সাপ্তাহিক ধারাসম্পাতে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ২৪)

আমার কথা

৯৩
আমার তো বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়কে অসাধারণ লাগে। সেই যে দেবী চৌধুরানী পড়েছিলাম , তাতে পিতৃহারা কন্যা প্রফুল্ল আর তার মায়ের জাতি মারা হয়েছিল বিনা অপরাধে। আসলে গরিবের মেয়ে ছিল বলেই অতি সহজে প্রফুল্লদের জাতি মারা যেত। আর জাতি মারা গেলে তাকে শ্বশুর গৃহ থেকে বের করে দেওয়া কি আর এমন ব্যাপার?
ভর যুবতী মেয়ে একাটি কোথায় যাবে, কি খাবে তা দেখার কোনো দায়িত্ব সমাজের ছিল না। জাতি মেরেই খালাস।
বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় হিন্দুয়ানির এই অমানবিক দিকটি দারুণ করে দেখিয়েছেন ।

৯৪
প্রফুল্লের শ্বশুর মশাই কে মনে আছে? নৌকার তলা ফেঁসে ব্রজেশ্বরের বাবা প্রফুল্লের শ্বশুর যখন ডুবতে বসেছেন, তখন তিনি ভাবলেন, ডুবেই যখন গিয়েছি, তখন আর ঈশ্বরের নাম নিয়ে কি হবে? ধর্মধ্বজীর ঈশ্বর চেতনাকে নিয়ে ভারি মজা করেছেন খোদ বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়।

৯৫
হুতোম পেঁচার নকশা সাগ্রহে গিলেছি তরুণ বয়সেই। কলকাত্তাই বাবু বিবিদের বিলাস সম্পর্কে হাতে গরম জ্ঞান লাভ করার চমৎকার বই । বাবুরা পাঁঠা খাবেন বলে পুজোর হুজুগ করেন । আর বাইনাচ , শ্যাম্পেন ও ক্লারেটের বন্যা বইয়ে বাবুয়ানার পরাকাষ্ঠা বজায় রাখেন। মেয়েমানুষ ( হ্যাঁ , সচেতন প্রয়োগ আমার) না হলে বাবুদের ফুত্তি পুরো হয় না ।
একজনেরা নৌকা নিয়ে ফুত্তি করতে যাবার সময় মেয়েমানুষ পায় নি বলে নিজের ঘরের বিধবা পিসিটিকে নিয়ে গিয়েছিল। তারা ভাবতো মেয়েছেলে সাথে না থাকলে ফুত্তি হয় না ।
হুতোম পড়ার আনন্দ আমি ভুলতে পারি নি।

৯৬
আমি যে পরিমণ্ডলে বড়ো হচ্ছিলাম, সেখানে বয়স্করা অনেকেই দীক্ষা নিতেন । তাদের গুরু থাকতেন। কখনো গুরুমা , গুরুপুত্রও । একই গুরুর শিষ্যগণ পরস্পরকে গুরুভ্রাতা বলে সম্বোধন করতেন । মানে গুরু সুত্রে একটা বড়ো পরিবার গড়ে উঠত । গুরু গত হলে সাধারণতঃ গুরুর উপযুক্ত পুত্র গুরুর আসন অলংকৃত করতেন।
গুরুসূত্রে ব্যবসায়ীদের নিজেদের মধ্যে বিবাদ বিসংবাদ অনেক সময় মিটিয়ে নেবার সুযোগ হত। গুরুরা মধ্যস্থতাও করতেন। গুরুসঙ্গে ব্যবসা বাড়তো পরিচিতির বৃত্ত বাড়ার সুযোগে। গুরুরা কখনো কখনো শিষ্য বাড়ি যেতেন এবং বেশ ভাল দক্ষিণা পেতেন ।
এসব মোটের ওপর বড়ো হবার সাথে সাথে জেনে যাচ্ছিলাম। কিন্তু মহালেখক নীরদ সি চৌধুরী পড়তে গিয়ে জেনে ফেললাম যে গুরুরা আরো অনেক কিছু করতেন । শিষ্যবাড়িতে বিবাহ অনুষ্ঠানে গুরু হতেন বিশিষ্ট অভ্যাগত । নববধূকে গুরু আশীর্বাদ করতেন। সে আশীর্বাদী অনুষ্ঠান গুরু শুধুমাত্র নবোঢ়াটিকে অর্গলবদ্ধ দরজার ভিতরে থেকে নরম নতুন শয্যার উপর করতেন । লেখক নীরদ সি চৌধুরী নিজের বিবাহের সময় এই ধরণের আশীর্বাদী অনুষ্ঠানে নিজের খাটের নিচে গোপন থেকে মোক্ষম সময়ে গুরুটিকে হাতে নাতে ধরেন ও যারপরনাই অপমান করেন বলে পড়েছিলাম। তখন আমি সিলেবাসের বাইরে খুশি মতো পড়ার নেশা ধরেছি ।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।