সাপ্তাহিক ধারাবাহিক উপন্যাসে হেমন্ত সরখেল (পর্ব – ৪)

তাপ-উত্তাপ

পর্ব – ৪

পর্দাটা ফেলা | জোছনধোয়া উজোত জল বেশি দুধ কম করে রেখেছে রুমটাকে | দু’জনে পাশাপাশি শুয়ে | না চললে হয়তো ভবিষ্যতে হারিয়ে ফেলতে পারে নিজের পরিচয়, তাই ঘুরছে সিলিং ফ্যান | রেগুলেটর আছে একটা আলাদা সুইচবোর্ডে, তার হাল-হকিকত ঘরের মালিকই জানে | দরকার ছিল না, তত’টা গরম এখন নেই, তাই দেখিনি | এই স্তব্ধতাকে কেবল একটানা একটা বাধকচলন শব্দ ভাঙছে লয়বিক্ষেপে | সাথে পাক খাচ্ছে মাথায় রতন’দার চরিত্র, সত্যিই তো, ও চাইলেই সবটা নিয়ে হাপিস হয়ে যেতে পারতো | কেন গেল না ?
‘মানে ? জয় করেছ মানে ?’
‘এটা আমার আমি নই রে ! আমার আমিটা বড্ড নোংরা, জান্তব খিদে তার | আমার আমিটাকে টুনিদিঘিতে ছেড়ে এসেছি চিরকালের মতো | দুটো বুলেট আর মরবো তিনজন, ওরা সুযোগ দিলো না আমায় | পুলিশের অত্যাচার সইতে হবে বলে স্বার্থপরের মতো আমায় একা রেখে দুজনে চলে গেল পরপর | সে আওয়াজে জেগে উঠলো আমাদের পশ্চাদবর্তী শ্বাপদের কান | ওরা জানতো না, আমরা তিনজন, তাই, পাট ক্ষেতের মধ্যে শুয়ে দেখেছিলাম, ওরা ঠ্যাং ধরে হিঁচড়ে টেনে নিয়ে গেল গাড়ি অবধি অসিত আর নিলয়কে | তার আগেই দালখোলায় মরেছে আমাদের টিমলিডার কৃষ্ণ’দা | আমাদের ওপর ভার ছিল টাকাগুলো ঘরে ঘরে দিয়ে দেওয়ার | লিস্ট ধরে দিয়েও চলেছিলাম তিন দিন ধরে | দুম করে খবরটা লিক হয়ে গেল, তবে অপুষ্ট | প্রাণে বেঁচে গেলাম টাকার ব্যাগসমেত আমি | এত কাছ থেকে এমন সহজভাবে ওদের চলে যাওয়াটা নাড়িয়ে দিল আমায় | কাকে বলে জীবন ? কেন এত হায়-তওবা বেঁচে থাকার জন্য ? এই তো সাথে কয়েক লক্ষ টাকা ! এটাও কি জীবনকে সুরক্ষিত করতে পারে না ? তাহলে এর মূল্যই বা কোথায় ? এই পৃথিবীতে, তুই চাইলে প্রায় সবকিছুকেই হ্যাঁ বলতে পারবি,একমাত্র ভরা পেটে, খাদ্যকে না বলবি, কারণ অতটুকুই তোর সাধ্য | চাইলেও একসাথে যত খুশি তত খেতে পারবি না, একটা সময় বলতেই হবে- ব্যস, আর না ! পাটগাছের জঙ্গলে শুয়ে শুয়ে ভাবলাম, এ কোথায় শুয়ে আছি ? কেন আছি ? কতটুকু লাগে বেঁচে থাকতে ? অতটুকু তো চেষ্টা করলে সকলেই রোজগার করতে পারে | তাহলে এই লুট-মারের প্রয়োজনটা কোথায় ? সকালে টাকাটা ঘরামির হাতে তুলে দিয়ে, চলে এলাম | এলাম অনেক জদ্দোজহদ করে, গ্রাম, নদী,মাঠ ভেঙে | এসে দেখি ওরা মা-বাবু’কে তুলে নিয়ে গেছে | সে অন্য কাহন | রাত ভোর হয়েও ফুরাবে না | তবে, জয় করলাম লোভ | পথ চলতে চলতে এখন প্রয়োজনটুকু মিটলেই খুশি আমি | তুই এদিকে ভাবছিস, রতনা অ্যাটাচি নিয়ে কেটে পড়েছে আর আমি ভাবছি এই অতুল্য সম্পদের টাটকা পোয়াতি উচ্চতা সামলাতে হলে তোকে কী কী শেখাতে হবে ! গরম বরদাস্ত হয় না রে সবার, বিশেষ করে টাকা পয়সার |’
জানি | খুব জানি | নগদ টাকার গরম, বাষ্প হয়ে আগে পোড়ায় বুদ্ধি, সে আগুনের আঁচে পিণ্ডে পরিণত হয় বিবেক | অহং হয়ে ওঠে প্রকৃত সুহৃদ, শুঁরি’র সাক্ষী হিসেবে তার সঙ্গে উল্লাসে মেতে মাতাল হয় রসনা | যাকে যা নয় তাই বলা যায়, করা যায় যা-চ্ছে-তা-ই | তাপ দীর্ঘায়িত হয় উত্তাপে | উত্তাপের চোখ ঝলসানো প্রকাশ চিনে নিতে থাকে সিংহাসন, পায়ের ঠিক সামনেটায় নজর পড়ে না | সমগ্র অস্তিত্ত্ব জুড়ে তখন সাম্রাজ্যবাদী হুংকার, দাউ দাউ করে জ্বলছে স্বর্ণচ্ছটা, আনাভিলম্বিত চেন প্রদর্শনের জন্য কামিজ বোতামহীন, হাতের আঙুলে অঙ্গুরীয় সোল্লাস, চোখের মণি ঢাকতে রোদনিরোধক চশমা ! অনায়াসে ঠোকর মেরে এগিয়ে চলে অর্ধম্মৃত শরীর, তখন মনে ভাবনা চলে, বীরভোগ্যা বসুন্ধরা, মুখ বলে- সকলি তোমারি ইচ্ছা | চরিত্রের দোগলাপনা তখন চাতুর্য,কৌশল, অগ্রগতির | দেদীপ্যমান সোপানের হাতছানি চঞ্চল করে, যেমনটা দেখছি লোকাল কমিটির মাথায় বসা বেলেল্লেগুলোর মধ্যে | কখন যেন চোখ লেগে গেল, কতো কী বকছে রতন’দা !
সাতাশ দিন পর নিজের স্টেশনে পা রাখলাম | হলুদ শার্ট,সেই কালো প্যান্টটাই পরিধান | মুরারী দেখে হাসলো | লৌটকে বুদ্ধু ঘর কো আয়ে | রতন’দাকে দেখে ভ্রূ কোঁচকালো |
‘কোথায় ডুব মারলি হঠাত্ করে ? হিরো গায়েব! পিকচার তো ফ্লপ হয়ে যাবে গুরু !’
‘ঠিকঠাক আছে সব ?’
‘থাকে কখনও ? দেবেশ নতুন জি.এস. | এ তো বায়বিয় প্লট ! ফটাফট হয়ে যায় শূন্যস্থান পূরণ | যা, বাড়ি যা, কাকি পাগলের মতো করছে | বিকেলে কথা হবে, বহুত কিছু জমা হয়ে আছে |’
রেললাইন ধরে হাঁটা | স্লিপারে স্লিপারে পা রেখে চলো | অসাবধান হয়ো না, পড়ে যাবে | শক্ত পাথরের টুকরোয় ছড়ে যাবে শরীরের অংশ | ব্যালান্স বানাও,ব্যালান্স, জীবনের অপর নাম ব্যালান্স | তাই, সদা সতর্ক থাকিবে, বুঝিয়া ফেলিবে পা | গেট পড়েছে, ট্রেন আসবে, ঘোষনাটা শুনেছি পেছন থেকে, দূরত্বে ল্যাপটানো থাকায় বুঝিনি | গেটের বাঁ দিকের রাস্তাটা ধরে এগিয়ে বিশ্বাস পাড়ার গলির দিকে মুড়ে যাব, রতন’দা মেন রোডটা চেনে, আজ এটা চিনিয়ে দিই | আসতে তো হবেই বারবার এখানে |
বন্ধ গেটের মুখে স্কুটারে দেবেশ, পেছনে! পেছনে নির্ঝর ! মুখটা অন্যদিকে ফেরানো | চোখ পড়তেই, আমায় দেখে মুচকি মারলো দেবেশ |
‘ কী খবর ? কোথা থেকে এলে ?’
‘চাকরি পেয়েছি একটা | সেখান থেকেই |’
‘ও, তা ভালো, এদিকে যা রায়তা ছড়িয়ে গেলে, তা সামলাতে তো পার্টির হাল খারাপ ! ভুল করেও যেন কলেজ বা কমিটির অফিসের দিকে যেও না ! অনেক কষ্টে ম্যানেজ করে রেখেছি | তোমায় দেখলেই হয়তো পরিবেশ মোচড় মারবে, আমার হাতের বাইরে চলে যেতে পারে সবটাই |’
‘আমি আর নেই ভাই, তুমিই সামলাও | এই চাকরিটা হয়তো একটু উত্তাপ ছড়াবে আমার পরিবারে | এসব আমার জন্যে নয় | এত অন্ধকারে আমি আর পথ চলতে পারলাম না | আমার তরফ থেকে সবাইকে স্যরি বলে দিও |’
‘হুঁ, বলবো |’
পেছনের সিট থেকে নেমে গেছে নির্ঝর কথা শুরু হতেই | এবার আমার হাতটা ধরে টেনে আনলো এক পাশে | সানগ্লাসে ঢাকা চোখ, কাজেই অভিব্যক্তিরা অন্ধকারে, বললো, ‘ অন্ধকার ? খুব অন্ধকার, তাই না ? অন্ধকার তোমার ভাবনায় | নিজের অপকর্মের দায় তুমি অন্যের মাথায় চাপাতে চাও ? কে নেবে? কেউ নেবে না | পারলে, একবার রোদ্দুর হয়ো, জীবনে যে বা যারাই আসুক, তারা তোমার এই দীনতা, নিজের হাতে তৈরি করা অন্ধকার নিতে পারবে না |’

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।