সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে মৃদুল শ্রীমানী
” ডিনামাইট বোমা কে ছুঁড়েছিল?”
জুলিয়াস গ্রিনেল, অভিযোগকারী পুলিশপক্ষের আইনজীবী হিসেবে সুপিরিয়র কুক কাউন্টি আদালতে মামলা শুরু করতে গিয়ে বললেন যে অগাস্ট স্পিজ হলেন বোমা বিস্ফোরণের নাটের গুরু। গ্রিনেল দাবি করলেন, অগাস্ট স্পিজ অনেক দিন ধরেই আরবেইটার জাইটুং কাগজে সন্ত্রাসবাদের সপক্ষে কলমবাজি করে চলেছিলেন। ওই কাগজে ওঁর লেখাগুলিতে চোখ রাখলেই বেশ বোঝা যায় স্পিজ বলছেন, শ্রমিকদের জন্য সুবিচার আদায় করতে হলে সন্ত্রাসসৃষ্টির কোনো বিকল্প নেই। স্পিজ নিয়মিতভাবে শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে সন্ত্রাসী হামলার গ্রহণযোগ্যতা তৈরি করে চলেছিলেন। গ্রিনেল আরো বললেন যে, হে মার্কেট কাণ্ডের আগের দিন একটা লিফলেট প্রচার করা হয়েছিল। ওই লিফলেট মুসাবিদা করেছিলেন স্পিজ স্বয়ং, আর ওই উত্তেজনা ছড়িয়ে গোলমাল পাকানোই ছিল স্পিজের লক্ষ্য।
হে মার্কেট কাণ্ডের আগের দিন, মে মাসের তিন তারিখে সন্ধ্যায়, অভিযুক্ত জর্জ এঞ্জেল আর অন্যান্য নৈরাজ্যবাদীরা গ্রিফ হলের বৈঠকে জড়ো হয়েছিল। ওই বৈঠকেই নৈরাজ্যবাদী নেতৃত্ব সিদ্ধান্ত নেয় যে আগামীকাল চার তারিখে পুলিশের উপর ডিনামাইট হামলা করা হবে। গ্রিনেল এরপর বললেন, গ্রিফ হলের মিটিং থেকেই জর্জ এঞ্জেল বোমা বিশেষজ্ঞ লুইস লিঙের সঙ্গে যোগাযোগ করে বোমা সরবরাহ করতে নির্দেশ দেন। এঞ্জেলের আশা ছিল যে, এই বোমা বিস্ফোরণের পরেই গোটা চিকাগো শহরের শ্রমজীবীদের অভ্যুত্থান ঘটবে।
দুঁদে আইনজীবী গ্রিনেল এও বললেন যে, সত্যি সত্যি যে লোকটা বোমা ছুঁড়েছে, সে কিন্তু এই কোর্টে উপস্থিত নেই, কিন্তু সেটা খুব বড় কথা নয়। আদালতের জুরিদের সামনে তিনি বললেন, এই যে নৈরাজ্যবাদী নেতৃবৃন্দ যারা অভিযুক্ত হিসেবে এখানে হাজির রয়েছে, তাদেরকে কোনোভাবেই ছেড়ে দেওয়া যাবে না। মাননীয় জুরিগণ, আপনারা কে বোমা ছুঁড়েছিল, সেই প্রশ্নটিকে বড় করে না দেখে, লক্ষ্য করুন যে মার্ডার করার জন্য মতলব এঁটেছিল এই জঙ্গি সংগঠনের লোকগুলো, তারপর একজোট হয়ে বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে দিল। যেই বোমা ছুঁড়ুক, আসল কালপ্রিট হল, কারা এই বিস্ফোরণ ঘটানোর প্ররোচনা জুগিয়েছিল, কারা বোমা জুগিয়েছিল কারা লোকজনকে খেপিয়ে তুলেছিল।
ধুরন্ধর আইনজীবী গ্রিনেল খুব ভাল করেই জানতেন অভিযুক্ত নৈরাজ্যবাদী নেতৃবৃন্দ বোমা ছোঁড়ায় জড়িত ছিলেন না। যা সত্য নয়, তা প্রমাণ করা অসম্ভব। আর গোটা মিটিং ছিল শান্তিপূর্ণ। অভিযুক্তদের কয়েকজন ওখানে যায়ই নি। তাই খুব কায়দা করেই বোমা ছোঁড়ার ব্যাপারটাকে গ্রিনেল লঘু করে দিতে চাইলেন। বোমা ছোঁড়ার পিছনে একটা ষড়যন্ত্রের গল্প বানালেন।
আর চিকাগোর পুলিশ প্রশাসন কী চেয়েছিলেন?
বিচার, অথবা বিচারের প্রহসন।
আগেই বলেছি, চিকাগোর পুলিশ প্রশাসনের বোমা ছোঁড়ার অপরাধীকে ধরার আগ্রহ ছিল না। তাদের মূল লক্ষ্য ছিল আমেরিকার গর্জমান শ্রমিক আন্দোলনের কোমর ভেঙে দেওয়া। ওই কারণে তারা শ্রমজীবী আন্দোলনের আপোসহীন নেতৃত্বকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে পুঁজিবাদকে নিরাপত্তা দিতে চেয়েছিল। শ্রমিকের সঙ্গে মালিকের যে দ্বন্দ্ব, তা চরিত্রগতভাবে অনিরসনীয়। আর রাষ্ট্রশক্তি আমেরিকাতে প্রকাশ্যভাবেই পুঁজিপতিদের সেবাদাস হয়ে উঠেছিল।
বন্দী শ্রমিকনেতৃত্বের উপর প্রথম আঘাতটি হেনেছিলেন করোনার জুরি। এক্ষেত্রে করোনার শব্দের অর্থ হল মৃত্যুসমীক্ষক। তিনি একজন পদাধিকারী, সরকারি অফিসার, যিনি কোনো অস্বাভাবিক মৃত্যুর সুরতহাল করেন। একজন করোনারকে যে চিকিৎসা শাস্ত্র, সবিশেষ পারঙ্গম থাকতে হবে, তা কিন্তু নয়। এমনকি পোস্ট মর্টেম নিয়েও তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা থাকার বাধ্যবাধকতা নেই। যেখানে আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে যে মৃত্যুটি খুব স্বাভাবিক নয়, সেক্ষেত্রে একজন করোনার নিজের বাস্তব বিচারবুদ্ধি প্রয়োগ করে মৃত্যুর কারণ ও প্রেক্ষাপট সম্বন্ধে একটি সিদ্ধান্তে আসবেন।
আর এই করোনারের সিদ্ধান্তটিকে আরো মজবুতি ও গ্রহণযোগ্যতা দিতে জুরির নিয়োগ। করোনার জুরি করোনারের দৃষ্টিভঙ্গিকে সমর্থন দিয়ে সাধারণের কাছে আরো গ্রহণযোগ্য করে তুলবেন।
চৌঠা মে রাতে হে মার্কেট হাঙ্গামাতে পুলিশ অফিসারদের মধ্যে যে ব্যক্তির প্রথম মৃত্যু ঘটেছিল, তাঁর নাম ম্যাথিয়াস দেগান। দেগান এর সুরতহালকে পুলিশ শ্রমিকনেতৃত্বের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চাইল। কুক কাউন্টি কোর্টের মামলাতে সংশ্লিষ্ট করোনার জুরি বলে বসলেন যে, পুলিশ অফিসার ম্যাথিয়াস দেগানের মৃত্যুর ঘটাতে সহযোগিতা করেছেন, প্ররোচনা জুগিয়েছেন, এবং উৎসাহ দিয়েছেন অগাস্ট স্পাইজ, মাইকেল শোয়াব, স্যামুয়েল ফিলডন আর অ্যালবার্ট পারসনস।
লক্ষ্য করুন, অন্ধকারে ভিড়ের মধ্যে বোমা কে ছুঁড়েছিল, সেই প্রশ্নটি এড়িয়ে যাবার জন্য কৌশল অবলম্বন করে প্ররোচনা যোগানোতে জোর দেওয়া হল। অথচ কে যে বোমা ছুঁড়ল, সেই লোকটিকে চিহ্নিত করার উদ্যোগ পুলিশ নিল না।
অপরাধ ঘটাতে অপরাধীকে প্ররোচিত করা দণ্ডবিধি মতে অবশ্যই অপরাধ। কিন্তু যে লোকটা হাতে করে বোমাটা ছুঁড়ল, তাকে চিহ্নিত না করেই, বিচারের আওতায় না এনেই, শুধু প্ররোচনা দিয়েছেন এই অজুহাতে শ্রমিকনেতৃত্বের অপরাধ প্রমাণ হয়ে গিয়েছে, ঘোষণা করা বিচার নয়, বিচারের প্রহসন মাত্র। গোটা আমেরিকায় তো বটেই, এমনকি সারা পৃথিবীতে এমন বিচারের প্রহসনের কোনো তুলনা মেলা ভার। বিচারের গোড়ায় অ্যালবার্ট পারসনস পুলিশের অধরা ছিলেন। তিনি উইসকনসিন এ তাঁর এক সমাজতন্ত্রী বন্ধুর বাড়িতে গা ঢাকা দিয়েছিলেন। কিন্তু পারসনস যখন তাঁর স্ত্রী লুসির মাধ্যমে তাঁর ভ্রাতৃপ্রতিম শ্রমিকনেতৃত্বের যৌথ আইনজীবী বা ডিফেন্স লইয়ার উইলিয়াম ব্ল্যাকের বার্তা পেলেন যে, পারসনস ফেরার থাকলে কোর্টের কাছে বন্দী শ্রমিকনেতৃত্বকে নিরপরাধ প্রমাণ করা শক্ত হবে। এই বার্তা পেয়ে পারসনস মনস্থির করলেন যে, ডিনামাইট বোমা ফাটার অনেকটা আগেই তিনি সভাস্থল পরিত্যাগ করে গেলেও, এবং বোমা ছোঁড়ার সঙ্গে কিছু মাত্র যোগসাজশ না থাকলেও তিনি সশরীরে আদালতে হাজির হলে যদি বন্দী ভ্রাতৃপ্রতিম শ্রমিকনেতাদের নিরপরাধ প্রমাণে কিছুমাত্র সুবিধা হয়, তা তিনি করবেন। ভিড়ে ঠাসা কোর্টরুমে শান্তচিত্তে অ্যালবার্ট পারসনস প্রবেশ করলেন, এবং বন্দী শ্রমিকনেতাদের পাশে গিয়ে আসন গ্রহণ করলেন। জনতা পারসনসের এই ভূমিকা দেখে মুগ্ধ হয়ে গেল।
কুক কাউন্টি কোর্টরুমে অ্যালবার্ট পারসনস একটি অসাধারণ বক্তৃতা রাখেন। ওজস্বিতা, মননশীলতা ও হৃদয় তোলপাড় করা একটি দীর্ঘ বক্তৃতা। পারসনসের বক্তব্য শেষ হবার মিনিটখানেকের মধ্যে কুক কাউন্টি কোর্টের বিচারক জোসেফ এস্টন গ্যারি তাঁর রায় দিলেন। ওই রায়ে পারসনস আর তাঁর ভ্রাতৃপ্রতিম শ্রমিকনেতৃত্বের মধ্যে আরো ছয়জনের ফাঁসির আদেশ দিলেন।
কুক কাউন্টি কোর্টের এই বিচার পারসনস ও দণ্ডপ্রাপ্ত অন্যান্য শ্রমিকনেতৃত্ব নিশ্চুপে মেনে নেন নি। তাঁরা আইনি পদ্ধতিতে ইলিনয় প্রদেশের স্টেট সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেছিলেন। স্টেট সুপ্রিম কোর্টে কুক কাউন্টি কোর্টের বিচারক জোসেফ এস্টন গ্যারির রায়ের বিরুদ্ধে আপিলের আর্গুমেন্ট শুরু হয়েছিল ১৮৮৬ র নভেম্বরে। প্রায় এগারো মাস পরে ১৪ সেপ্টেম্বর ১৮৮৭ তারিখে স্টেট সুপ্রিম কোর্ট তাঁদের রায়ে নিম্ন আদালতের সিদ্ধান্ত বহাল রাখলেন।
স্টেট সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হয়েছিল আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টে। দণ্ডপ্রাপ্ত বন্দিদের তরফে রিট অফ এরর এর প্রসঙ্গ তুলে বলা হয়েছিল, আমেরিকার সংবিধানের চতুর্থ ও ষষ্ঠ সংশোধনীতে বর্ণিত ডিউ প্রসেসের সুযোগ দণ্ডিত ব্যক্তির প্রাপ্য ছিল। কিন্তু আমেরিকার সর্বোচ্চ আদালত এই যুক্তি খারিজ করে দিয়ে নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখেন।
বিচার না বিচারের প্রহসন?
সরকারি আইনজীবী জুলিয়াস গ্রিনেল তাঁর আর্গুমেন্ট গুটিয়ে এনে বলেছিলেন, মহামহিম বিচারকমণ্ডলী, আপনারা জীবিত ও মৃত মানুষের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছেন। ভেবে দেখুন, আপনারা কার পক্ষে? আপনারা দাঁড়িয়ে আছেন আইন আর আইন ভাঙার মাঝখানে। ভেবে দেখুন, আপনারা কার পক্ষ নেবেন! অনুগ্রহ করে সমস্ত দুর্বলতা ঝেড়ে ফেলে আপনাদের মহা মূল্যবান দায়িত্ব সতেজে সুগম্ভীর শৌর্য বীর্যের সঙ্গে পালন করুন। সেই দায়িত্ব পালন যতই নিষ্করুণ ও সুকঠোর হোক না কেন, তা পালন করেই আপনাদের মহত্ত্ব প্রকাশিত হোক।
বিপরীতে অভিযুক্ত পক্ষের অ্যাটর্নি উইলিয়াম ফস্টার তাঁর আর্গুমেন্টের শেষে বলেছিলেন:
এই অভিযুক্ত ব্যক্তিগণ শুধুমাত্র নিজেদের দার্শনিক অবস্থান জনসমক্ষে প্রচার করেছিলেন। এটা ঠিক যে, ওঁদের দার্শনিক বিচারবোধ এবং চিন্তাধারার সঙ্গে সাধারণ ভাবে আমাদের ন্যায়বোধ ও পরম্পরার সম্পূর্ণ বৈপরীত্য আছে। তবু, শুধুমাত্র মতবাদ প্রচার করেছেন, এই কারণে ওঁদের শাস্তিদান অনুচিত। সেইভাবেই যদি বর্তমানের বিচারালয় চলতে চান, তাহলে এখানে আর আমার আর্গুমেন্ট করার কোনো মানে নেই।
বেশ, তাহলে শেরিফ মহোদয় বেরিয়ে পড়ুন, আর ফাঁসির মঞ্চ খাড়া করুন। তারপর ফাঁসিকাঠ থেকে আটখানা ফাঁস ঝুলিয়ে দেওয়া হোক। দুলতে থাকুক মরণফাঁস। তারপর ওগুলো ওই আট হতভাগ্যের গলায় জড়িয়ে টেনে দেওয়া হোক। শেষ হয়ে যাক বিচারের এই নিষ্ঠুর অর্থহীন প্রহসন।
অথচ বিচারক গ্যারির ট্রায়াল কোর্টে চিকাগোর মেয়র কার্টার হ্যারিসন স্বয়ং দাঁড়িয়ে বলেছিলেন, হে মার্কেটের জনসভা সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ ছিল, এ তিনি নিজের চোখে যাচাই করে এসেছিলেন। তিনি বেশ খুঁটিয়ে লক্ষ্য করে টের পেয়েছিলেন শ্রমিকদের হাতে কোনো অস্ত্রশস্ত্র ছিল না। মেয়র হ্যারিসন শপথপূর্বক কোর্টকে জানিয়েছিলেন যে, তিনি স্থানীয় পুলিশ আধিকারিক বনফিল্ডকে বলেছিলেন, খামখা এই শান্তিপূর্ণ সমাবেশে তাঁর পুলিশবাহিনীকে দাঁড় করিয়ে না রেখে, তাদেরকে ছুটি দিয়ে ব্যারাকে পাঠিয়ে বিশ্রাম মঞ্জুর করুন। এটা হ্যারিসন এ কারণে বলেছিলেন, কেননা তিনি বুঝেছিলেন যে অশান্তি পাকিয়ে তোলার কোনো সম্ভাবনা নেই। মেয়র হ্যারিসনের এই জবানবন্দি আরো অনেকজন প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষী সমর্থন করেছিলেন।
অভিযুক্তপক্ষের আরেকজন আইনজীবী সিগমুণ্ড জাইসলার গণ্ডগোল পাকানোর জন্য পুলিশকে সরাসরি দায়ী করলেন। বিশেষ করে বললেন, পুলিশ ইন্সপেক্টর বনফিল্ডের অপরিণামদর্শী বিচারবোধহীন অবিমৃষ্যকারী পদক্ষেপের জন্যই হে মার্কেটের ঘটনা ঘটে গেল। সিগমুণ্ড জাইসলার বললেন, এই যে পুলিশের কয়েকটি লোক, যারা হে মার্কেটের ঘটনায় প্রাণ খুইয়েছে, এরা মোটেও কোনো বীরত্বের কাজ করতে গিয়ে প্রাণ দেয় নি। ওরা কেউ মহান বীর নয়। ওরা সামান্য সরকারি বেতনভুক গুণ্ডা মাত্র। ওরা গুণ্ডা, আসলে ভিতুর ডিম। ভিতু কাপুরুষগুলো নিজেদের গায়ে সরকারি উর্দি চাপিয়েছিল বলেই মহান হয়ে যেতে পারে না। আর ওদের ওই ইন্সপেক্টর বনফিল্ড লোকটা পুলিশ আধিকারিকের উর্দির যোগ্যই নয়। ও ওই চেয়ারটাকে কলঙ্কিত করে দিয়েছে।
জাইসলার আরো বললেন, হে মার্কেটের সভা শ্রমিকেরা ডেকেছিল রীতিমতো নিয়ম মেনে, প্রশাসনের অনুমতি আদায় করে। আর সভা ছিল শান্তিপূর্ণ। আর পুলিশ ইন্সপেক্টর বনফিল্ড এমন একজন বিকৃতমনস্ক আধিকারিক, যে কিনা একটা শান্তিপূর্ণ সমাবেশকে বিঘ্নিত করতে ভারি অস্ত্রে শস্ত্রে সজ্জিত একশো আশিজন পুলিশের একটা বাহিনীকে লেলিয়ে দিল! এই কাণ্ড করেই বনফিল্ড তার এতগুলি অফিসারকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিল। তথাকথিত নৈরাজ্যবাদী অশান্তি কে করেছে? মহামান্য বিচারক মহাশয়, অবধান করুন, সমস্ত অশান্তির হোতা ওই পুলিশ ইন্সপেক্টর বনফিল্ড।
জাইসলার ঠিক যেখানে ছাড়লেন, সেখান থেকেই সুর চড়ালেন অভিযুক্তদের আরেক আইনজীবী অ্যাটর্নি উইলিয়াম ফস্টার। তিনি বললেন, মহামান্য আদালত বিচার করে দেখুন, অভিযুক্ত অ্যালবার্ট পারসনস তাঁর বিবি আর বাচ্চাদের নিয়ে এসেছিলেন এই সমাবেশে। আচ্ছা, বলুন তো, দাঙ্গা হাঙ্গামা পাকানোর মতলব থাকলে কেউ ঘরের বৌ বাচ্চাদের নিয়ে লড়াইয়ের ময়দানে যোগ দেয়? আমাদের স্বাভাবিক বিচারবোধ কী বলে?
অভিযুক্ত পক্ষের আইনজীবী হিসেবে অ্যাটর্নি উইলিয়াম ফস্টার বললেন যে, একটা মদের বারে হে মার্কেট সমাবেশ নিয়ে কতকগুলি প্রচারপত্র পাওয়া গিয়েছে আর অস্কার নিবির বাড়িতে একটা আগ্নেয়াস্ত্র ছিল, শুধুমাত্র এই দুটো এভিডেন্সের উপর অস্কার নিবিকে বোমা বিস্ফোরণের ঘটনায় জড়িত বলে দেওয়া যায় না।
একজনের বাড়িতে আগ্নেয়াস্ত্র থাকলেই সে দাঙ্গা হাঙ্গামায় জড়িত, এমন দাবি করা অত্যন্ত দুর্বল যুক্তি। ফস্টার আরো বললেন, হ্যাঁ, এটা ঘটনা যে লুইস লিঙ একজন বোমা বিশেষজ্ঞ। কিন্তু হে মার্কেটের বোমাটা যে তিনিই ছুঁড়েছেন, এটা তো প্রমাণিত নয়। যে অভিযোগ আইনের চোখে সুনিশ্চিত ও সংশয়াতীতভাবে প্রমাণিত হল না, তেমন একটা অভিযোগ উঠেছে বলেই একজন ব্যক্তিকে অপরাধী সাব্যস্ত করা যায় না।
আইনজীবী ফস্টার এই মামলায় জুরিদের উদ্দেশে বলেছিলেন, পুলিশ শুধুমাত্র আক্রোশ ও শত্রুতার মনোভাব থেকে শ্রমিক নেতাদের বিরুদ্ধে মানুষ খুন ও দাঙ্গা হাঙ্গামার কেস সাজিয়েছে — আসলে তাদের অভিযোগের মধ্যে এক পয়সার যুক্তিও নেই। তিনি জুরিদের বলেছিলেন, হে মাননীয়গণ! আপনারা আক্রোশের মনোভাব পরিত্যাগপূর্বক নিরপেক্ষ হৃদয় ও স্বাধীন বিচারবোধ নিয়ে আইনের প্রয়োগ করুন। আপনারা এমন কিছু করবেন না, যে অবিচারের গ্লানি আপনাদের কবরে যাওয়ার সময় পর্যন্ত তাড়া করে ফিরবে!
বিচারক জোসেফ ইস্টন গ্যারি ( ৯ জুলাই ১৮২১ – ৩১ অক্টোবর, ১৯০৬) কুক কাউন্টির সুপিরিয়র কোর্টে হে মার্কেট কাণ্ডে ন্যক্কারজনক রায় দিয়েছিলেন। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি আইনজীবী হিসেবে কাজ করার পর কুক কাউন্টির সুপিরিয়র কোর্টে বিচারক হিসেবে মনোনীত হয়েছিলেন। ১৮৮৬ তে তিনি শ্রমিক নেতৃবর্গ অগাস্ট স্পিজ, মাইকেল শোয়াব, স্যামুয়েল ফিলডন, অ্যালবার্ট পারসনস, অ্যাডলফ ফিশার, জর্জ এঞ্জেল এবং লুইস লিঙকে ফাঁসির আদেশ দেন। অস্কার নিবিকে পনেরো বছরের কারাদণ্ড দেন।
অথচ আটজন শ্রমিক নেতৃত্বের একজনের বিরুদ্ধেও বোমা হামলার ঘটনা প্রমাণিত হয় নি। এমনকি বোমা ছোঁড়ার সঙ্গে এই আটজন দণ্ডপ্রাপ্ত শ্রমিকনেতার ন্যূনতম যোগাযোগটুকুও আদালতে প্রমাণ করা যায় নি।
বিচারক গ্যারি শুধুমাত্র বিশ্বাস করেছিলেন, এই নেতৃবৃন্দের বক্তৃতা যে বোমা ছুঁড়েছিল, তাকে উৎসাহ উদ্দীপনা জুগিয়েছিল।
পুলিশের তরফে হে মার্কেটের ঘটনার ইনভেস্টিগেশন করেছিলেন ক্যাপ্টেন মাইকেল শ্যাক। শ্যাকের নজর ছিল কি করে শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে কঠিনতম সাজা নিশ্চিত করে আমেরিকার শ্রমিক আন্দোলনের কোমর ভেঙে দেওয়া যায়। এই লক্ষ্য থেকে পুলিশ গোয়েন্দা শ্যাক বোমা হামলার সম্ভাব্য ব্যক্তিদের খোঁজ খবর নেবার বিষয়কে ন্যূনতম গুরুত্ব দেন নি। নইলে লক্ষ্য করা যেত যে, রুডলফ শনাউবেল্ট ( ১৮৬৩ – ১৯০১) নামে এক ব্যক্তিকে চিকাগো পুলিশ ডিপার্টমেন্টের জেনারেল সুপারিনটেনডেন্ট ফ্রেডারিক এবেরসোল্ড ১৮৮৬-র ১৪ জুন তারিখে খুন করা ও দাঙ্গা বাধানোর অভিযোগে অ্যারেস্ট করার জন্য পরোয়ানা জারি করেছিলেন।
রুডলফ শনাউবেল্ট কিন্তু চিকাগো শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়, এমনকি কাউন্টি ছেড়েও পালায়। অথচ গোয়েন্দারা তার দিকে তীক্ষ্ণ নজর রেখেছিলেন। এমনকি, সরকারি সাক্ষী হ্যারি গিলমার শপথপূর্বক বলেছিলেন, যে তিনি রুডলফ শনাউবেল্টকে বোমা ছুঁড়তে দেখেছিলেন। আর কোর্টের সম্মুখে একটা ফোটোগ্রাফ দেখে সেখানে শনাউবেল্টকে শনাক্ত পর্যন্ত করেছিলেন।
শনাউবেল্ট বোমা ছুঁড়েছিল, এটা কোর্টের সামনে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ হয়ে গেলে অগাস্ট স্পিজ, অ্যালবার্ট পারসনস প্রমুখ আটজন শ্রমিক নেতৃত্বের বিরুদ্ধে খুন এবং দাঙ্গা বাধানোর মামলা দাঁড় করানো শক্ত হত। তাঁদের ফাঁসিতে ঝোলানো যেত না। এমনকি উচ্চ আদালতে মামলা খারিজ হয়ে যাবার আশঙ্কা ছিল। এই সমস্ত ব্যাপারটাকে ঢেকেচেপে শ্রমিক আন্দোলনের কোমর ভাঙার লক্ষ্য নিয়ে রুডলফ শনাউবেল্টকে পুলিশ বিচারালয়ে টেনে আনল না। ইচ্ছাকৃতভাবে কে বোমা ছুঁড়েছিল, এই প্রশ্নের থেকে পুলিশ মুখ ফিরিয়ে রইল।
মনে রাখতে হবে পুলিশ কিন্তু শ্রমিক সংগঠনের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে বোমা ছোঁড়ার অভিযোগ কোর্টে প্রমাণ করতে পারে নি। এমনকি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে যে অভিযুক্ত আট নেতার মধ্যে কেউই বোমা ছোঁড়ার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না।
শ্রমিকদের মধ্যে গ্যারির এই বিচার অথবা বিচারের প্রহসন নিয়ে তীব্র ক্ষোভ বিক্ষোভ হয়েছিল। দেশের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ গ্যারির এই অবিচারকে ধিক্কার দিয়েছিলেন। আর অস্কার ওয়াইল্ড, জর্জ বার্নার্ড শ প্রমুখ বিশ্বের প্রথমসারির সাহিত্যিক বুদ্ধিজীবীরা এই অবিচারের বিরুদ্ধে কণ্ঠ তুলেছিলেন। মামলা গেল ইলিনয় প্রদেশের সুপ্রিম কোর্টে। সেটা ১৮৮৭। সেখানেও সুবিচার না পেয়ে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টে সার্টিওরারি আবেদন পেশ করলেন শ্রমিকদের আইনজীবী জন র্যানডলফ টাকার, রজার অ্যাটকিনসন প্রায়র, জেনারেল বেঞ্জামিন এফ বাটলার, এবং উইলিয়াম পি ব্ল্যাক।
সার্টিওরারি হল একধরনের রিট বা আদেশ, যার মাধ্যমে উচ্চতর আদালত অধস্তন আদালতের বিচার করা কোনো মামলা রিভিউ অর্থাৎ পরীক্ষা করতে পারেন। সার্টিওরারিতে উচ্চতর ক্ষমতাসম্পন্ন আদালত অধস্তন আদালতকে নির্দেশ দিতে পারেন, তাঁরা যেন তাঁদের কাছে পড়ে থাকা বা বিচারাধীন অবস্থায় থাকা কোনো মামলা উপরে পাঠিয়ে দেন। এমনকি সার্টিওরারি প্রয়োগে উচ্চতর আদালত অধস্তন আদালতের সিদ্ধান্ত নাকচ করেও দিতে পারেন।
যদি অধস্তন আদালত একতিয়ারের বাইরে গিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন, বা একতিয়ার যতটুকু ক্ষমতা দিয়েছে, তার চেয়ে বেশি কিছু করে ফেলেন, বা বাড়াবাড়ি করে ফেলেন, কিংবা যতটুকু ক্ষমতা দেওয়া আছে, তা প্রয়োগ না করে থাকেন, তখন সার্টিওরারি প্রয়োগে তা সংশোধন করা যায়।
সার্টিওরারি প্রয়োগে অধস্তন আদালতের ভুলচুক ত্রুটি সংশোধন করানো যায়। সার্টিওরারি মানে হল জ্ঞাত হওয়া, অবগত হওয়া। সংবিধানে ধৃত ব্যক্তিমানুষের অধিকার অধস্তন আদালতের হাতে বিপন্ন হলে, তেমন ক্ষেত্রে উচ্চতর আদালত সার্টিওরারি প্রয়োগ করতে পারেন।
অথচ হে মার্কেট মামলাটি সার্টিওরারি প্রয়োগের প্রশ্নে বিশেষভাবে উপযুক্ত ছিল।
প্রথমতঃ সুপিরিয়র কুক কাউন্টি আদালত, এবং বিশেষতঃ বিচারক জোসেফ ইস্টন গ্যারি খুব সচেতনভাবে কে বোমা ছুঁড়ে ছিল, সেই ব্যাপারে কঠোরভাবে অনুসন্ধানে বিরত ছিলেন। আদালত বেশ বুঝতে পেরেছিলেন অভিযুক্ত আটজন শ্রমিকনেতার একজনও বোমার ব্যাপারে জড়িত ছিলেন না। অথচ বিচারক মনঃস্থির করে রেখেছিলেন যে এই নেতাদের তিনি কোনোভাবেই বাঁচতে দেবেন না। ওই কারণে বোমা ছোঁড়ার ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিতকরণের প্রশ্নকে সম্পূর্ণ এড়িয়ে গিয়ে কেবল উত্তেজক বক্তৃতা ও কাগজে তীব্র প্রতিবাদী লেখার উপর ভর করে গ্যারি সাতজন শ্রমিকনেতৃত্বের জন্য প্রাণদণ্ড এবং একজনের জন্য পনেরো বছরের কারাদণ্ড মঞ্জুর করেছিলেন।
দ্বিতীয়তঃ গোয়েন্দা পুলিশের চোখে বোমা ছোঁড়ার ব্যাপারে তীব্র সন্দেহভাজন ব্যক্তি রুডলফ শনাউবেল্টকে মে মাসেই দু দুবার অ্যারেস্ট করেও ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। এরপর ১৪ জুন, ১৮৮৬ তারিখে শনাউবেল্ট চিকাগো পুলিশের জেনারেল সুপারিনটেনডেন্ট ফ্রেডারিক এবেরসোল্ড এর হাতে লেখা পরোয়ানা পেয়েও চিকাগো ছেড়ে, এমনকি কাউন্টি ছেড়ে পালাতে পেরেছিল। তাকে ধরে আনার উদ্যোগই নেওয়া হয় নি।
তৃতীয়তঃ আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশে মানুষ মতপ্রকাশের সুযোগ পাবে, এটা সাংবিধানিক অধিকার। তাই সংবাদপত্রে কলমচালনা এবং শ্রমিক সমাবেশে বক্তৃতা, এ দুটোর কোনোটাই অসাংবিধানিক নয়। তাই, বোমা যে ছুঁড়েছিল, তাকে চিহ্নিত করার উদ্যোগ না নিয়ে যাঁরা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে শ্রমিক আন্দোলনের চেষ্টায় যত্নবান ছিলেন, তাঁদের একযোগে ফাঁসির আদেশ অবশ্যই সুপ্রিম কোর্টের কাছে সার্টিওরারি হিসেবে বিবেচিত হওয়া সঙ্গত ছিল।
কিন্তু আমেরিকার গণতান্ত্রিক অধিকারকে মিথ্যা বাগাড়ম্বর প্রমাণ করে আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট অধস্তন আদালতের এই অদ্ভুত বিচারের উপরেই আস্থাশীল রইলেন। সার্টিওরারি গৃহীত হল না। শ্রমিক নেতৃত্বের বাঁচার সমস্ত পথ রুদ্ধ হয়ে গেল। স্থির হল যে ১৮৮৭র নভেম্বরের এগারো তারিখে ওঁদের ফাঁসি কার্যকর হবে।
ফাঁসির আগের দিন, ১৮৮৭র নভেম্বরের ১০ তারিখে স্যামুয়েল ফিলডন আর মাইকেল শোয়াব এই দুই নৈরাজ্যবাদী নেতা ইলিনয়ের তদানীন্তন গভর্নর রিচার্ড জেমস অগলেসবি (২৫ জুলাই ১৮২৪ – ২৪ এপ্রিল ১৮৯৯) এর কাছে প্রাণভিক্ষা করলেন। অগলেসবি ছিলেন একজন পোড়খাওয়া রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। রাজনৈতিক দলীয় পরিচিতির বিচারে তিনি ছিলেন রিপাবলিকান। প্রথম জীবনে রিচার্ড ছিলেন একজন সৈনিক। ১৮৮৭ তে তিনি তৃতীয়বারের জন্য ইলিনয় প্রদেশের গভর্নরের পদে আসীন ছিলেন। এর আগে ১৮৬৫ – ১৮৬৯ সময়কালে প্রথমবারের জন্য গভর্নর হন। পরে ১৮৭৩ এ দশদিনের জন্য গভর্নরের চেয়ারে ছিলেন। রিচার্ড তাঁর পদাধিকার বলে দুই শ্রমিকনেতা ফিলডন ও শোয়াবের ফাঁসির আদেশ রদ করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন।