ফিলিপ লেনার্ড ( ১৮৬২ – ১৯৪৭) ১৯০২ এ লেখা একটি আর্টিকেলে ব‍্যবহার করেছিলেন। লেনার্ড আবার বলেছিলেন, বিদ‍্যুৎ বিষয়ক আলোচনায় জার্মান বৈজ্ঞানিক হারমান ভন হেলমহোলৎজ ( ৩১ আগস্ট ১৮২১ – ৮ সেপ্টেম্বর ১৮৯৪) কোয়ান্টা কথাটা ব‍্যবহার করেছিলেন। ১৯০১ খ্রিস্টাব্দে ম‍্যাক্স প্ল‍্যাঙ্ক পদার্থ ও বিদ‍্যুতের যৎসামান্য ও বিচ্ছিন্ন টুকরো টুকরো পরিমাণ বোঝাতে কোয়ান্টা শব্দের প্রয়োগ করেন। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে প্ল‍্যাঙ্কের গবেষণা ও ফিলিপ লেনার্ডের পরীক্ষা নিরীক্ষা নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে অ্যালবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন ছোট ছোট প‍্যাকেটের মতো করে আলো বিকিরিত হয়। ওকে তিনি বললেন আলোর কোয়ান্টা বা জার্মান লব্জে “লিখটকোয়ান্টা”।
 উত্তপ্ত বস্তু থেকে তাপ কিভাবে বিকীর্ণ হয়, যাকে ব্ল‍্যাক বডি রেডিয়েশন বলে, তা বুঝতে গিয়ে মহাবিজ্ঞানী ম‍্যাক্স প্ল‍্যাঙ্ক বিকিরণের কোয়ান্টার ধারণা আবিষ্কার করে ফেলেন। সেটা ১৯০০ খ্রিস্টাব্দ। তিনি ধারণা করেছিলেন শক্তি একমাত্র ছোট ছোট বিচ্ছিন্ন প‍্যাকেটের মতো করে শোষিত ও বিকীর্ণ হয়। ওই ১৯০০ খ্রিস্টাব্দের ১৪ ডিসেম্বর তারিখে তিনি জার্মান ফিজিক্যাল সোসাইটির সভায় এই মত ব‍্যক্ত করেন।
কোয়ান্টা নিয়ে গবেষণার সূত্রে ম‍্যাক্স প্ল‍্যাঙ্ক একটি কণার শক্তি ও কম্পাঙ্ক, এদুটির মধ‍্যে সম্পর্ক নির্ধারণ করে ফেললেন। একেই বলা হয় প্ল‍্যাঙ্কের ধ্রুবক। একটি কোয়ান্টার কম্পাঙ্ককে প্ল‍্যাঙ্কের ধ্রুবক দিয়ে গুণন করলে তার শক্তির পরিমাণ নির্ধারণ করা যায়।
কোয়ান্টার ধারণার সঙ্গে নিউক্লিয়াসকে ঘিরে কক্ষপথে ঘূর্ণনরত ইলেকট্রনের ধারণার মেলবন্ধন করতে চেয়েছিলেন নিলস বোর। কোয়ান্টার ধারণা এর আগেও ১৯১০ খ্রিস্টাব্দে আর্থার এরিক হাস (১৮৮৪ – ১৯৪১) এবং ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে জন উইলিয়াম নিকলসন ( ১৮৮১ – ১৯৫৫) পরমাণুর গঠন নিয়ে আলোচনায় টেনে এনেছিলেন। নিলস বোর তাঁর পরমাণুর মডেলের ব‍্যাখ‍্যায় ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে কোয়ান্টার ধারণা টেনে আনলেন। সেখানে বোর বললেন, একটি ইলেকট্রন পরমাণুর কেন্দ্রক বা নিউক্লিয়াসকে একটি নির্দিষ্ট কৌণিক ভরবেগ ও শক্তিমাত্রা নিয়ে একটি নির্দিষ্ট বৃত্তীয় কক্ষপথে প্রদক্ষিণ করে।
বললেন, কেন্দ্রক বা নিউক্লিয়াস থেকে নির্দিষ্ট ইলেকট্রনের দূরত্ব কতটা, অর্থাৎ ইলেকট্রনটির কক্ষপথের ব‍্যাসার্ধটি তার শক্তিমাত্রার সঙ্গে সমানুপাতিক।
 বোর আরো বললেন, ইলেকট্রনটি কেন্দ্রক বা নিউক্লিয়াসকে প্রদক্ষিণ করতে করতে তার গায়ে আছড়ে পড়বে না, কেননা, এর ক্রমাগত শক্তিহ্রাস হবে না। ইলেকট্রনটি শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট শক্তিস্তর থেকে আরেকটি সুনির্দিষ্ট শক্তিস্তরে কোয়ান্টাম ঝাঁপ দেবে। যখন ওই রকম ঝাঁপ দেবে, তখন আলোক বিকীর্ণ হবে বা আলোক শোষিত হবে। এবং  তার কম্পাঙ্ক হবে শক্তিস্তরের পরিবর্তনের সমানুপাতিক। আলোর বিকিরণ ও শোষণ বর্ণালির সুনির্দিষ্ট পটিতে বোঝা যাবে।
নিলস বোর তাঁর পরমাণু মডেলের সম্বন্ধে এত কিছু আটঘাট বেঁধে বলতে চাইলেও কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল তাঁর মডেল শুধুমাত্র হাইড্রোজেনের মতো একটি সবেধন নীলমণি ইলেকট্রনওয়ালা পরমাণুর বর্ণালি রেখাবিন‍্যাসের কথাই বলতে পারছে। বহু ইলেকট্রন বিশিষ্ট পরমাণুর ব‍্যাপারে তা কিছু বলে উঠতে পারছে না। এমনকি হাইড্রোজেনের বর্ণালির ব‍্যাপারেও সব কিছু বলতে পারছে না। আরো পরিতাপের কথা এই যে, স্পেকট্রোগ্রাফি টেকনোলজি বা বর্ণালিবীক্ষণ প্রযুক্তি উন্নত হবার সাথে সাথে লক্ষ্য করা গেল, চৌম্বকক্ষেত্র প্রয়োগ করা হলে, বর্ণালির মধ‍্যে পটির সংখ‍্যা বেড়ে যেতে থাকে, কিন্তু তেমন কেন হচ্ছে, বোরের মডেল তার ব‍্যাখ‍্যা দিতে পারল না।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।