ছোটো ছেলে। লিটলবয়। ভাবা যায় না, একটি শিশুর মতো নিষ্পাপ একটি বিষয়কে একটা সাংঘাতিক ধ্বংসলীলার সাথে জড়িয়ে দেওয়া যায়। যুদ্ধবাজ হিংস্র দাম্ভিক নির্মানুষেরা তা করতে পারে। তারা পরমাণু বোমার নাম দেয় ‘লিটলবয়’, পরমাণু বিস্ফোরণের নাম দেয় ‘বুদ্ধ হাসছেন’। ভগবান বুদ্ধকে এত জঘন্য ভাবে অপমান করা বোধহয় তথাকথিত সভ্য মানুষের পক্ষেই সম্ভব।
তারিখটি ছিল ১৯৪৪ সালের ৬ আগস্ট। জাপানের হিরোশিমা শহরের উপরে পাক খাচ্ছে একটা বিমান। নাম তার এনোলা গে। সে বিমান যেমন তেমন একটা বিমান নয়। ওকে বলতে হবে সুপার ফোর্ট্রেস। দুর্জয় দুর্গ। জাতের বিচারে সে বোয়িং বি ২৯ বিমান। বিমানটি চালাচ্ছিলেন দুজন।
কর্ণেল পল ওয়ারফিল্ড টিবেটস জুনিয়র, আর ক্যাপ্টেন রবার্ট এ লুইস। বোমাটার ওজন ৪৪০০ কিলোগ্রাম। লম্বায় ১০ ফুট আর ব্যাস ২৮ ইঞ্চি।
ওর ভিতরে চৌষট্টি কিলোগ্রাম ইউরেনিয়াম ২৩৫ ভরা ছিল। লিটলবয় আসলে একটি বিশেষ ডিজাইনের পরমাণু বোমার নাম।
হিরোশিমায় যেটা ফাটানো হবে, সেটা ওই ডিজাইনের ছাব্বিশ নম্বর বোমা। বোমা হিসেবে আদৌ কর্মদক্ষ ছিল না ছাব্বিশ নম্বরের লিটলবয়। চৌষট্টি কিলোগ্রামের মধ্যে মোটে এক কিলোও পুরোপুরি কাজে লাগানো যায় নি। তবু তাতেই পনেরো কিলোটন টিএনটির বিস্ফোরণের অভিঘাত হয়েছিল।
ছয় আগস্টের সকাল। জাপানের ঘড়িতে সকাল আটটা পনেরো। এনোলা গে বিমান থেকে ফেলা হল লিটলবয় বোমাটি। ৪৪.৪ সেকেণ্ড ধরে পড়তে পড়তে মাটি থেকে প্রায় দুহাজার ফুট উচ্চতায় বোমাটি ফেটেছিল। বিস্ফোরণের সরাসরি অভিঘাতে মারা গিয়েছিল ছেষট্টি হাজার মানুষ। আর ঊনসত্তর হাজার মানুষ আগুনের গোলায় নানামাত্রায় জখম হয়েছিলেন। যেখানে বোমাটি পড়েছিল, সেখানে সাড়ে তিন কিলোমিটার ব্যাসের এলাকা জুড়ে মানুষ মারা গিয়েছিল। ১.৬ কিলোমিটার এর মধ্যে থাকা সমস্ত কিছু নিমেষে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল। একটা তীব্র চোখ ধাঁধানো আলো আর ভয়ঙ্কর তাপ উপলব্ধি করতে না করতেই মানুষ শেষ হয়ে গিয়েছিল। একশো কুড়ি তলা বাড়ির মতো উচ্চতার একটা আগুনের গোলা, যার তাপমাত্রা ছিল ছয় হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস, তা গ্রাস করল সমস্ত শহরটাকে। বোমাটি ফাটার মিনিট কুড়ি পরে এই আগুনের গোলাটা একটা আগুনের ঝড়ের চেহারা নেয়। ঝড়ের দাপটে বাড়ি ঘর কাঠ এবং কাচ ভেঙে ছুটতে থাকে। ১.৩ কিলোমিটার জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে তীব্র ও বিপজ্জনক নিউট্রন এবং গামা রশ্মির বিকিরণ।
যাঁরা আগুনের হাত থেকে কোনোভাবে বাঁচতে পেরেছিলেন, তাঁরা বিকিরণের জ্বালায় দগ্ধাতে দগ্ধাতে ক্যানসার নিয়ে মৃত্যুর জন্য দিন গুণতে লাগলেন।
আজও হিরোশিমা তেজস্ক্রিয় বিকিরণের কারণে বিকলাঙ্গ ও অসুস্থ শিশুর জন্ম দিয়ে চলেছে।
১৯৪৫ সালের ৯ আগস্ট নাগাসাকিতে যে বোমাটি ফেলা হয়েছিল, তার নাম ছিল ফ্যাট ম্যান। এই বিমানটিও একটি সুপার ফোর্ট্রেস বোয়িং বি ২৯ বিমান। এর নাম ছিল বসকার। বিমানের পাইলট ছিলেন মেজর চার্লস সুইলি। নাগাসাকির বোমাটি এই জাতীয় বোমার একশো কুড়ি নম্বরের ছিল। এটি হিরোশিমার বোমার থেকেও ভারি ছিল। ভর ছিল ৪৬৭০ কিলোগ্রাম। এটি দৈর্ঘ্যে ছিল পৌনে এগারো ফুট , ব্যাস ছিল পাঁচ ফুট। এতে ৬.৪ কিলোগ্রাম প্লুটোনিয়াম ভরা হয়েছিল। ৯ আগস্টের ভোর রাত। তখন তিনটে সাতচল্লিশ মিনিট। বসকার বিমান ফ্যাট ম্যান বোমা পেটে নিয়ে উড়াল শুরু করল। জাপানি সময় বেলা এগারোটা দুই মিনিটে বোমাটি ফেলা হল।
তেতাল্লিশ সেকেণ্ড ধরে আকাশ থেকে পড়তে পড়তে মাটি থেকে পাঁচশো মিটার উঁচুতে বোমাটি ফাটল। সবচাইতে বেশি ধ্বংস লীলা নিশ্চিত করতে শহরের সবচাইতে জনবহুল এলাকায় ফ্যাট ম্যানকে ফেলার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকায় সঠিক জায়গায় বোমাটি ফেলতে পারেন নি বসকারের চালক।
বোমাটি পড়ল গিয়ে লক্ষ্যস্থলের থেকে দুই মাইল দূরে। ফ্যাট ম্যানের বিস্ফোরণে নাগাসাকিতে সঙ্গে সঙ্গে চল্লিশ হাজার মানুষ মারা পড়ে। আহত হন আশি হাজার মানুষ। এদের একটা বড়ো অংশ তেজস্ক্রিয় বিকিরণ জনিত অসুখে ভুগতে থাকেন।
ভগবান শ্রীকৃষ্ণ কুরুক্ষেত্রের রণাঙ্গনে যুদ্ধবিরোধী স্বজনপ্রেমী অর্জুনকে জ্ঞাতি ও আত্মীয় নিধনে উদ্দীপ্ত করে তুলেছিলেন। অর্জুনের একটি নাম ভারত। ভারতকে তিনি নিজের বিশ্বরূপ দেখিয়েছিলেন। সে নাকি কোটি সূর্যের পরাক্রম। তিনি বলেছিলেন, আমি মহাকাল। ভারতকে তিনি ঠিক কি কি বলেছিলেন, শ্রীভগবানের মুখেই শোনা যাক্
পশ্য মে পার্থ রূপাণি শতশোহথ সহস্রশঃ। নানাবিধানি দিব্যানি নানাবর্ণাকৃতীনি চ।।
এইসব কথা শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা র একাদশ অধ্যায়ে রয়েছে। অর্জুন তাঁর সম্পর্কিত দাদা কৃষ্ণ, যিনি মহাভারতীয় যুদ্ধে তাঁর রথের সারথি হয়েছেন, তাঁকে বলছেন, আপনি কে? আপনার এই রূপ দেখে আমার যে ব্যথা লাগছে, আপনি দয়া করে এই রূপ সংবরণ করুন। গীতায় বলছেন,
মা তে ব্যথা মা চ বিমূঢ়ভাবো দৃষ্ট্বা রূপং ঘোরমীদৃঙ্মমেদম্।
ব্যপেতভীঃ প্রীতমনাঃ পুনস্তং তদেব মে রূপমিদং প্রপশ্য।।
কুরুক্ষেত্রের এই কৃষ্ণকথাই যেন আত্মস্থ করে ভারতের যৌবনকে জাগাতে কাজী নজরুল ইসলাম তাঁর বিদ্রোহী কবিতায় লিখেছেন।
মম ললাটে রুদ্র ভগবান জ্বলে রাজরাজটীকা দীপ্ত জয়শ্রীর … বলছেন, আমি চির দুর্দম দুর্বিনীত নৃশংস, আমি মহাভয়, আমি অভিশাপ পৃথ্বীর, আমি দুর্বার। আমি ঝঞ্ঝা, আমি ঘূর্ণি, আমি পথসম্মুখে যাহা পাই যাই চূর্ণি। আমি মহামারী, আমি ভীতি এ ধরিত্রীর। আমি সৃষ্টি, আমি ধ্বংস, আমি বজ্র, আমি ঈশান বিষাণে ওঙ্কার, আমি ইস্রাফিলের শিঙ্গার মহা হুঙ্কার। আমি দাবানলদাহ, দাহন করিব বিশ্ব। আমি বসুধা বক্ষে আগ্নেয়াদ্রি, বাড়ব বহ্নি কালানল,
ঠিক এই অনুভবটাই করেছিলেন বিখ্যাত তাত্ত্বিক পদার্থ বিজ্ঞানী জুলিয়াস রবার্ট ওপেনহাইমার (২২.০৪. ১৯০৪ – ১৮.০২.১৯৬৭) । তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে আমেরিকার লস অ্যালামস ল্যাবরেটরির কর্তৃত্বে ছিলেন। এখানেই লিটলবয় ও ফ্যাটম্যান সিরিজের পরমাণুবোমাগুলি তৈরি হয়েছিল। ১৯৪৫ সালের ৬ ও ৯ আগস্টে মানুষের পৃথিবী দ্বিতীয় ও তৃতীয় পরমাণু বিস্ফোরণ দেখেছিল। প্রথমটির আয়োজন হয়েছিল ওই বছরের জুলাই মাসে। সেখানে বিজ্ঞানী ওপেনহাইমার ছিলেন অন্যতম অগ্রণী কর্মকর্তা।
সেই বিস্ফোরণ দেখে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় একাদশ অধ্যায়ে দ্বাদশ শ্লোকটি বলেন। দিবি সূর্যসহস্রস্য ইত্যাদি।
আজও পৃথিবীতে পরমাণু বোমা হামলার প্রস্তুতি চলছে। প্রতিবেশী দেশে সীমান্ত পারে হিরোশিমা নাগাসাকির ধ্বংস লীলা গড়ার স্বপ্ন নিয়ে যুদ্ধ বিমান কিনছেন গরিব অনাহারী দেশের যুদ্ধখ্যাপা রাষ্ট্রনায়ক। তার সাথে মেশাচ্ছেন ধর্মের চোলাই। মন্দির এবং যুদ্ধবিমান একসাথে। মনে পড়ছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কবিতা বুদ্ধভক্তি। জাপানের সৈন্য ভগবান বুদ্ধের মন্দিরে পূজা দিতে চলেছে, যাতে প্রতিবেশী দেশ চীনের মানুষকে শেষ করে দিতে পারে। সাথে রয়েছেন হৃষীকেশ, যুদ্ধ ক্ষেত্রে দাঁড়িয়ে হাসতে হাসতে বলছেন, কালোহস্মি লোকক্ষয়কৃৎ… দাঁত বের করে চোখ মটকে বলছেন, তস্মাৎ ত্বমুত্তিষ্ঠ যশো লভস্ব জিত্বা শত্রূন্ ভুঙক্ষ্ব রাজ্যং সমৃদ্ধম্। বলছেন, নিমিত্তমাত্রং ভব সব্যসাচিন্।