দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৯৬)

পর্ব – ১৯৬

বাড়িতে ঢুকে শ‍্যামলী দেখল, কলতলায় মা বাসন মাজছেন। তাড়াতাড়ি করে হাত ব‍্যাগটা সিঁড়ির রেলিঙে ঝুলিয়ে শ‍্যামলী মাকে বলল, তুমি ওঠো ওঠো, আমি মেজে দিই। তোমার যে হাঁটুতে ব‍্যথা!
বাসন্তীসবালা বললেন, হ‍্যাঁ রে, তোর সে সব মনে আছে? আমি বলি, বাড়িতে বাপ মা বলে কিছু আছে, ভুলেই গেছে মেয়েটা। কাল রাতে ফিরলি না। এমন তো মতি তোর কোনোদিন ছিল না। আজ সারাদিন কাটিয়ে সন্ধ্যার পর ফিরতে ইচ্ছে হল তোর?
গাছকোমর করে শাড়ি সামলে শ‍্যামলী জোর করে মাকে তুলে বাসন মাজতে বসল।
বাসন্তীবালা বললেন, সারাদিন তোর ফোন আসে। এ ফোন করে, সে ফোন করে। লজ্জায় বলতে পারি না, সে মেয়ে এত বড় হয়ে গেছে যে, বাবা মাকে কিছু জানাবার প্রয়োজন মনে করে না।
শ‍্যামলী বাসন ধুয়ে রান্নাঘরে গুছিয়ে তুলতে লাগল।
বাসন্তীবালা বললেন, সবিতাটা ছিল, দুটো সুখ দুঃখের কথা বলতে পারতাম। তোর বাবাকে কি অতো কিছু বলা যায়? সাদাসিধে সরল মেয়েটাকে তুই দুর্বুদ্ধি যুগিয়ে ঘরছাড়া করলি। এই মুখে আমি সর্বক্ষণের কাজের লোক পাই কোথায় বলতে পারিস?
শ‍্যামলী বলল, আর কি করতে হবে বলো, করে দিই।
বাসন্তীবালা চিবুক ছুঁয়ে আদর করে বললেন, সারাদিন তোর উপর রাগ করেছিলাম। উকিল বাড়ি গিয়ে রাতে থেকে গেলি বলে আরো। কিন্তু যেই তুই ফিরলি, তোর মিষ্টি মুখটা দেখে মনে হল, মেয়ে আমার সেই সরল মেয়েটাই আছে। শ‍্যামলী মাকে জড়িয়ে ধরে বলল, পালটে যাব কেন মা?
বাসন্তীবালা কেঁদে ফেলে বললেন,  ওদের বাড়ির ঝিকে কাল ষাট টাকা কবুল করে কাজে লাগালাম। একটা বেলা বেশ কাজ করে দিল। বলতে নেই, কাজের তাগবাগ ওর ভাল‌ই। সকালে ওর ছেলেটাকে দিয়ে বলে পাঠালো, মা আসতে পারবে না। সব হয়েছে আমার জ্বালা।
শ‍্যামলী বলল, তুমি একটু আটাটা বের করে দাও। আমি রুটি কখানা গড়ে দিই।
বাসন্তীবালা বললেন, না রে মা, বাবার কাছে যা। সারাদিন মন খারাপ করে পড়ে আছে।
 শ‍্যামলী চা করে নিয়ে দোতলায় বাবার কাছে গেল।
বলল, বাবা, মায়ের কাজের সাহায্যের জন্য একটা ঠিক মতো লোক রাখা দরকার।
শশাঙ্ক পাল বললেন, তোরা সংসারের ঝামেলা থেকে আমাকে রেহাই দে। আমি কোথাও চলে যাব।
শ‍্যামলী বলল, সেই যে একটা লোক ছিল। সংসার ছেড়ে চলে গিয়েছিল।  গায়ে দেবার একটা কম্বল পর্যন্ত ছিল না। একজন দয়া করে একটা কম্বল দান করে গা ঢেকে একটু আরাম পেল। কিন্তু ইঁদুর কুটকুট করে কম্বল কেটে দেয়। ইঁদুর তাড়াতে হবে বলে বিড়াল পুষল। বিড়ালের দুধ ভিক্ষা করে করে সারা সকাল নষ্ট হয়। ঠাকুর নাম হয় না। তখন একজন একটা দুধেল গাই দিতে বিড়ালের জন‍্য সমস্যা ঘুচল। কিন্তু গাইয়ের থাকার ব‍্যবস্থা করতে একটা গোয়াল ঘর বাঁধতে হল। তার খাবার জন‍্য পাতা কুড়িয়ে আনতে হয়। খোল ভূষি খড় নিত‍্য কে যোগান দেয় বল? একজন দয়া করে একটু জমি দিয়ে বলল, চাষ করে নিজে খাও, আর গরুটাকে দেখো। তখন ঘর দোর কে সামলায়? একজন বললে, একটা বিয়ে করো। এত ফৈজৎ সামলাতে গেলে একটা বৌ না হলেই নয়। তখন সাধুগিরি ছেড়ে পুরোপুরি গৃহী হতে হল।
শশাঙ্ক পাল বললেন, এক কম্বল কা ওয়াস্তে।
শ‍্যামলী বলল, রামকৃষ্ণদেব কি চমৎকার একটা একটা গল্প বলে গেছেন, তাই না?
শশাঙ্ক পাল বললেন, সংসারী লোকের বড় জ্বালা। ধরে রাখতে প্রাণ ওষ্ঠাগত। আবার ছাড়াও যায় না।
শ‍্যামলী বলল, বাবা, বৈষ্ণব শাস্ত্রে বলেছেন, তপ্ত ইক্ষু চর্বণ। ফেলাও যায় না, রাখাও শক্ত।
অথচ ছেড়ে দিতে পারলে আর কোনো সমস্যা থাকে না। জানো বাবা, ব্রাজিলের জংলী লোকজন বাঁদর ধরে কি করে জান?
শশাঙ্ক পাল বললেন, কি করে?
শ‍্যামলী বলল, একটা বড়ো মুখ‌ওলা শিশিতে একটা বড়ো সড়ো বাদাম রাখে। লোভে পড়ে বাঁদর শিশির ভিতর হাত গলায়। বাদামটা মুঠোয় ভরে হাত বের করতে চায়। হাতে বাদাম না থাকলে হাত সহজেই বেরোয়। অথচ মুঠোর মধ‍্যে বাদাম নিলে আর বেরোয় না। বাঁদর তো কিছুতেই মুঠি আলগা দেবে না। আর মুঠি পাকিয়ে থাকলে বাদাম বেরোয় না। শিশির ভিতর মুঠোর মধ‍্যে বাদাম নিয়ে বাঁদর ব‍্যতিব‍্যস্ত হয়ে পড়ে। তখন জংলীরা সহজেই বাঁদরকে পাকড়াও করে।
শশাঙ্ক পাল বললেন, ঠাকুর সেই চিলের গল্প বলেছেন।
শ‍্যামলী বলল, হ‍্যাঁ, চিল পেয়েছে মাছের টুকরো। তখন কাকগুলো তার পিছনে খ‍্যা খ‍্যা করে বেড়ায়। কিন্তু বিরক্ত হয়ে যেই চিল তার মাছের টুকরোটা ছেড়ে দেয়, তাহলে কাকের দল আর কিছু বলে না।
বাবার পায়ের কাছে একটা দলিল পড়ে আছে।
শ‍্যামলী বলল, বাবা এই দলিলটা দেখব?
শশাঙ্ক পাল ক্লান্ত চোখে চা‌ইলেন। দেখবি? তা দ‍্যাখ।
শ‍্যামলী দলিলটা উলটে পালটে দেখতে দেখতে বলল, এ তুমি কি করেছ বাবা?
বিছানায় গা এলিয়ে দিয়ে শশাঙ্ক বললেন, ত্বয়া হৃষীকেশ হৃদিস্থিতেন, যথা নিযুক্তোহস্মি তথা করোমি। যা হয়েছে, ভাল‌ই হয়েছে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।