|| বারুখ স্পিনোজা || জন্মদিনের স্মরণলেখায় মৃদুল শ্রীমানী

বারুখ স্পিনোজা: জন্মদিনে স্মরণলেখ

ঈশ্বর না মানুষ, জীবনে কাকে গুরুত্ব দেব, সেই কথা ভাবতে গিয়ে বারুখ স্পিনোজার কথা আমাদের ভাবতেই হবে। বারুখ স্পিনোজা ( ২৪ নভেম্বর ১৬৩২ — ২১ ফেব্রুয়ারি ১৬৭৭) নামে ডাচ ভদ্রলোকের জাত জন্মের শিকড় ঘাঁটাঘাঁটি করলে দেখা যাবে তিনি পর্তুগিজ সেফারডিক ইহুদি। তিনি চশমার কাচ ঘসে জীবিকা নির্বাহ করতেন। অত‍্যন্ত সাধারণ শ্রমিকের জীবন। কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ‍্যাপনার আহ্বান পেয়েও সেসব জাগায় চেয়ার অলঙ্কৃত করতে যান নি। কোনোভাবেই প্রতিষ্ঠানের কাছে মাথা নত করতে চান নি। স্পিনোজা বলতেন, freedom is absolutely necessary for the progress in science and the liberal arts.
আর ফ্রি বলতে স্পিনোজা বুঝতেন, I call him free who is led solely by reason.

জীবনে যথার্থ পুণ্যকর্ম বলতে স্পিনোজা বুঝতেন, True virtue is life under the direction of reason. জোরদার ভাবে বলতেন, He alone is free who lives with free consent under the entire guidance of reason.

যুক্তির সপক্ষে তীব্রভাবে বলতে বলতে বারুখ স্পিনোজা বলে বসলেন, God and the world is same thing, আর বলে বোঝাতে চাইলেন, God is not the creator of the world. তাঁর এইসব ধারণা ও প্রকাশভঙ্গি কোনোটাই ইহুদি বা খ্রিস্টান, কোনো ধর্মমতের সঙ্গেই খাপ খেত না। তার উপর তিনি বললেন, Most people parade their own ideas as God’s words, mainly to compel others to think like them under religious pretexts. আরো বললেন, The holy word of God is in everyone’s lips, but we see almost every one presenting their own versions of God’s word. তাঁর এসব কথা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের কর্তাদের খুব চটিয়ে দিল। তাঁকে নাস্তিক বলে ঘোষণা করে পারিবারিক সম্পত্তির উত্তরাধিকার থেকে বিতাড়িত করার চেষ্টা হল। তাঁর বোন এই উদ্যোগ নিয়েছিলেন। স্পিনোজা বোনের অপচেষ্টার বিরুদ্ধে আইনি পথে লড়ে জয় ছিনিয়ে আনেন, এবং জয়ী হবার পর, নিজের ভাগের পৈতৃক সম্পত্তি আবার বোনকেই দান করেন। এমনই এক ব‍্যতিক্রমী চরিত্র তিনি। বিরোধী গোষ্ঠী ছোরা নিয়ে তাঁর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। স্পিনোজা প্রাণে বেঁচে গেলেও পোশাক আশাক ছিঁড়ে খুঁড়ে গিয়েছিল। ওই ছেঁড়াখোঁড়া পোশাকেই তিনি ঘুরতেন। হেসে বলতেন, এই হল আমার প্রতি সমাজের উপহার।
ভাবনার স্বাধীনতা নিয়ে ভাবতে গেলে আমাদের মনে পড়বে ফরাসি চিন্তাবিদ রেনে দেকার্তে ( ৩১ মার্চ ১৫৯৬ – ১১ ফেব্রুয়ারি ১৬৫০) এবং ডাচ চিন্তাবিদ বারুখ স্পিনোজা ( ২৪ নভেম্বর ১৬৩২ – ২১ ফেব্রুয়ারি ১৬৭৭)র কথা। মনে পড়বে কবি জন মিলটনের অ্যারিওপ‍্যাগিটিকার কথা।
রেনে দেকার্তেকে সভ‍্য মানুষ আধুনিক দর্শনভাবনার অন‍্যতম পথিকৃৎ‌ ও প্রতিষ্ঠাতা বলে জানেন। ১৬২৬ খ্রীস্টাব্দ থেকে ১৬২৮ খ্রীস্টাব্দের মধ‍্যে তিনি রুলস ফর দি ডাইরেকশন অফ মাইন্ড নামে গ্রন্থ রচনা করেছিলেন। এর পরে ১৬৩০ – ৩১ এ দি সার্চ ফর ট্রুথ, ১৬৩০ – ১৬৩৩ এ দ‍্য ওয়ার্ল্ড, ১৬৩৭ এ ডিসকোরস অফ মেথড, ১৬৪১ সালে মেডিটেশনস, ১৬৪৪ সালে প্রিন্সিপলস অফ ফিলজফি, এবং ১৬৪৯ সালে প‍্যাশনস অফ দি সোল ইত্যাদি গ্রন্থ রচনা করেন।
রেনে দেকার্তে তাঁর ডিসকোরস অফ মেথড ব‌ইতে বলেছিলেন, আমি চিন্তা করতে পারি, এতেই প্রমাণ পাওয়া যায়, আমি আছি। আই থিঙ্ক, দেয়ারফোর আই অ্যাম। লাতিন ভাষায় তাঁর কথাটা ছিল, কজিতো এরগো সাম। তিনি আরো বলেছিলেন, যেহেতু আমরা মানুষেরা সীমাবদ্ধ, সে কারণে আমরা অনন্ত কী তা বুঝতে পারি না। তবুও যে আমরা অসীম ঈশ্বরের ধারণা করতে পারি, তার কারণ হল, ঈশ্বর আমাদের মধ‍্যে সেই ধারণাশক্তিটি জুগিয়ে দিয়েছেন। এই শক্তিটি তিনি জুগিয়ে দিয়েছেন বলেই ঈশ্বরের অস্তিত্ব প্রমাণ করা যায়। দেকার্তে আরো বলেছিলেন, আমরা কখনোই বস্তু জগৎকে নিজস্ব ক্ষমতায় জেনে উঠতে পারি না।
ওঁর চিন্তাপদ্ধতি আরিস্ততলের অভিজ্ঞতাবাদের থেকে অন‍্যরকম। এক অর্থে যুক্তিবাদীও বলা হয়। দেকার্তের ভাবনা পদ্ধতিকে কার্তেসীয় চিন্তাপদ্ধতি বলে।
রেনে দেকার্তে ছিলেন ফরাসি গণিতবিদ, বিজ্ঞানী, দার্শনিক। ভাল করে পর্যবেক্ষণ করে, তারপর পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তারপর যুক্তি বিচার করে সিদ্ধান্ত নেবার কথা দেকার্তে বলেছিলেন। অ্যারিস্টটলের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে মুক্তির একটা পথ গড়ে বিজ্ঞানচর্চায় আধুনিকতার শুরু দেকার্তের হাতে। ইংরেজ কবি জন মিলটন তাঁর থেকে বছর তেরোর ছোটো, তিনি প্রশ্ন তুললেন, চার্চ সব ব‍্যাপারে নাক গলাবে কেন? মিলটন তো শুধু কবিতা লিখতেন না, সমকালীন রাজনৈতিক সংকট সমাধানে তাঁর প্রচুর চেষ্টা ছিল। ১৬৪১ সালে ইংল্যান্ডের চার্চের শাসনের খামখেয়ালিপনার বিরুদ্ধে লিখেছেন জন মিলটন ( ৯ ডিসেম্বর, ১৬০৮ – ৮ নভেম্বর, ১৬৭৪)। যুদ্ধের অজুহাতে ব্রিটিশ সরকার মতপ্রকাশের অধিকারের উপর বেড়ি পরিয়েছিল। ১৬৪৩ সালের অর্ডিন্যান্স। বলেছিল, কবি সাহিত্যিক কি লিখবে, তা আগেভাগে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষকে দেখিয়ে লাইসেন্স নিতে হবে। এর বিরুদ্ধে ওজস্বী বক্তৃতার ঢঙে মিলটন লিখেছেন অ্যারিওপ‍্যাগিটিকা। মতপ্রকাশের স্বাধীনতা রক্ষায় অসামান্য ব‌ই। আজ থেকে তিনশো আটাত্তর বছর আগে ১৬৪৪ সালে, এই রকম নভেম্বর মাসে অ্যারিওপ‍্যাগিটিকা প্রকাশিত হয়েছিল। প্রকাশের পর তার যে কপালে খুব আদর জুটেছিল তা নয়। পরে পরে মানুষ ভাবতে শিখে দেখল, এই ব‌ইটা চিন্তা ভাবনা করার স্বাধীনতার জন্য খুব দরকার।
ভাবনার চূড়ান্ত স্বাধীনতার কথায় আমস্টারডামের বারুখ স্পিনোজার কথা এসে যায়। সারা জীবন লেন্সের কাচ ঘষে ঘষে কাচের গুঁড়োর ধুলোয় ফুসফুসের অসুখ বাধিয়ে চুয়াল্লিশ বছর বয়সে মরে গেলেন। সারাজীবন কোনো পুরস্কার, বা কোনো সম্মান গ্রহণ করতে অস্বীকার করলেন। ভাল প্রতিষ্ঠানে পড়ানোর সুযোগ পর্যন্ত দিলে, তা নিতে অপছন্দ করেন। কেবল দূরবীন আর অণুবীক্ষণের লেন্স বানিয়ে বানিয়ে নিজেকে শেষ করে ফেললেন। মৃত্যুর পর পর‌ই বের হল স্পিনোজার অমর ব‌ই এথিক্স। স্পিনোজা অবশ‍্য দেকার্তের মতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিলেন। তিনি প্রকৃতিকেই ঈশ্বর বললেন। অস‍্যার্থ, বারুখ স্পিনোজা পদার্থবিজ্ঞান ও গণিতের নিয়মকেই ঈশ্বর বলে ভাবতেন। বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণযোগ‍্য ওই নিয়মের বাইরে অন‍্য কোনো বিশ্বমন ও কোনো বিশ্বপিতার অস্তিত্ব তিনি স্বীকার করতেন না।
১৬৬০ সালে স্পিনোজা লিখলেন এ শর্ট ট্রিটিজ অন গড ম‍্যান অ্যাণ্ড হিজ ওয়েল বিয়িং। ১৬৬২-তে অফ দি ইমপ্রুভমেন্ট অফ দি আণ্ডারস্ট‍্যান্ডিং, ১৬৬৩ সালে দি প্রিনসিপলস অফ কার্তেসিয়ান ফিলজফি, ১৬৭০ সালে এ থিওলজিক‍্যাল পলিটিক্যাল ট্রিটিজ, আর ১৬৭৭-এ দি এথিকস নামে ব‌ই লিখলেন।
স্পিনোজা হিব্রু বাইবেলের সত‍্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে দিলেন। সমসময়ে তাঁর তোলা প্রশ্ন সমাজকে তোলপাড় করে দিল। তিনি দৈবী বিষয়ের প্রকৃতি নিয়েও বিতর্কিত মতপোষণ করতেন। ইহুদি ধর্মনেতাদের চক্ষুশূল হয়ে উঠলেন তিনি। তাঁরা স্পিনোজার বিরুদ্ধে ফতোয়া দিলেন। স্পিনোজাকে মাত্র তেইশ বছর বয়সেই সমাজচ‍্যুত করা হল। কেউ তাঁকে পছন্দ করত না। কেউ সম্পর্কটুকু রাখত না। এমনকি তাঁর পৈতৃক পরিবার পর্যন্ত তাঁকে দূর করে দিয়েছিল। শেষমেশ স্পিনোজার ব‌ইগুলি ক‍্যাথলিক চার্চ নিষিদ্ধ ঘোষণা করল।
যদিও কোথাও, কোনো রচনাতেই তিনি ঈশ্বরের অস্তিত্ব সম্পর্কে অনাস্থা প্রকাশ করেন নি, বা ঈশ্বরের অস্তিত্বকে চ‍্যালেঞ্জ জানান নি, তবুও সমসাময়িক লোকজন স্পিনোজাকে নাস্তিক বলত।
অত‍্যন্ত প্রতিভাশালী ও মেধাবী ব‍্যক্তি হয়েও তিনি অতি সামান্য লোকের মতো দিনযাপন করতেন। পেশা হিসাবে কাচের লেন্স ঘসার কাজে তিনি নিজেকে ব‍্যাপৃত রেখে স্বাধীনভাবে চিন্তা ভাবনা করতেন। সমসময়ের গুরুত্বপূর্ণ জ‍্যোতির্বিদ ক্রিশ্চিয়ান হাইগেনস এর সঙ্গে তাঁর যোগাযোগ ছিল। অণুবীক্ষণ ও দুরবিনের লেন্স ও তার ডিজাইন নিয়ে তাঁদের মধ‍্যে কথাবার্তা হত। স্পিনোজা অনেক দূর অবধি দেখার উপযুক্ত দুরবিনের কথা ভাবতেন। তিনি কখনোই উপহার ও সম্মান গ্রহণে রাজি হতেন না। সম্মানিত করার যে কোনো প্রস্তাবকে তিনি পাশ কাটিয়ে যেতেন। নামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতার প্রস্তাব‌ও তিনি অক্লেশে বর্জন করতেন। স্পিনোজার উচ্চতর জ্ঞানচর্চার সামর্থ্য দেখে হাইডেলবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে দর্শনের বিশিষ্ট অধ‍্যাপক হিসেবে নিয়োগ করতে চায়। স্পিনোজা এ প্রস্তাবটিও নাকচ করে দেন। তিনি বলতেন, এইসব বড় জায়গায় যোগাযোগ রাখলে তাঁর চিন্তার স্বাধীনতা ক্ষুণ্ণ হবে।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।