গল্প গাথায় মৃদুল শ্রীমানী

আমার সারস্বত জীবন


আমাদের বাড়িতে সাহিত্য পত্রিকা হয়েছিল, আর প্রথম থেকেই তা হয়ে উঠেছিল গোটা বাংলার পত্রিকা। মানে বাংলার নানা কোণ থেকে লেখা এসে পৌঁছত আমাদের ছোটো সরু গলিটির শেষ প্রান্তে। আর ছাপা হয়ে ডাকযোগে পত্রিকা যেত প্রায় সব জেলায়। এমনকি বাংলাদেশ, আসাম, ত্রিপুরা, মিজোরাম , টাটা, বোকারো পর্যন্ত।
আমার পীড়াপীড়িতে ভাই বোনেরা লিখতে শুরু করেছিল। বাড়িতে আমার সমবয়সী বন্ধুরা মিলে সাহিত্য নিয়ে আড্ডা দিয়েছি, গুণী কাউকে ডেকে আলোচনা বসিয়েছি, আর মাঝে মধ্যে গান আর নাচ আর কবিতার আসর। এই সময় আমাদের বাড়িতে বোনেরা সহজভাবেই অনাত্মীয় ছেলেদের সাথে কথা বলতে পারতেন। সরস্বতী পূজার সময় লিটলম্যাগ এর প্রদর্শনী আর পুজোর সময় উৎসবের কয় দিন ধরে পত্রিকা বিক্রির স্টল। আমি পত্রিকার বিক্রির জন্য দোরে দোরে ঘুরতাম। বইমেলায় রাস্তায় দাঁড়িয়ে বই বিক্রি করতাম। শান্তা, আমার ছোটো বোনটি তখনো বেশ ছোটো। স্কুলে পড়ত। আমাদের অনুষ্ঠানের সূচনায় অন্ধকারে পল্লীবালার স্টাইলে শাড়ি পরে ও প্রদীপ হাতে নিয়ে নাচতে নাচতে ঘর আলো করে দিত। সারদা, একটু বড়ো হয়ে ওঠা বোনটি, দায়িত্ব নিত সরস্বতী পূজায় লিটলম্যাগ প্রদর্শনীতে দাদাদের পাশে থাকার। নিয়মিত বের হত পত্রিকা। গুনে গুনে হাজার কপি। প্রতিটি বিক্রি হত। রূপনারায়ণপুর থেকে নিয়মিত আসতেন অভিজিৎ জোয়ারদার। তিনি যেন আমাদের পরিবারের একজন হয়ে গিয়েছিলেন। এ রকম আরো অনেকেই। বাবার কড়া নির্দেশে ছোট্ট পত্রিকাটিতে বিজ্ঞাপন বা অনুদান নেওয়া বারণ। তাই প্রতিটি কপি বিক্রি করতে হত। দাম অল্প থাকায়, বিক্রি করতে পারতাম সহজে। কারো অনুকম্পা বা অনুপ্রেরণা নিতে হত না বলে, খুশি মতো কলম ছোটাতে দুবার ভাবতে হত না। মনে হত, যারা কলমের ডগায় স্বাধীন উচ্চারণ করতে পারেন না, তাঁরা লেখক নন, কলমচি। তাঁরা স্রষ্টা নন, স্তাবক। চিন্তার নির্বাধ প্রকাশটাই যে আসল সারস্বত চর্চা তা আমাদের সত্তার গহনে ঢুকে গিয়েছিল এভাবেই। আমাদের বাড়িতে সে সময় সারা বছর সারস্বত চর্চা।

রামকৃষ্ণ মিশনে পড়েও আমি শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস ওরফে গদাধর চট্টোপাধ্যায় মশায়কে অবতার ভাবতে শিখিনি। তাঁর স্ত্রী শ্রীমতী সারদাদেবীকেও জগজ্জননী ভাবতে চাই নি। এমনি সুস্থ স্বাভাবিক শান্তিপ্রিয় ভদ্র দম্পতি ভাবতে চেয়েছি। তো সন্তান হয়নি বলে, স্ত্রী দুঃখ যাতে না করেন, সেজন্য পুরুষটি তাঁকে সান্ত্বনা দিতেন, তোমায় এমন এমন সব ছেলে এনে দেব, মাথা খুঁড়লে লোকে যা পায় না।
ভক্তদের তিনি বলতেন, একটি দুটি ছেলে মেয়ের পরে ভাই বোনের মত থাকবি। তার মানে, সন্তানসংখ্যা সীমিত রাখার বাস্তব প্রয়োজনটা তিনি একটু বুঝতেন। তখন তো পরিবার পরিকল্পনার বালাই ছিল না। তাঁহা তাঁহা শিক্ষিত লোকের তের চৌদ্দটা ছেলেপিলে হত। সেই রামকৃষ্ণ নিজের বধূ সারদা সম্পর্কে বলেছিলেন “ও সারদা, জ্ঞান দিতে এসেছে”। আমরা জানতাম ‘সারদা’ মানে সরস্বতী, আর ‘শারদা’ মানে দুর্গা। দেবী দুর্গা আর দেবী সরস্বতী, এই মা আর মেয়ের নামের সমোচ্চারণ আমায় চমৎকৃত করত। আরো পরে জানলাম সরস্বতী ও দুর্গা একই অভিন্ন শক্তির প্রকাশ।
আচ্ছা, মেয়েদের সম্বন্ধে এত বড় বড় কথা বলার পর হিন্দু সমাজে বাল্য বিবাহ, সতীদাহ, বিধবার নির্জলা উপবাস চলত কেমন করে? বিচ্ছিরি রকম ভণ্ডামি না থাকলে একমুখে এত রকম বলা যায়?

আমাদের ছোটবেলায় বাবা মুখস্থ করাতেন স্তব। বিদ্যাদায়িনী দেবীর স্তুতি। সরস্বতী বন্দনা। সে সব পঁয়তাল্লিশ বছর আগের কথা। সব শ্লোক মনে আছে। সোজাতম শ্লোকটি ছিল “জয় জয় দেবি, চরাচর সারে/ কুচযুগ শোভিত মুক্তা হারে “।। পাঁচ বছরের ছেলে, ক’ বছর হল বুকের দুধ খাওয়া ছেড়েছি, মাথায় আসে নি “কুচযুগ” মানে কি, আর বিদ্যাদেবীর বন্দনায় তাঁর “কুচ” দুটি কিসে শোভিত, তা লক্ষ্য করার কি দরকার মুনি ঋষিদের? তার পরে আরো বড় হলে পাশ্চাত্যের সেরা শিল্পীদের আঁকা দেখা অভ্যাস করি। এনসাইক্লোপিডিয়া ঘাঁটাঘাঁটি অভ‍্যাস হয়ে যায়। আর গ্রীক ও রোমক পুরাণকথা। বক্ষোসৌন্দর্য জিনিসটা ঘিনঘিনে ভাবি নি কোনোদিন। আজও বিদ্যাচর্চার সূত্রে শৈশবের প্রিয় দেবী মাতৃমূর্তিতে ধরা দেন।

সরস্বতী সম্পর্কে সেই শ্লোকটার কথা বলছিলাম। চরাচর তাঁকে বন্দনা করে, তাঁর বুক দুটিতে মুক্তোমালা শোভা পায়। হাতে তাঁর বীণা আর বই। তিনি ভগবতী এবং ভারতী। সরস্বতীকে ভগবতী কেন বলা হল, বুঝতে গিয়ে দেখি সরস্বতীর উদ্ভব কৃষ্ণের কণ্ঠ থেকে। শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে পূজা করেছিলেন। দেবী আবার শ্রীকৃষ্ণকেই কামনা করেন। তখন শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে বলেন নারায়ণ ভজনা করতে। এ কথা ব্রহ্মবৈবর্ত পুরাণে আছে। কিন্তু দেবী ভাগবত মতে সরস্বতী হলেন ব্রহ্মার স্ত্রী। দেবদেবীদের যে কত রকম!

আমাদের ছোটবেলায় গণেশের বৌ ছিল কলাবৌ। কার্তিকের বিয়ে হয় নি। লক্ষ্মী সরস্বতী দুজনকেই ভারি ফুটফুটে দেখতে হওয়া সত্ত্বেও বিয়ে টিয়ে হয় নি। তো যাই হোক, সেই কলাবধূ ছিলেন দুর্গার টিমের একজন। তিনি জমকালো শাড়ি গহনা পরতেন না। বাহন টাহনও নেই ওঁর। বাঘ সিংহ তো বলাই বাহুল্য, পেঁচা কি ইঁদুর গোছের জিনিসও জোটে না কলাবতী দেবীর। লালপাড় সাদা শাড়িতে তিনি যেন বুনো রামনাথের গেহিনী। পরে জানলাম দুর্গাই কলাবতী। তিনিই নবপত্রিকা। নয় রকম উদ্ভিদ, তাতে কচু, মানকচু, হলুদ, অশোক, ধান এইসব । তাহলে শৈলসুতা মহিষাসুরমর্দিনী দেবী দুর্গা কি কৃষিলক্ষ্মীর অন্যতম রূপ? “কর্ষণ” কথাটি কৃষি কাজ আর বিদ‍্যাচর্চা দুটিকেই বোঝাতে পারে। ইংরেজি ভাষায় যদি “কালচার” কথাটা ধরি, তখনো এগ্রিকালচার, এপিকালচার, পিসিকালচার, সেরিকালচার কথার ফাঁকে কৃষি আর জ্ঞান বিজ্ঞানচর্চা হাতে হাত ধরে এগোতে থাকে। প্রাচীন মিশরে বন‍্যার কারণে পলিবিধৌত সামতলিক কৃষিক্ষেত্রটিতে মালিকানা সুচিহ্নিত করার সূত্রে জ‍্যামিতি এসে গেল। আঙুর, মধু, যব বা ইক্ষু শর্করা থেকে মদ‍্য উৎপাদন করা হত, সে বহুদিনের কথা। মদ‍্যকে “রস” বলা হত। সেই সূত্রে “রসায়ন” কথাটা আমার মনে উঁকি মারে। বৈদিক যুগে হবি সহযোগে শূল‍্যপক্ক নধর গোমাংস সেবন করার আবশ‍্যিক অনুপান ছিল সোমরস। ঋষিরা অগ্নিতে প্রিয় দ্রব্য আহুতি দিতে দিতে দেবতাদের কাছে সুপ্রচুর খাদ‍্য পানীয় গোধুম ও যবাগু প্রার্থনা করতেন। সেই নিতান্ত জাগতিক ও স্পর্শযোগ‍্য সুখ অর্জনের প্রার্থনামন্ত্র‌ই আদিকালের ঋক। সরস্বতী সেই সময়ের নদী, সেই যুগের দেবী। তখনো দুর্গার কথা কারো মনেই আসেনি। বীণা বাজাতেন ঋষিরা। বীণাবাদনে দক্ষতা ছিল শ্রদ্ধেয় ও কাঙ্ক্ষিত। যিনি ভাল করে বীণা বাজাতে পারতেন, তাঁকে প্রবীণ বলা হত। কার্যকরী বিদ‍্যাচর্চার সাথে কলাচর্চার কোনো বিরোধ ছিল না। কলা অর্থে সুরসাধনা, নৃত‍্যচর্চা ইত্যাদি। কলাবতী দেবী সরস্বতীর কাছে প্রবীণদের সাথে সুর মিলিয়ে সকলেই প্রার্থনা করতেন জনপদটি কৃষিতে শস্য শ্যামলা হয়ে উঠুক, গাভীগুলি নিয়মিত উৎকৃষ্ট বৎস প্রসব করুক, মদ‍্য ও ঘৃতের প্রবাহ অব‍্যাহত থাকুক।
আজও কি দুর্গাপূজায় নবপত্রিকা কলাবধূর শরীর অশোক, বিল্ব, দাড়িম্ব, হরিদ্রা, আর্দ্রক, ইত্যাদি নয়টি উদ্ভিদের সমাহার হয়ে সেই প্রাচীন কৃষি ও কলাচর্চার ঐক‍্য ও সাযুজ্য ঘোষণা করছে না?

ওই যে “সারদা” আর “শারদা” শব্দ দুটির উচ্চারণের মিল লক্ষ করছিলাম। ক্রমেই বাসন্তী পূজাকে পিছনে ফেলে শারদীয়া পূজা বড়ো চেহারা নিয়ে নিল। হিমালয় কন‍্যা পার্বতী, পৌরাণিক শিবজায়া সতী, পশুপতিজায়া সিংহবাহিনী, অসুরদলনী চণ্ডী, সাধিকা অপর্ণা আর কন‍্যাস্বরূপা উমা একাকার হয়ে দুর্গতিনাশিনী হয়ে উঠলেন। সুরথ নামে রাজা আর সমাধি নামে বৈশ‍্য নিজেদের দুর্গতি থেকে উদ্ধার পেতে মেধা মুনির পরামর্শে বসন্ত ঋতুতে দুর্গাকে বাসন্তী ভুবনমনোমোহিনী রূপে পূজা করলেন। বসন্তকাল প্রেমের সময়। এক‌ই সাথে সে ঋতু পূজার‌ও। কিন্তু শরৎ ছিল অসাড়তার সময়। “শরৎ” মানে ছিল শীত। সে কালে ভীষণ ঠাণ্ডা পড়ত। পশুচর্মের শাল দিতে হত গায়ে। সর্দি কাবু করতে চাইত। সেইসব দিনে শীতের কামড় থেকে বাঁচতে ঘরের মধ্যে সময় কাটানো। শীতঘুমে যেত প্রাণীকুল। দেবতারাও শীতঘুমে অভ‍্যস্ত ছিলেন। কিন্তু রাবণের হাতে বড়ই বেকায়দায় পড়েছিলেন রাম। দুর্বাদলশ‍্যাম রাম হিংস্র রাবণের প্রতিকার খুঁজে পেতে অকালবোধন করলেন। পূজা দিলেন একশ আটটি নীলপদ্ম। দুর্গার আশির্বাদে রামের নেতৃত্বে রাবণের বিরুদ্ধে সবুজের অভিযান।
দুর্গাকথায় সরস্বতী তো আসবেনই। কেননা তিনি যে দেবীর কন্যা। কিন্তু সরস্বতী দেবীর উৎপত্তি সম্পর্কে কথিত আছে যে, পরমাত্মার মুখ থেকে একটি দেবী উদ্ভূত হন। ওই দেবী শুক্লবর্ণা, বীণাধারিণী, ও চন্দ্রের শোভাযুক্তা। এই দেবী শ্রুতি শাস্ত্রের মধ্যে শ্রেষ্ঠা, কবিদের ইষ্টদেবতা। সৃষ্টিকালে ইনি পাঁচ ভাগে বিভক্ত হন। রাধা, পদ্মা, সাবিত্রী, দুর্গা ও সরস্বতী। কি অদ্ভুত, কে কার মা, আর কে কার মেয়ে!

আমাদের ছোটো বেলায় দেবী সরস্বতীর বিশেষ মাহাত্ম্য ছিল। তিনি বিদ্যাদায়িনী। আর পেটে বিদ্যে না হলে, গরিবের ছেলে খাবে কি করে? নিম্ন মধ‍্যবিত্ত পরিবারে পেট বড়ো বালাই। তাই যেন পেটের সাথে বিদ‍্যে কথাটা জড়িয়ে থাকত। বিদ্যে মানে আসলে কলম পেষার একটি চাকরি জোটানোর এলেম। একটু বড়ো হয়ে যখন হরমোনের প্রভাব বুঝছি শরীরে মগজে, তখন বিদ্যার দেবী হয়ে উঠলেন প্রেমের দেবী। মেয়েরা স্কুলে আসত তাদের স্কুলে সরস্বতী পূজার আমন্ত্রণের কার্ড নিয়ে। আর আমরা চক্ষে একগাদা তৃষ্ণা নিয়ে তেতলার ক্লাসঘর থেকে উঁকিঝুঁকি দিতাম। “ভালবাসি”, এই কথাটা দেবীর কানে কানে বলতে অনেক সময় লেগেছে অবশ্য।

হাওড়া থেকে দক্ষিণ পূর্ব রেলপথে সাঁত্রাগাছি পেরিয়ে গিয়ে একটু পরে মৌরিগ্রাম পেরোনোর পথে ট্রেনটা একটা অতি শীর্ণ জলধারার উপর দিয়ে যায়। ওই না কি সরস্বতী নদী। বোঝো কাণ্ড! রেল কর্তৃপক্ষ সাইন বোর্ড দিয়ে না চেনালে ওটি একটি বর্জ্যজল বহনের নালা বলেই ভাবতাম।
তো বাংলায় সারস্বত চর্চার চেহারা যেমন, মৌরিগ্রামের কাছে রেল পথের নিচে নদীটির চেহারা তারই অনুরূপ। দুটো বই মুখস্থ করে, পরীক্ষার পাতায় উগরে দিয়ে ডিগ্রি বাগিয়ে কি চাকরি বাগিয়ে সে বিদ্যাকে একেবারে গোড়াশুদ্ধ বিসর্জন দেওয়া, একে তো সারস্বত চর্চা বলতে পারব না। শুক্রাচার্য কন্যা দেবযানী না কি প্রেমে ব্যর্থ হয়ে বৃহস্পতি পুত্র কচকে অভিশাপ দিয়েছিলেন, যা পড়েছ, কাজে তুমি লাগাতে পারবে না। দেবতাদের অনুগত কচ তা নিঃশব্দে মেনে নিয়েছিলেন। কিন্তু বাঙালি লোকে পড়াশুনা করে গাড়ি ঘোড়া চেপে বাবুগিরির জন্যে। সেটা নিশ্চিত হয়ে গেলে বিদ্যার বোঝা বইতে তাঁদের হাঁপ ধরে। এই নিয়ে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্রের হাহাকার আজও প্রাসঙ্গিক। মৃন্ময়ী রূপে দেবী সরস্বতী বাংলার পাড়ায় পাড়ায় মাইক যোগে তারস্বরে পূজিতা হন। কিন্তু যুক্তি দিয়ে, বিজ্ঞানবোধ দিয়ে যাকে সারস্বত চর্চা, জ্ঞানচর্চা বলে, যে জ্ঞান বহতা নদীর মতো, নানা উৎস থেকে রসসঞ্চার করে যার পুষ্টি, তার কোনো সুরাহা হবে কি?

সরস্বতী পূজার দিন। আমি কাঠ নাস্তিক লোকটি। অঞ্জলি দিই না। কোনো পূজায় অংশগ্রহণ করি না। অথচ চতুর্দিকে মাইক বাজছে। প্রতিটি অলিগলি মেতে উঠেছে সরস্বতী বন্দনায়। এই সরস্বতী আমার অচেনা। আমি এই হুল্লোড়ের সরস্বতীকে তাকিয়ে দেখব না। কিন্তু আমি যাবো কোথায়? চেনাজানা সবাই তো বাগদেবীর বন্দনায় ব্যস্ত। আমায় সময় দেবে এমন কেই বা আছেন পরিচিত বৃত্তে!
ভেবে চিন্তে স্থির করলাম পার্ক সার্কাসে যাবো সেই মুসলিম বন্ধুর বাড়ি, যাঁরা বাড়িতে উর্দুতে কথা বলেন। ওঁদের তো আজ পলাশপ্রিয়ার পূজা নেই। তাঁরা আমায় পেয়ে হয়তো খুবই খুশি হবেন। অতএব যাওয়া গেল তাঁদের বাড়িতে। ওমা, বিধি বাম। বন্ধুটি বললেন, তিনি আর তাঁর স্ত্রী দুজনে মিলে পার্ক স্ট্রিটের গলির ভিতরে তাঁর শ্বশুরবাড়ি যাবেন। আমি মহা অপ্রস্তুত হয়ে বললাম “আজ তাহলে আসি।” তাঁর বিবিজান বললেন, “সে কি, তুমি চলে যাবে কেন? আমরা তোমাকে সাথে করে নিয়েই সেখানে যাব। সারাদিন তুমি আজ আমাদের সঙ্গেই থাকবে।”
এই বলে তারা কর্তা গিন্নি বেশবাস করতে ঢুকলো। বেরোলো যখন, কর্তাটি পরেছেন ধুতি পাঞ্জাবি, মহিলা বিশুদ্ধ বাঙালিনীর শাড়ি ব্লাউজে সরস্বতী। আমি বন্ধুকে ধুতি পরা দেখে অবাক। হা হা করে এক গাল হেসে সে বললে “আজ তোদের পরব। তোকে অনার দিতে আমরা এই ড্রেস পরেছি।”
তার পর ট্যাক্সিতে পিছনের সিটে তিনজনে গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে কি হই হই।
এমন সব অদ্ভুত দিন গিয়েছে আমার। আজ বলতে ইচ্ছে করে, যথার্থ শিক্ষা আমাদের ভিতরে সম্প্রীতি স্নিগ্ধ অসাম্প্রদায়িক আচরণে উদ্বুদ্ধ করুক। পারস্পরিক ভিন্নতা ভুলে মৈত্রী ভাবনায় অনুপ্রাণিত করুক।
১০
তখন ক্লাস নাইন থেকে টেনে উঠেছি। হরমোনের প্রকাশ বেশ টের পাচ্ছি শরীরের কোণে কোণে। হরমোন মানে শিখে নিয়েছি “আমি জাগ্রত করি”। সরস্বতী পূজা উপলক্ষে এলাকার সেরা স্কুলের মেয়েরা আমাদের স্কুলে এসেছিল নিমন্ত্রণ করতে। তিনতলার ক্লাস ঘরে আটকা থেকে জানলা গলে তাদের দেখে নিয়েছি। রাস্তার ঠিক ওপারে জয়শ্রী সিনেমা হল। সেখানে সিনেমা দেখার মাঝে ইন্টারভ‍্যাল হলে মেয়েদের ইচ্ছে হত ব‍্যালকনিতে আসে। তাদের দেখবার জন‍্য মিশনারি স্কুলের পড়ুয়ার প্রাণ আনচান করত। চোখের সামনে হরমোনের প্রভাবে মেয়েদের বুকে ও নিতম্বে প্রকৃতির অপার রহস‍্যে স্নেহ পদার্থ সঞ্চিত হচ্ছিল। ত্বকের উজ্জ্বলতা আর মায়া মেদুরতা বাড়ছিল। আমার কণ্ঠস্বরে পরিবর্তন এসে গিয়েছিল। ঠোঁটের উপরে গোঁফের রেখা উঁকি মেরেছিল।
মেয়েদের স্কুলে যেতে পারা বিদ‍্যাসাগর মহাশয়ের প্রাণপণ সংগ্রামের ফল। প্রাচীনপন্থী পণ্ডিতের দল নারীদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বিরুদ্ধে জোট বেঁধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। গার্গী, অপালা, মৈত্রেয়ীর উত্তরাধিকারী ভারতীয় মেয়েরা বিদ‍্যাচর্চা করলে বিধবা হবেন, এমনতর কুযুক্তি দিতে পণ্ডিত দের বাধে নি। না জাগিলে ভারতললনা, এ ভারত জাগে না জাগে না, এমন উচ্চারণ করাতে বিদ‍্যাসাগর প্রায় বুকের রক্ত পথে ঢেলেছেন। পিতৃতান্ত্রিক অত‍্যাচারের কত কথা বাংলার অলিতে গলিতে। মেয়েদের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশুনা যেমন বারণ ছিল, কলাচর্চার উপরেও নিষেধাজ্ঞা ছিল। নাচ গান, এসব ছিল বাঈজি বাড়ির ব‍্যাপার স‍্যাপার। কলকাতার নব‍্য বড়লোকের দল বাঈজি পুষত। চোখের কোণে নিশিযাপনের কালি মাখতে লজ্জা পেত না। বাগান বাড়িতে রাত কাটাতেন ও মদ‍্য মাংসে বন্ধুদের আপ‍্যায়িত করতেন বলে স্বামী দ্বারকানাথ ঠাকুরের সংশ্রব বর্জন করেছিলেন তাঁর স্ত্রী দিগম্বরী দেবী। মেয়েদের পোশাক ছিল বাইরে যাবার অযোগ্য। সেলাই করা পোশাকের ছিল ধর্মীয় নিষেধাজ্ঞা। ঠাকুরবাড়িও ছিল এই কুৎসিত অনুশাসনের শিকার। সায়া সেমিজ ব্লাউজহীন দামি পাতলা কাপড়ে বাইরের লোকের কাছে আব্রু রক্ষা ছিল অসম্ভব। ভদ্রলোকের পরিবারে মেয়েদের অবরোধে দিন কাটাতে হত। গঙ্গা স্নান করতে চাইলে গিন্নি মাকে পালকিশুদ্ধ গঙ্গার জলে চুবিয়ে আনত বেহারার দল। বাংলা ভদ্রলোকের পরিবারে শিক্ষাচর্চা কলাচর্চা নৃত‍্য ও সঙ্গীতচর্চা যাতে কোনো ভাবেই উঁকি দিতে না পারে, তারজন‍্য প্রাচীন পন্থীরা সংগঠিত ছিলেন।
নারীদের পক্ষে কলাচর্চা যেটুকু ছিল, তা বেশ‍্যাপল্লীতে। তাদের গান ও নাচ উপভোগ করে বাবুরা মোহিত হতেন। বাংলা থিয়েটারে নারীচরিত্র রূপায়ণে এই বেশ‍্যানগরীর কন‍্যারা ছিলেন অপরিহার্য। বহু কষ্টে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ভদ্রলোকের পরিবারের মেয়েদের মঞ্চে থিয়েটার ও নাচে সামাজিক গ্রহণযোগ্য তা তৈরি করেন। আজ যাঁরা মহিলা হিসেবে মঞ্চে আলোকবৃত্তে স্থান পেয়েছেন, তাঁরা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উদ্দেশে প্রণত হোন।
আমি নবম শ্রেণিতে পড়তে পড়তে “বেশ্যা” শব্দটি শুনি। বাড়িতে “দেশ” আসত। দেশ এ শিল্প সংস্কৃতি বিষয়ক পাতায় নগ্নিকাদের ছবি থাকত। ভ‍্যান গখ, পল গঁগ‍্যা, মাতিস, পিকাসো কতজনের ছবির সাথে আলাপ হয়েছিল দেশ এর হাত ধরে। বেশ‍্যারা সমাজের বাইরে থাকে। শুনলাম কলকাতার খুব সমৃদ্ধ বেশ‍্যানগরীর নাম সোনাগাছি। আর, হাড়কাটা। শহর থাকলেই সাথে সাথে অতি অবশ‍্য বেশ‍্যাপল্লী থাকে।
এগারো ক্লাসে ভরতি হলাম বাণিজ্য নিয়ে পড়তে ব‌উবাজারে, কলকাতার অন‍্যতম সেরা কলেজটিতে। কলেজের পাশেই হাড়কাটা গলি। তার একটি শোভন নামও ছিল। প্রেমচাঁদ বড়াল স্ট্রিট। ক্লাসের পাশাপাশি বাড়ির ছাতে স্নানসিক্তা রমণীরা কেশদাম মেলে রৌদ্র পোহাতে উঠতেন।
আর্ট কলেজে ছাত্রেরা নগ্নিকাদের শরীর আঁকতেন। অতুল বসুর ছবি মনে পড়ে। এইসময় পরিতোষ সেনের “জিন্দাবাহার” আর সমর সেনের “বাবু বৃত্তান্ত” পড়ছি। আর্ট কলেজের শিক্ষা সহায়িকা এই নগ্নিকা মডেলদের সামাজিক সম্মান ছিল না থাকার মতোই। আজো ফিল্মে কোনো কোনো বাঙালিনী সাহসিকা ক্কচিৎ নগ্নদৃশ‍্য রূপায়ণ করতে এগিয়ে এলে কামুকের দল কুৎসা রটাতে নেমে পড়ে। থিয়েটার মঞ্চে নগ্নদৃশ‍্য রূপায়ণ বাংলায় আজো ভাবনাবৃত্তের বাইরের জিনিস।
সারস্বত চর্চার সূত্রে নগ্নতার যোগাযোগ ছিল। সেই আমাদের ছোটবেলায় প্লবতা নিয়ে পড়তে গিয়ে রাজার সোনার মুকুটে খাদের পরিমাণ খুঁজতে গিয়ে জ্ঞানতাপস আর্কিমিডিস ইউরেকা বলে দৌড়েছিলেন। শ্রদ্ধেয় বিজ্ঞানীর খেয়াল ছিল না, তাঁর গায়ে ভদ্রোজনোচিত পোশাক আছে না নেই। আমাদের শেষ তীর্থঙ্কর মহাবীর জিন বসনত‍্যাগ করেছিলেন। দিগম্বর শব্দটি প্রাচীন ভারতে ঘৃণ্য ছিল না। লোকে কন‍্যার নাম দিগম্বরী রাখতে সংকুচিত হত না। মন্দিরের গায়ে নরনারীর শরীরী উপাখ্যান লিখে খাজুরাহো ও কোণার্কের নাম না জানা ধীমান আর বীতপাল প্রমুখ শিল্পীরা জগতের কলারসিকের শ্রদ্ধেয়। মহাভারতের বিদুর প্রমুখ সংসার ত‍্যাগী হয়ে বনবাসী হবার কালে পোশাক ত‍্যাগ করেছিলেন। আমাদের শিব ছিলেন দিগম্বর। সেই নিয়ে বাংলা মঙ্গলকাব‍্যে মজার গল্প লিখতে সেকালের লেখক লজ্জা পান নি। সরস্বতীর বক্ষোসৌন্দর্যের বর্ণনা আমাকে ভেনাসের জন্ম মনে করিয়ে দেয়। এই সময় অশোক মিত্রের ছবি কাকে বলে, আর পাশ্চাত্যের চিত্রকলা ব‌ইদুটি পড়ছি।
এমন সময় মকবুল ফিদা হুসেন নামে বরণীয় ভারতীয় চিত্রকর সরস্বতী দেবীকে নগ্নিকা চেহারায় আঁকলেন। ছবি দেখতে বুঝতে অভ‍্যস্ত আমার চোখে সে রকম অনাবৃতা দেবীমূর্তি দেখতে অস্বস্তি বোধ হয় নি। কেন না, আমার জন‍্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখে গিয়েছিলেন “নিরাবরণ বক্ষে তব…” আর “স্তনাগ্রচূড়ায় ..” ইত্যাদি শব্দগুচ্ছ। সত‍্য ও সুন্দরের সাথে নগ্নতা যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত, এমন একটা বোধ আমার আগেই গড়ে উঠেছিল। আপোসহীন সত‍্য যে খাপখোলা নাঙ্গা তলোয়ার ছাড়া আর কিছু নয়, সে আমি জানতাম, আর সে ভাবেই কলম চালাতাম। কিন্তু মকবুল ফিদা হুসেন এর নগ্না সরস্বতী বোঝার মতো রুচিগত বৈদগ্ধ‍্য অনেকের‌ই ছিল না। পর্নো আর ইরোটিকার মধ‍্যে যে একটি অমোচনীয় ও মৌলিক পার্থক্য রয়েছে, সেই বোধ সকলের ছিল না। হিন্দু সম্প্রদায়ের মৌলবাদীরা মুসলিম শিল্পীর অনাবৃতা দেবী মূর্তিতে নিজেদের অশিক্ষিত রুচিকেই দেখতে পেল। তাই মৌলবাদী সুলভ হত‍্যার হুমকি দিতে তাদের বাধল না। শিক্ষা দীক্ষা চর্চা ভাবনা থাকলে জানত বিশ্বশ্রেষ্ঠ বৈজ্ঞানিক আইজ‍্যাক নিউটনকেও গুণী শিল্পী বসনহীন করে এঁকেছেন, আর সেই বসনহীনতাতেই বিজ্ঞানসাধকের সত‍্য সুন্দর চেহারাটি ধরা পড়েছে। দিগম্বর শিবঠাকুরের আপন দেশে বিশ্ববরেণ‍্য মকবুল ফিদা হুসেনকে হুমকি দেওয়া সম্ভব হল।
আমাদের দেশে সারস্বত চর্চা নিয়ে এই দ্বিচারিতার মূলোৎপাটন কবে হবে, বলা মুশকিল।
১১
দধীচির হাড় থেকে যে বজ্র তৈরী হয়েছিল, সে গল্প সবার জানা। এই দধীচির পিতা ছিলেন অথর্ব মুনি আর মা ছিলেন শান্তি। দধীচি ছিলেন শিবভক্ত। দক্ষ শিবহীন যজ্ঞ করতে চাইলে, দধীচি তাঁকে সেরূপ করতে নিষেধ করেন। দধীচিকে ইন্দ্র কয়েকটি বিদ্যাশিক্ষা দিয়ে বলেছিলেন যে যদি দধীচি এই বিদ্যা অন্য কাউকে শিক্ষা দেন, তাহলে তাঁর শিরশ্ছেদ অনিবার্য। কিন্তু দধীচি বিদ্যাদান ব্যাপারে ইন্দ্রের ফতোয়াকে পাত্তা দেন নি। তাতে দধীচিকে যথেষ্ট বিপদে পড়তে হয়েছিল। অশ্বিনীকুমারদ্বয়ের কৌশলে দধীচির প্রাণরক্ষা হয়েছিল। দধীচি সর্বদা কঠোর তপস্যায় নিমগ্ন থাকতেন। ইন্দ্রের তাতে ভারি অস্বস্তি হত। কেউ কঠোর তপস্যা করছেন শুনলেই ইন্দ্রের প্যানিক হত। তপস্যা ভাঙাতে নানা ফিকির খুঁজতেন ইন্দ্র। দধীচির তপস্যা ভাঙাতে ইন্দ্র অলম্বুষা নামে এক অপ্সরাকে এনগেজ করেন। অলম্বুষা এমনি সাংঘাতিক সুন্দরী যে, তাঁর দর্শনেই দধীচির শুক্র সরস্বতী নদীর জলে পতিত হয়। নদী সরস্বতী সে শুক্র উদরস্থ করে “সারস্বত” নামে পুত্রের জন্ম দেন।
এদিকে বিশ্বকর্মার পুত্র বিশ্বরূপ তপস্যা করে নিজেকে সংহত করছে দেখে ইন্দ্র তাকে হত্যা করেন। তাতে ক্ষুব্ধ হয়ে বিশ্বকর্মা বৃত্রকে সৃষ্টি করেন। কালে বৃত্র ইন্দ্রের ত্রাস হয়ে ওঠেন। সুনিশ্চিত ভাবে জানা যায় যে দধীচির অস্থি দিয়ে নির্মিত অস্ত্রে বৃত্রসংহার হবে। তখন ইন্দ্রের প্রার্থনায় উদারচেতা দধীচি নিজের জীবন বিসর্জন দিয়ে বজ্রের উপাদান সংগ্রহ করে দেন। সেই অস্থি থেকে বজ্র তৈরী করে ইন্দ্র নিরানব্বইবার বৃত্রদের নিহত করেন।
যাঁরা সারস্বত ব্যক্তিত্ব, অর্থাৎ লেখক, সাহিত্যিক, বিজ্ঞানী, প্রকৌশলী, শিক্ষক , অধ্যাপক, তাঁরা প্রকৃতপক্ষে এই দধীচির সন্তান। দধীচির লিগ্যাসি সারস্বতদেরই মানায়।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।