দৈনিক ধারাবাহিকে মৃদুল শ্রীমানী

জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর। বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন। চাকরীসূত্রে ও দৈনন্দিন কাজের অভিজ্ঞতায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের সমস্যা সমাধানে তাঁর লেখনী সোচ্চার।

বৃহন্নলা কথা

মহাভারতের অনুশাসন পর্বে ভঙ্গাস্বন নামে এক ধার্মিক রাজার গপ্পো আছে। সেই রাজার জীবনে এক বিরল ঘটনা ঘটে। রাজার ইচ্ছে ছিল পুত্র হোক। আর তাইতে তিনি অগ্নিষ্টুত যজ্ঞ করে শত পুত্র লাভ করেন। এই যজ্ঞে কেবল অগ্নিকেই স্তুতি করা হয়। সে কালে দেবতাদের মধ্যে গ্রুপবাজি ক্লিকবাজি বিস্তর ছিল। অগ্নি এভাবে ভঙ্গাস্বন রাজার কাছে বিরাট পাত্তা পেলেন দেখে ইন্দ্র, আরেক এলিট দেবতা, তিনি গেলেন ক্ষেপে। না, ইন্দ্রের একটু অমন ভাব ছিলই। কেউ তার চেয়ে বেশি উপরে উঠে গেল কি না, সেই নিয়ে ইন্দ্র সর্বদা মাথাব্যথা করতেন। অগ্নির প্রতি ভঙ্গাস্বন রাজার এতটা আনুগত্য দেখে ক্ষ্যাপা ইন্দ্র সেই রাজার পিছনে লাগতে ব্যস্ত হলেন। রাজার উপর মায়াজাল বিস্তার করে, তাকে ভুল ভুলাইয়ায় ফেলে দিলেন। ভঙ্গাস্বন রাজা দিগভ্রান্ত ও তৃষ্ণার্ত হয়ে ঘুরতে ঘুরতে এক সরোবর দেখতে পেয়ে সেখানে অবগাহন স্নান করলেন।
সেইখানেই ছিল ইন্দ্রের ম্যাজিক। সেই সরোবরে ডুব দেওয়া মাত্র ভঙ্গাস্বন রাজা একজন স্ত্রীলোকে রূপান্তরিত হন।
বিহ্বল রাজা ঘরে ফিরে স্ত্রী ও পুত্রদের সব কিছু জানিয়ে পুত্রদের হাতে রাজ্যভার দিয়ে বনবাসী হন।
দেহের যৌন পরিচয় বদলে গেলে কি হবে, ভঙ্গাস্বন মানুষটা রাজা তো বটে। রাজার মতোই আদরে যত্নে লালিত দেহ তাঁর । তাই নারী রূপেও তিনি লাবণ্যবতী কিরণময়ী। স্ত্রী রূপে ভঙ্গাস্বন রাজা ঠাঁই পেলেন এক ঋষির আশ্রমে।
সেকালের মুনি ঋষিরা মোটেই নারীবর্জিত জীবনে অভ্যস্ত ছিলেন না। তারা ধর্ম অর্থ আর মোক্ষের সাথে কামকলাকেও একই আসনে বসিয়েছিলেন। তাঁরা নারীসঙ্গ পছন্দও করতেন। সন্তান উৎপাদনে তাঁরা উল্লাস বোধ করতেন। গোধুম অর্থাৎ গমের পুরোডাশ বা পরোটার সাথে হৈয়ঙ্গবীন অর্থাৎ উৎকৃষ্ট গাওয়া ঘি মাখিয়ে নধর সুপুষ্ট বাছুরের সুপক্ক মাংসে তাঁদের উদরপূর্তির নিয়ম ছিল। গোমাংসে তাঁদের বিশেষ রুচি ছিল। তাই তাদের গোঘ্ন বলা হত। তো ভঙ্গাস্বন রাজা স্ত্রী রূপে যে ঋষির আশ্রমে রইলেন, আশারাম বাপু বা গুরু রাম রহিম এর মতোই ঋষিমশাই তাঁর গর্ভে পুত্র সন্তান উৎপন্ন করলেন। না, একটি আধটি নয়। ঋষি মশাই গুণে গুণে একশোটি পুত্র উৎপাদন করলেন সেই আশ্চর্য নারীর গর্ভে।
এইবার একশো ছেলের পাল নিয়ে স্ত্রীরূপী ভঙ্গাস্বন রাজা নিজের আগের সংসারের একশো ছেলের কাছে গিয়ে বললেন তোমরা বাপু সকলে মিলে এই রাজ্য ভোগ করো।
ইন্দ্র দেখলেন মহা বিপদ। দুশো ছেলে নিয়ে ভঙ্গাস্বন রাজার তো বিরাট শক্তি হয়ে গেল। দেবতাসুলভ কূটবুদ্ধিতে তিনি ভঙ্গাস্বন রাজার ছেলেদের মধ্যে ঝামেলা বাধাতে চাইলেন । ইন্দ্র ওদের বোঝালেন তোমরা একদল রাজার ছেলে, আর এক দল ঋষির ছেলে। তোমরা একসাথে রাজ্যভোগ করবে কিভাবে? ব্যস, লেগে যা নারদ, নারদ! তারা এমনি যুদ্ধ করেছিল যে রাজার দুশো ছেলের সব কয়টা মোলো ।
দুশো ছেলের সব কয়টা নিজেদের মধ্যে যুদ্ধ করে মরেছে শুনে, ভঙ্গাস্বন রাজা কেবল কপাল চাপড়ান, আর মাথা ঠোকেন। কেঁদে কেঁদে চক্ষু অন্ধ হয় আর কি! সেই অবস্থায় ইন্দ্র এসে ভঙ্গাস্বন রাজার কাটা ঘায়ে নুনের ছিটে দিয়ে বললেন, কি রে ব্যাটা, বিটলে ভঙ্গাস্বন রাজা, খুব তো আমায় বাদ দিয়ে অগ্নিষ্টুত যজ্ঞ করেছিলি, এবার দ্যাখ কেমন লাগে। পুত্রশোকাতুর রাজা ইন্দ্রের পায়ে ধরে ক্ষমাপ্রার্থনা করলে ইন্দ্রের মন খানিক খানিক নরম হল। বললেন, তা তুমি যখন নিজের দোষ বুঝতে পেরেছ, তোমার শাস্তি খানিক লঘু করতে হয়। তা ভঙ্গাস্বন রাজা, তুমি কোন পুত্রদের জীবন ফেরত চাও, তোমার ঔরসজাত পুত্রদের , না তোমার গর্ভজাত পুত্রদের? বলে রাখছি কিন্তু, দু রকম একসাথে হবে না। যেটা হোক একটা নাও।
ইন্দ্রকে রীতিমতো আশ্চর্য করে ভঙ্গাস্বন রাজা জানালেন যে তিনি স্ত্রী হয়ে যে পুত্রদের জন্ম দিয়েছেন, তাদের জীবন তিনি কামনা করছেন। ইন্দ্র জানতে চাইলেন কেন? ভঙ্গাস্বন রাজা এ কালের এক বাঙালি কবির কবিতা টুকলি করে বলে দিলেন “সমুদ্রের কূল আছে, তল আছে তার, অকূল অপার মাতৃ স্নেহ পারাবার।” বললেন, মেয়েদের স্নেহ করার ক্ষমতা পুরুষের অনেক অনেক গুণ বেশি। ইন্দ্র ভঙ্গাস্বন রাজার বাগ বৈদগ্ধ্যে মুগ্ধ হয়ে সেই বরই দান করলেন। পুনর্জীবন লাভ করল নারী শরীরধারী ভঙ্গাস্বন এর গর্ভজাত শত পুত্র।
তার পর ইন্দ্রকে আরো অবাক করে ভঙ্গাস্বন রাজা বললেন আমি স্ত্রীলোক হয়েই থাকতে চাই। ইন্দ্র বললেন কেন? স্ত্রী হয়ে কিসের সুবিধে?
ভঙ্গাস্বন রাজা নির্লিপ্ত নির্বিকার মুখে বললেন স্ত্রী পুরুষের যৌনসঙ্গমে মেয়েরাই বেশি তৃপ্তি পায়। একবার নারীশরীর নিয়ে যৌনতৃপ্তির রকমফের তিনি ভালো মতো অবগত হয়েছেন। তিনি নারী শরীরেই থেকে যেতে চান।
ইন্দ্র এই বরও তাঁকে দান করতে করতে ভাবলেন , অহল্যাযোগে তাঁরও তো যোনি হয়েছিল। এক আধটা নয়। হাজারটা। সেগুলি তিনি কান্নাকাটি করে বদলে নিয়েছিলেন।
নিঃশ্বাস ফেলে ইন্দ্র ভঙ্গাস্বন রাজার নারীরূপের দিকে চেয়ে বললেন তবে তাই হোক।
ক্রমশ…..
Spread the love

You may also like...

error: Content is protected !!