জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর।
বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন।
চাকরীসূত্রে ও দৈনন্দিন কাজের অভিজ্ঞতায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের সমস্যা সমাধানে তাঁর লেখনী সোচ্চার।
আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু
তিনি যে সুরের আগুন ধরিয়ে দিলেন। বললেন আগুন আমার ভাই, আমি তোমারই জয় গাই। আরো বললেন, আগুন জিনিসটা কেমন। বললেন, তার শিকল ভাঙা রাঙা মূর্তির কথা। বললেন, সে হাতের দড়ি পায়ের বেড়ি ছাই করে দিতে জানে। আগুনের আরো কথা বললেন, আঁধারের গায়ে গায়ে তার স্পর্শের কথা।
সুখ? চ্যালেঞ্জ করে বলেন, যাক না গো সুখ জ্বলে।
তিনি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। অনুজকে আশীর্বাদ করে বললেন, আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু। ‘ধূমকেতু’ নাম দিয়ে পত্রিকা বের করবেন বলে কাজী নজরুল ইসলাম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে আশীর্বাণী চাইতে এসেছেন। বরেণ্য কবি তাঁকে ওইরকম লিখে দিলেন। আঁধারে বাঁধ অগ্নিসেতু। চারদিকে আঁধার হয়ে আছে। সব খুশি খুশি ব্যাপার নয়। হাসি হাসি মুখ নয়। ভেতরে ভেতরে সব ব্যথিয়ে আছে। বাহিরিতে চায় দেখিতে না পায়, কোথায় কারার দ্বার। এই আঁধার বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে সকলকে, একে অপরের থেকে। এইখানেই সেতু বাঁধতে হবে কবিকে। তবে, যে সে সেতু নয়। যা হোক, তা হোক একটা কাঠামো মাত্র নয়। সেতুটা কিন্তু আগুনের। কিন্তু কেন সে জিনিস আগুনের তৈরি?
কবি তার উত্তর দিয়ে রেখেছেন গানে। মিথ্যা যত হৃদয় জুড়ে এই বেলা সব যাক না পুড়ে…
আর বলছেন, আড়াল তোমার যাক রে ঘুচে, লজ্জা তোমার যাক রে মুছে। আরো বলছেন, চিরদিনের মতো তোমার ছাই হয়ে যাক ভয়।
সেই সুরটা ধরে নিলেন জীবনানন্দ দাশ। বললেন,
নক্ষত্র সূর্যের সাথে সঞ্চালিত হয়ে তবু আলোকের পথে
মৃত ম্যামথের কাছে কুহেলির ঋণ
শেষ করে মানুষ সফল হতে পারে
বললেন,
ইতিহাসে ঘুরপথ ভুল পথ গ্লানি হিংসা অন্ধকার ভয়
আরো ঢের আছে, তবু মানুষকে সেতু থেকে সেতুলোক পার হতে হয়।
একটি কবিতায় জীবনানন্দ বলছেন,
হৃদয়কে সেখানে করে না অবহেলা
বুদ্ধির বিচ্ছিন্ন শক্তি। আশাবাদের কথাই বলছেন,
তবু আদি ব্যথা হবে কল্যাণী
জীবনের নব নব জলধারা – উজ্জ্বল জগতে।
আজ আমি এই সহস্রাব্দ ছোঁয়া দুজন আধুনিক কবির কাব্যভাবনায় ওই অগ্নিসেতুর কথা বলি। জ্যেষ্ঠ শামসুর রাহমান। আজকের দিনে ১৯২৯ সালে অবিভক্ত বঙ্গের ঢাকা শহরে জন্মেছেন। বেঁচেছেন ছিয়াত্তর বছর। ২০০৬ সালে সতেরো আগস্ট, বাংলাদেশের ঢাকা শহরে তাঁর প্রয়াণ। সম্মানিত হয়েছেন বাংলা আকাদমি ও আনন্দ পুরস্কারে। অনুজ সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ১৯৩৪ সালের সাত সেপ্টেম্বরে ওই অবিভক্ত পূর্ব বঙ্গেরই ফরিদপুরে জন্মেছেন। আটাত্তর বছর বেঁচে থেকে ২০১২ সালে আজকের দিনে তাঁর প্রয়াণ। সুনীল সাহিত্য আকাদমি ও আনন্দ পুরস্কারে সম্মানিত হয়েছেন।
সাল তারিখ থেকে পরিষ্কার যে তাঁরা মোটামুটি একই কালখণ্ডে বেঁচেছিলেন। জ্যেষ্ঠ শামসুর বাংলাদেশে, কনিষ্ঠ সুনীল এই বঙ্গে।
মোটের উপর একরকম পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে দুই দেশ এগিয়েছে। এর মধ্যেই তাঁরা কবিতা লিখেছেন। দেশভাগের সময় পূর্ববঙ্গ হয়ে গেল পূর্ব পাকিস্তান। সেখানে বাঙালির প্রাণের ভাষা মুখের ভাষাকে সম্মান থেকে বঞ্চিত করতে চাইল পাকিস্তানি শাসক। বাঙালির যৌবন এর বিরুদ্ধে জোরদার লড়াই গড়ে তুলেছিল। তারই ধারাবাহিকতায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। নতুন রাষ্ট্র জন্ম নিল বাংলাদেশ।
সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দেশের হাল ধরলেন জনপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্ট তাঁকে খুন করে ক্ষমতা হাসিল করে সামরিক বাহিনীর নায়ক।
এপার বাংলাতেও পর পর দুটি যুক্তফ্রন্ট সরকারের পতনের পর সত্তর দশকের ঝড়। নকশাল অভ্যুত্থান, আর গণহত্যা। রাজ্যটা বাহাত্তর সালে চলে গেল জঘন্য অপশাসক সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়ের কবলে। তার পুলিশ সাকরেদ রুনু গুহনিয়োগীরা নরকের শাসন নামিয়ে আনল।
ছিয়াত্তর সালে ইন্দিরা গান্ধীর ফ্যাসিস্ট জরুরি অবস্থা জারি। গণতন্ত্রের কণ্ঠরোধ।
এই পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে শামসুর রাহমান আর সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, এই দুই কবিকেই বাঁচতে হয়েছে, এগোতে হয়েছে, সাহিত্য আন্দোলনের রূপরেখা গড়তে হয়েছে। চিনতে হয়েছে ধূর্ত শাসককে, চিনতে হয়েছে তাদের নানা ছলাকলা। নিজের নিজের কলমে দুই কবিই শাসকের বিরুদ্ধে লিখতে ভয় পান নি।
শামসুর রাহমান স্বাধীনতার সঙ্গে অগ্রজ কবিদের অভিজ্ঞানকে এক করে দেখেছেন। রবীন্দ্রনাথ আর নজরুল ইসলামের কাব্যচেতনা তাঁর যুদ্ধের আয়ুধ।
স্বাধীনতা তুমি রবি ঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান
স্বাধীনতা তুমি কাজী নজরুল, ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো মহান পুরুষ
সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা…
স্বাধীনতা জিনিসটা যে কি, কিভাবে, কত মূল্যে পেতে হয়েছে, তা আরো লেখেন শামসুর।
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
শহরের বুকে জলপাইয়ের রঙের ট্যাঙ্ক এলো
দানবের মত চিৎকার করতে করতে
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
ছাত্রাবাস বস্তি উজাড় হলো। রিকয়েললেস রাইফেল
আর মেশিনগান খই ফোটালো যত্রতত্র।
তুমি আসবে ব’লে, ছাই হলো গ্রামের পর গ্রাম।
তুমি আসবে ব’লে, বিধ্বস্ত পাড়ায় প্রভুর বাস্তুভিটার
ভগ্নস্তূপে দাঁডিয়ে একটানা আর্তনাদ করলো একটা কুকুর।
তুমি আসবে ব’লে, হে স্বাধীনতা,
অবুঝ শিশু হামাগুড়ি দিলো পিতামাতার লাশের উপর।
শামসুর রাহমান লেখেন আসাদের শার্ট। সেখানে বলেন, আমাদের দুর্বলতা, ভীরুতা কলুষ আর লজ্জা
সমস্ত দিয়েছে ঢেকে একখণ্ড বস্ত্র মানবিক ;
আসাদের শার্ট আজ আমাদের প্রাণের পতাকা ।
তিনি লিখেছিলেন, রয়েছি দাঁড়িয়ে/দরোজা আগলে,পিতা,অধীর তোমারই প্রতীক্ষায়।/ এখনো কি ঝঞ্ঝাহত জাহাজের মাস্তুল তোমার/বন্দরে যাবে না দেখা? অস্ত্রাগারে নেবে না আয়ুধ/আবার অভিজ্ঞ হাতে? তুলবে না ধনুকে এ টঙ্কার?
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও নিজের সময়কে ভাষা দিয়েছেন।
সুনীল বলেন,
আমার ভ্রমণ মর্ত্যধামে,
আগুন দেখে আলো ভেবেছি, আলোয় আমার
হাত পুড়ে যায়
অন্ধকারে মানুষ দেখা সহজ ভেবে ঘূর্ণিমায়ায়
অন্ধকারে মিশে থেকেছি
কেউ আমাকে শিরোপা দেয়, কেউ দু’চোখে হাজার ছি ছি
তবুও আমার জন্ম-কবচ, ভালোবাসাকে ভালোবেসেছি
আমার কোনো ভয় হয় না,
আমার ভালোবাসার কোন জন্ম হয় না, মৃত্যু হয় না।।
আমি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এর সর্বহারা অবিশ্বাসী কবিতার দিকেও দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।
ইতিহাসকে যত্নের সঙ্গে উপলব্ধি করে আজকের কবিকে সর্বহারার মুক্তি আন্দোলনের দিশা দেখান সুনীল। স্থিতাবস্থায় অবিশ্বাস হানতে শেখান। প্রশ্ন তুলতে শেখান। প্রণতভাবে ভক্তিভরে পদযুগলের দিকে চেয়ে জনতার মুক্তি নেই। সর্বহারাকে প্রথাগত জীবনভাবনায় অবিশ্বাসী হতে হবে। নির্মম কঠোরভাবে প্রশ্ন তুলে যেতে হবে প্রাণ হাতে করে। ধর্মান্ধতা, মৌলবাদী ভাবনার বিরুদ্ধে লাগাতার যুদ্ধ করতে হবে। এইপথে আলো জ্বেলে, এ পথেই পৃথিবীর ক্রমমুক্তি হবে।
অগ্নিসেতু কবিকেই গড়তে হয়। নিজের সমস্ত দুর্বলতা, পিছুটান পুড়িয়ে দিতে দিতে, নিজের সংকোচের বিহ্বলতা ঘুচিয়ে দিতে দিতে।