নব্বই দশকের কবি , প্রাবন্ধিক । মহাসচিব- অনুপ্রাস জাতীয় কবি সংগঠন। বিভাগীয় সম্পাদক: অনুপ্রাস সাহিত্য পাতা -দৈনিক নব অভিযান, দৈনিক স্বদেশ বিচিত্রা ও সাপ্তাহিক কালধারা। বার্তা সম্পাদক -দৈনিক হাতিয়া কণ্ঠ। বিশেষ প্রতিনিধি: শিরদাঁড়া। বাংলাদেশ প্রতিনিধি: মননস্রোত (ত্রিপুরা, ভারত)।
সভাপতি- বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান কবিতা পরিষদ।
সাবেক সভাপতি, বদরুন্নেসা কলেজ ও সাবেক সহ-সভাপতি, ঢাকা মহানগর (দক্ষিণ) ছাত্রলীগ।
সদস্য, হাসুমনির পাঠশালা।
বাবা -মো: আবদুল করিম। মাতা- আনোয়ারা বেগম। পড়াশুনা- এম.এ। জন্ম -২১ আগস্ট, ১৯৭৩, জেলা- লক্ষ্মীপুর, বাংলাদেশ।
বাংলা কবিতায় বিজ্ঞান যুগের সূচনা
সূচনা :
ভারতীয় উপমহাদেশ ১৯৪৭ সালে পৃথক হয়ে ১৪ আগস্ট ‘পাকিস্তান’ আর ১৫ আগস্ট ‘ভারত’ নামে দুটি পৃথক দেশ সৃষ্টি হয়। একরাতের আরাধনায় সিরিল জন র্যাডক্লিপ নতুন দুটি রাষ্ট্র ভারত ও পাকিস্তানের মানচিত্র এবং আন্তর্জাতিক সীমানা নির্ধারণ করেন। যা এমন এক অদ্ভূত মানচিত্র তৈরী করে দিয়েছে; যেখানে এ অঞ্জলের মানুষের আচরণে ভারতীয় উপমহাদেশের ব্রিটিশ উপবেশিক মনোভাব থেকে যাওয়ায় সবল দুর্বলের পাথর্ক্য সাধারণ মানুষের বঞ্চনা ও লাঞ্ছনা আরো প্রকট রূপ ধারণ করেছে। মানচিত্রের কারুকাজে ভারতের অংশে বাঙালী বাংলা ভাষাভাষীদের সংস্কৃতিতে ভারতের অন্যান্য অঞ্চলের সাথে অমিল থাকায় নাগরিক সুবিধা ও অনগ্রসরতা বিরাজমান। আর পূর্ব পাকিস্তান অংশে বাঙালীরা পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে মাতৃভাষা, ঐতিহ্য, কৃষ্টি, নাগরিক অধিকার সহ সর্বস্তরেই শোষিত ও বঞ্চিত হয়। ফলে আবারো পাকিস্তানের পূর্ব বাংলায় বিভক্তির সুর ওঠে। প্রথমে আঘাত আসে মাতৃভাষা বাংলায় ১৯৫২ সালে। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৬৬ সালের বাংলার মানুষের মুক্তির সনদ ৬ দফা, ৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ও ৭০ এর নির্বাচন অবশেষে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে ১৯৭১ এর ১ দফা ও স্বাধীনতা এবং বিজয়। বাংলা কবিতায় ১৯৪৭ সালের সাথে অন্নদাশঙ্কর রায় লিখেছেল- খুকু ও খোকা’ ছড়া “তেলের শিশি ভাঙল বলে, খুকুর পরে রাগ করো।/ তোমরা যে সব বুড়ো খোকা – ভারত ভেঙে ভাগ করো! তার বেলা? / ভাঙছ প্রদেশ ভাঙছ জেলা- জমিজমা ঘরবাড়ী / পাটের আড়ৎ ধানের গোলা- কারখানা আর রেলগাড়ী!- তার বেলা?” ইতিহাস সাক্ষ্য, আবার ১৯৭১ সালে তারই লেখা- ‘যতদিন রবে পদ্মা, মেঘনা, গৌরী, যমুনা বহমান, তত দিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান’ ইতিহাস সাক্ষ্য। তারপর ১৯৭৫ সালের নৃশংসতম হত্যাকান্ডে বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুছে ফেলার ষড়যন্ত্র। বঙ্গবন্ধুর এমন জঘন্য হত্যাকান্ডের পর প্রথম এলিজির বা শোক গাঁথা রচয়িতা যিনি দাফন-কাফন করেছিলেন টুঙ্গি পাড়ার মসজিদের মৌলভী শেখ আবদুল হালিমের আরবী ভাষায় লেখা এবং পরে কবি নির্মলেন্দু গুণের অনুরোধে বাংলা অনুবাদ করেন যা কবি গুণ নিজেই তার মুখ থেকে শুনে লিখে নেন। সেই পঁচাত্তরের ১৫ আগষ্ট জাতির পিতার প্রতি প্রথম এলিজি অকৃত্তিম ভক্তির ইতিহাস সাক্ষ্য। একই বিষয়ে প্রথম প্রতিবাদী কবিতা লেখেন কবি সিকান্দার আবু জাফর, কবি মহাদেব সাহা ও কবি নির্মলেন্দু গুণ ইতিহাস সাক্ষ্য। বর্তমানে বিশ্ব সাহিত্যে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে প্রচুর শোক গাঁথা, সমৃদ্ধ কবিতা লেখা হয়েছে বা হচ্ছে। কেননা বাংলার ইতিহাসে ’৭৫ সালে একই সাথে এত বেশী আপনজন হারানোর এক বিষাদ সিন্ধু রচিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনাকে নিয়েও ইতোমধ্যে বাংলা সাহিত্যে প্রচুর কবিতা লেখা হয়েছে বা হচ্ছে। ফলে শেখ হাসিনা ভিত্তিক সাহিত্যও সৃষ্টি হচ্ছে এবং এই সংক্রান্ত অনেক সংকলন প্রকাশিত হয়েছে। কবিতার ক্ষেত্রে পরিবর্তন হচ্ছে কবিতার প্রকরণগত পরিবর্তনে বিষয়বস্তুর বৈচিত্রতা আনয়ন এবং ব্যকরণিক ক্ষেত্রে সাধুভাষা বর্জন, সমুচ্চয়ী অব্যয়পদ বর্জন, অলংকার, উপমা, বক্রোক্তি ও অপরাপর ক্ষেত্রে কোমলতায় বিজ্ঞানকে সমন্বয় করে সাবর্জনীনকরণ। সমালোচনা ও অনুবাদ সাহিত্য উন্নীতকরণ, সনেট পরিবর্তনে বিজ্ঞান সনেট নামকরণ, বিজ্ঞান কবিতার উপধারায় রকেট কবিতা, পিরামিড কবিতা, আরোহ-অবরোহ পদ্ধতিতে কবিতা, তাসের চিহ্ন রুহিতন আকৃতির কবিতা, ন্যানো কবিতা, নিউক্লিয়ার্স কবিতা ও আকৃতির কবিতার থিওরীর উদ্ভব এবং বিদেশী ভাষার সাহিত্যে বিজ্ঞান সমন্বয়ে কাব্যচর্চা। দীর্ঘ গল্প ছোট্ট গল্পের পর এখন অনুগল্প এবং বিজ্ঞানভিত্তিক পরমাণু গল্প চর্চা হচ্ছে। সেই সাথে প্রবন্ধ সাহিত্যে বিজ্ঞান সমন্বয় হয়ে মানও সমৃদ্ধ হয়েছে বা হচ্ছে।
বাংলা কবিতায় বিজ্ঞান যুগের সূচনা :
বিজ্ঞান যুগের সূচনা পর্বে প্রশ্ন থাকে বিজ্ঞান কবিতার সংজ্ঞা কী ? বিজ্ঞান কবিতা (Science Poetry) – বিজ্ঞানকে আশ্রয় করে ব্যক্তি ও বস্তুর সমন্বয়ে রচিত কবিতা। বিজ্ঞান কবিতা মূলত মন্ময় ও তন্ময় দুটোতেই রচিত হতে পারে। কবি তার ব্যক্তি অনুভূতিতে অথবা পারিপার্শ্বিক দৃশ্যমান বস্তু নিয়ে বিজ্ঞানকে অলংকারিক বিন্যাসে ছন্দিত করবে। বিজ্ঞান আশ্রিত কবিতা। এখানে বিষয়গত, গঠনগত কবিতা সহ ছন্দবদ্ধ, গদ্য কবিতায় মন্ময় বা ব্যক্তিনিষ্ঠ ও তন্ময় বা বস্তুনিষ্ঠ দুই-ই হতে পারে। বিজ্ঞান কিছুটা পরাবাস্তব। কেননা কবির স্বপ্ন আর দার্শনিকের তত্ত্ব নিয়ে বিজ্ঞানী প্রমাণের পথে এগিয়ে যেতে থাকে। ফলাফল এক নাও হতে পারে। অথবা ভাবনার চেয়ে বেশী কিছু বা অন্যরকম কিছু হতে পারে।
আদিম যুগের (৫০০০-৫০০ খ্রিষ্টাব্দ) প্রাগৈতিহাসিক যুগ ও প্রাচীন যুগ। প্রাচীন যুগে সপ্তম শতাব্দী হতে দ্বাদশ শতাব্দীর মধ্যবর্তী সময়ে মাত্রাবৃত্ত ছন্দে রচিত চর্যাপদ হচ্ছে প্রাচীন যুগের একমাত্র সাহিত্য নিদর্শন। আর অলংকার বিবেচনায় এগিয়ে আছেন কবি বাল্মীকি। চর্যাপদ হলো বাংলা ভাষার প্রথম লিখিত কাব্যের নমুনা। একহাজার বছর পূর্বের রচিত চর্যাপদ মানুষ জেনেছে একশ বছর আগে। মধ্যযুগে ১৪০০-১৪৫০ অর্ধশতকে রচিত উৎকৃষ্ট গ্রন্থ শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য। চর্যাপদের ধর্মসঙ্গীত ও সামাজিক চিত্র থেকে বাংলা কবিতা বিবর্তিত রূপে মুক্তি পেয়ে শ্রীকীর্তন রূপে রাধা কৃষ্ণের লৌকিক প্রেম কাহিনীতে এসে পৌঁছায়। প্রাচীন যুগের দেহ বন্দনা ও ধর্মীয় সাধনা আর মধ্য যুগের ধর্মীয় আচ্ছাদন ও কুসংস্কার এবং প্রণয় উপাখ্যানের খোলস ত্যাগ করে ইউরোপীয় প্রভাবে উনিশশতকে বাংলার কবিতার নবজাগরণ শুরু হয়। সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে জাগ্রত হয়েছে বুর্জোয়া শ্রেণীর বিকাশের সঙ্গেই সমাজ ও অর্থনীতির বাঁক বদল। যদিও প্রথম দিকে বুর্জোয়াদের অসঙ্গতি ছিল। পরবর্তীতে নতুন চিন্তা চেতনায় জাগ্রত একদল তরুণের সংগঠিত রূপ ইয়ংবেঙ্গল সমাজ ও ধর্মীয় কুসংস্কারের সংস্কার শুরু করলে মানুষের পরির্তন দ্রুততর হয়। চর্যাপদেও মানুষের বিচ্ছিন্ন মনোভাব দেখা যায়। এ সময় মানুষের মধ্যে লাম্পট্য ছিলো, শ্রেণী বৈষম্য ছিল। আর মধ্যযুগে (৫০০০-১৮০০ খ্রিষ্টাব্দ) কবিরা অন্তর সাধনায় নিমগ্ন ছিলেন যা সমাজের বৃহত্তর মানুষের সাথে একাত্ম ছিলোনা। তারা অন্তর্লোকের তৃপ্তির জন্য সাধনায় মশগুল ছিলেন। ষোল শতকের কবি চন্দ্রাবতী প্রেম ও ধর্ম চিন্তার কবিতা এক নতুন ভাবনার দিকে সমাজকে এগুতে সাহায্য করেছে। তারপর নাথ কাব্যের চেতনার পর বৈষ্ণব সাহিত্য এবং মঙ্গলকাব্য, পালাগান, গীতিকবিতা, সাহিত্যের হিন্দু-মুসলিমীকরণ আর সর্বশেষ আধুনিক কবিতার ধারা। বাঙ্গালী সমাজ ব্যবস্থার সংকট কালের দূত কবি ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত (১৮১২-১৮৫৯) সমাজের বিশৃঙ্খলা দেখে নিঃসঙ্গতা অনুভব করেন। তিনি কবিতায় ধারণ করেছেন নিঃসঙ্গতার আর্তনাদ, হাস্য, রঙ্গরস, ব্যঙ্গ ও কৌতুকে দেশপ্রেম ও সমাজ চেতনা জাগ্রত করেছেন। ১৭৬১-১৮৬০ একশত বছরের নীরব প্রস্তুতির সময়ের পুরোহিত ছিলেন কবি ঈশ্বর চন্দ্র গুপ্ত। বাংলা সাহিত্য ভারতীয় পুরাণ থেকে উপাত্ত নিয়ে যাত্রা শুরু। এ সময়কে সাহিত্যের সন্ধিযুগের কাল বলা হয়। ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত মূলত মধ্যযুগের শেষ কবি। কবি ভারতচন্দ্র আধুনিক যুগের প্রথম পুরুষ আর মাইকেল মধুসূদন দত্ত মধ্যবর্তী কালের যুগসন্ধিতে আর্বিভাব।