মজুর, মার্ক্স ও মে দিবস
অন্ততঃ এই আদালত তো কিছুতেই এইসব ঘটনা, এই বাস্তবতা অস্বীকার করতে পারেন না। এই আদালত জানেন বাস্তব ঘটনা ঠিক কী ছিল। আমার কথাটা ঠিকঠাকভাবে আপনাদের কাছে তুলে ধরতে আমি কী বলেছি, আর বিগত জীবনে আমি কী করেছি, তা একবার উল্লেখ করা জরুরি মনে করছি। আর সেটা বলতে গেলে আমায় তো একটু সময় দিতেই হবে। তো বক্তৃতাটি আমার একটু দীর্ঘ হলেও, অন্ততঃ ন্যায়বিচারের স্বার্থে এই প্রাণদণ্ড পাওয়া আসামীর কথাগুলো আপনাদের একটু বিস্তারিত ভাবে শোনা উচিত। সবাই জেনেছেন, আমার জীবনের বিগত কুড়িটি বছর ধরে আমি কী করেছি। আমি অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ ও সক্রিয়ভাবে সেই কাজ করেছি যার নাম আমেরিকার শ্রমিক আন্দোলন। সেই আন্দোলনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে যুক্ত ছিলাম বলে প্রথমতঃ নিজের যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে, এবং চারপাশের ঘটে চলা বাস্তবতার দিকে সতর্ক চোখ মেলে থাকার কারণে আমি কিঞ্চিৎ সত্যবস্তু জেনেছি এবং উপলব্ধি করেছি। আজ জীবন মৃত্যুর সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আমি এই আদালতের কাছে নিঃসঙ্কোচে নির্ভাবনায় সেই পূর্ণায়ত সত্যের কথাটা তুলে ধরতে চাই। ১৮৮০ খ্রিস্টাব্দের আমেরিকার আদম সুমারি প্রতিবেদন অনুযায়ী এই আমেরিকায় ষোল কোটি দুই লক্ষ মজুর শ্রমিক রয়েছে। এই লোকগুলো তাদের ঘাম ঝরিয়ে এই আমেরিকার সমস্ত ধনসম্পদের জন্ম দিচ্ছে। এই প্রসঙ্গে আর কিছু বলার আগে শ্রমমুক্তি আন্দোলনের পরিভাষায় মজুর শ্রমিক বলতে ঠিক কী বোঝায়, তা পরিষ্কার করে বুঝে নিতে হবে। ‘মজুর শ্রমিক’ বলতে তেমন মানুষকে বোঝায় যে মজুরি পাবার লক্ষ্যে কাজ করে এবং ঘণ্টার পর ঘণ্টা, দিনের পর দিন, সপ্তাহের পর সপ্তাহ, মাসের পর মাস, বছরের পর বছর, গতরে খেটে ঘাম ঝরানো শ্রম বিক্রি করা ছাড়া যার বেঁচে থাকার আর কোনো রাস্তা নেই। তাদের কুটিরে খুদকুঁড়ো যা কিছু আছে, তা তাদের কায়িক শ্রমের বিনিময়ে অর্জন করা। তাদের যৎসামান্য সম্পত্তির সমস্তটুকুই তাদের হাড়ভাঙা খাটুনির বিনিময়ে এবং দক্ষ শ্রমের মূল্যে গড়ে তোলা। বলা ভাল, শুধুমাত্র দুখানি খালি হাত ছাড়া তাদের আয়ের ভিন্ন কোনো রাস্তা নেই। তারা যতদিন কাজ করবার সুযোগ পায়, ততদিন তারা বাঁচে। আর তাই তারা যাদের হাতে পুঁজি আছে, তাদের কাছে কাজ চায়, এবং কাজ চাওয়ার মাধ্যমে আসলে বেঁচে থাকার অধিকার প্রার্থনা করে। এই যে ষোল কোটি দুই লক্ষ মজুর আমেরিকায় আছে, ১৮৮০-র আদম সুমারিতে যে তথ্য উঠে এসেছে, তার মধ্যে নয় কোটি হল পুরুষ। আর যদি প্রতিটি পুরুষের কুটিরে তাকে নিয়ে মোট পাঁচজন জীবন ধারণ করে, তাহলে তাদের সংখ্যাটা দাঁড়ায় পঁয়তাল্লিশ কোটি। সুমারিতে বলা হয়েছে, এখন আমেরিকায় মোটামুটি বারো কোটি ভোটার আছে। এই বারো কোটি ভোটারের মধ্যে নয় কোটি ভোটার মজুর শ্রমিক। বাকি জনসংখ্যাটা মহিলা আর বাচ্চারা, যাদের ভোটাধিকার নেই, তারাও কলে কারখানায়, খনিতে আর নানারকম পেশায় খাটছে। এই যে গতরে খাটা মানুষের দল, এই শ্রমিকশ্রেণী, শুধুমাত্র এরাই এই দেশের সমস্ত দরকারি আর উৎপাদনশীল পরিশ্রমটা করছ আর এদেরকেই ভাড়া করে, নির্ভরশীল করে রেখে, মালিকশ্রেণী টিঁকে আছে। ইওর অনার, আমি নিজে একজন খেটে খাওয়া লোক হয়ে শ্রমজীবী শ্রেণীর ন্যায়সংগত দাবিগুলি উপলব্ধি করতে পেরেছি। আমি তাদের মুক্তির অধিকার, আর নিজেদের শ্রমের ফসল নিজেরা ভোগ করার অধিকার, কে কোথায় কাজ করবে, আর কতটা কাজ করবে, সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবার অধিকারকে সমর্থন করতে চেয়েছি। আর এখনকার বক্তব্যে আমি এই আদালতের সামনে ব্যাখ্যা করতে চাই, কেন আমাকে প্রাণদণ্ড দেওয়া ঠিক নয়। অথবা, কেন আমাকে নতুন করে একটা বিচারের সুযোগ দেওয়া উচিত। আর এই আদালতের বোঝা উচিত, এদেশে নাগরিকদের যে শ্রেণীটা এই আদালতের কাছে দাবি করছে যাতে আমাদের বাঁচার সুযোগ না দেওয়া হয়, তার গূঢ় তাৎপর্যটা কী? মহাশয়, আমি বিশ্বাস করি, এদেশে চিকাগো সিটিজেনস অ্যাসোসিয়েশন নামে ক্রোরপতিদের যে সংগঠনটা আছে, তাদের একজন প্রতিনিধি এই আদালতের কাছে দাবি পেশ করেছেন, আমাদেরকে যেন তীব্র অসম্মান ও হেনস্থার সঙ্গে এবং সর্বোচ্চ ধরনের নিষ্ঠুরতার সঙ্গে মেরে ফেলা হয়। এখন আমি অতি সাধারণ মানুষের একজন হয়ে, শ্রমজীবী জনতার একজন হিসাবে দাবি করব, আমি যে কথাটা বলতে চাই, সে কথাটা একটু মনোযোগ দিয়ে শুনুন। আজ আপনি পুঁজিপতি মালিকশ্রেণী আর আমাদের মতো গরিব লোকের মধ্যে একটা প্রাকার হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। যাতে সহসা মালিকশ্রেণী আর শ্রমজীবী, এই দুপক্ষের মধ্যে একটা মারাত্মক দ্বন্দ্ব না লেগে যায়, তা নিশ্চিত করতে আপনি একটা প্রাচীর, একটা পরিখা হিসাবে কাজ করছেন। এখানে আপনার জায়গাটা ন্যায়বিচারের প্রতিভূ হিসাবে। আজ আপনি এখানে ন্যায়দণ্ড হাতে অবতীর্ণ। আপনার কাছে আশা করা যায় যে, আপনি কোনোরকম পক্ষপাতিত্ব না করে, নিরপেক্ষ অবিচলিত বিচারধারাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরবেন। একটা মানুষকে কয়েদ করে আনা হয়েছে বলেই ইওর অনার, এটা ধরে নেওয়া যায় না যে, সে অপরাধী। আপনার আইনের বইতে এমন ভূরি ভূরি নিদর্শন আছে, যেখানে দেখানো হয়েছে একটা মানুষকে ফাঁসিকাঠে লটকে দেবার পর প্রমাণ হয়ে গেছে যে লোকটা নিরপরাধ ছিল। বিচার প্রক্রিয়ার অযোগ্যতা, অপদার্থতার কারণে নিরপরাধের এই যে মৃত্যু, একে জুডিশিয়াল মার্ডার বলে। তাই যে রকম তাড়াহুড়ো করে এই আদালত প্রাণদণ্ড উচ্চারণ করে দিলেন, যে পদ্ধতিতে রায় দিয়ে ফেললেন, তাতে কার কোন্ স্বার্থ সুরক্ষিত হল? বিচারের কোন্ প্রজ্ঞা তুলে ধরা হল? তাড়াহুড়ো করে, দ্রতগামী ট্রেনকে হার মানিয়ে এই যে আপনি সাতটা লোকের বিরুদ্ধে ফাঁসির দণ্ডাজ্ঞা উচ্চারণ করে ফেললেন, তাতে কোন্ সত্য প্রতিষ্ঠিত হল? কেন ইওর অনার এত তাড়াহুড়ো করে আমাদের ফাঁসির দড়িতে ঝুলিয়ে না দিলে কি আপনার চলছিল না?
ক্রমশ