দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৮৭)

পর্ব – ১৮৭

নেত্রী বললেন, আমি আমার সংগঠনের তরফে একটা কথা বলতে এসেছি, তুমি তার মাঝখানে এত বাধা দিচ্ছ কেন? তোমার সাহস তো কম নয়?
শ‍্যামলী বলল, ডোন্ট মেক এ ওয়েভ।
নেত্রী বললেন, তার মানে?
শ‍্যামলী হেসে বলল, এই কথাটাই আমেরিকার মেহনতী যুদ্ধবিরোধী জনগণ আমেরিকার মাটিতে দাঁড়িয়ে আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে আজকের দিনে বলেছিলেন। বেশি দিন নয়, বছর তের আগের কথা।
 নেত্রী বললেন, হতে পারে, আজ আমি সোভিয়েত বিপ্লবের কথা বলতে এসেছি। তুমি আমাকে বাধা দেবার কে?
শ‍্যামলী বলল, আরে কি মুশকিল, আমিই তো আপনাকে ওই প্রশ্নটা জিজ্ঞাসা করব ভাবছিলাম। আমরা রুটিন মাফিক অঙ্কের ক্লাস সবে শুরু করেছি, আর আপনাদের জন্য তা থেকে খামোখা বঞ্চিত হলাম। কী ব‍্যাপার বলুন তো?
নেত্রী বললেন, একটা বড় আদর্শের জন‍্য এটুকু স‍্যাক্রিফাইস একদিন নয় করলেই! আমার আসার একটু আগেও তো একদল এসেছিল। ক‌ই তাদেরকে তো তোমরা কিছু বলো নি!
শ‍্যামলী বলল, দিদি, তোমরা নয়, তুমি বলুন। আমিই নিজের দায়িত্বে কারো সাথে শলাপরামর্শ না করে বলছি। আগের ভদ্রলোককে যা বলেছি, তাতে তিনি আমাকে রাজনৈতিক ভাবে মোকাবিলা করবেন বলে শাসিয়ে গেছেন।
নেত্রী ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন। কী, এতবড় সাহস, কলেজের ক্লাসরুমে ঢুকে একটা ছাত্রীকে শাসিয়ে যাওয়া! চিন্তা কোরো না, আমরা একটা হেস্তনেস্ত করব। তুমি আমাদের ইউনিয়ন রুমে একবার এসো। সব কথা হবে।
শ‍্যামলী বলল, না না, আপনি বরং আমার জন্য চিন্তা করবেন না। ও আমি নিজেই সামলাতে পারব।
 নেত্রী বললেন, না না, ওদের এসব বদমাইশি উপেক্ষা করা যাবে না। তুমি কাল আমাদের প্রোগ্রামে থেকো। জেলা কমিটির সবার সাথে তোমার আলাপ করিয়ে দেব।
শ‍্যামলী হেসে বলল, না দিদি, আগামীকাল একজন বিপ্লবীর জন্মদিন পালন করব।
নেত্রী বললেন, কোন্ বিপ্লবীর জন্মদিন?
শ‍্যামলী বলল, ১৮৭৯ র সাত নভেম্বরে জন্মদিন সেই বিপ্লবী সংগঠকের। তাঁর নাম লিও ট্রটস্কি।
ট্রটস্কি ছিলেন বিশিষ্ট তাত্ত্বিক ও গুণী সংগঠক। তিনি “রেড আর্মি” প্রতিষ্ঠা করেন।
১৯১৭ সালে বিপ্লবে বদলে গেল রাশিয়া। জারতন্ত্রকে ছুঁড়ে ফেলে প্রতিষ্ঠা হল রাশিয়ান সোভিয়েত ফেডারেটিভ সোশিয়ালিস্ত রিপাবলিক। ভ্লাদিমির ইলিচ উলিয়ানভ ওরফে লেনিনের নেতৃত্বে গঠিত হল পিপলস্ কমিশারদের প্রথম কাউন্সিল।
লেনিন ছাড়া সেখানে র‌ইলেন লিও ট্রটস্কি, আর জোসেফ স্তালিন। বলা দরকার, এই ট্রটস্কি রেড আর্মি গঠন করেছিলেন।
বিপ্লব সংহত করতে ১৯১৯ সালের তেইশ মার্চ রাশিয়ান কমিউনিস্ট পার্টির অষ্টম কংগ্রেসে পাঁচ সদস্যের পলিটব্যুরো তৈরি হয়। পলিটব্যুরোয় র‌ইলেন লেনিন, ট্রটস্কি, স্তালিন, লেভ কামেনেভ, নিকোলাই ক্রেসতিনস্কি।
 ট্রটস্কি স্তালিনের আমলাতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বিরুদ্ধে কথা বলায় স্তালিনের কোপে পড়েন, ও পার্টির পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে বহিস্কৃত হন। নির্বাসিত হয়েও ট্রটস্কি স্তালিনের অমানবিক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে কথা বলতেন।
পরে লোক নিয়োগ করে স্তালিন এই বিশিষ্ট মার্ক্সবাদী ব‍্যক্তিত্বকে খুন করান। ১৯৪০ সালের ২০ আগস্ট ছিল তারিখটি।  মেক্সিকোয় খুনির কুড়ি বছরের কারাদণ্ড হয়। স্তালিন ওই খুনি ব‍্যক্তিকে “অর্ডার অফ লেনিন” সম্মানে ভূষিত করেন।
 ট্রটস্কির মতো তাত্ত্বিক দিক থেকে সমৃদ্ধ ও সাংগঠনিক দিক থেকে প্রতিভাশালী সর্বোচ্চ পর্যায়ের নেতৃত্বকে দূর করে দিয়ে স্তালিন উদগ্র ভাবে পার্টির সমস্ত ক্ষমতা ও রাশ নিজের অধিকারে নিয়ে নিলেন। শুরু হল একনায়কের লৌহকঠিন নিষ্পেষণ।
দুই বছর পরেই আরেক শীতের দিনে, ১৯২৯ সালের সতেরোই নভেম্বরে আরেক পলিটব্যুরো নেতা নিকোলাই বুখারিনকে পার্টি থেকে তাড়িয়ে দিলেন স্তালিন।
তার তিন বছর পর, ১৯৩২ সালে, শীতের গোড়ায়, অক্টোবরের নয় তারিখে স্তালিন দূর করে দিলেন দুজন শীর্ষস্তরের নেতা লেভ কামেনেভ আর গ্রিগরি জিনোভিয়েভকে। মনে রাখবেন, লেভ কামেনেভ ছিলেন ১৯১৯ এর মার্চ মাসে অষ্টম পার্টি কংগ্রেসে পলিটব্যুরো সদস্য।
 দিদি, সোভিয়েত একনায়কতন্ত্রের সাত সতেরো কাণ্ড কারখানা  এই নভেম্বর মাসে আর অক্টোবর মাসে অনেকখানি হয়েছিল।
নেত্রী বললেন, শ‍্যামলী, তোমার সম্বন্ধে আমাদের ধারণা ছিল, তুমি যথেষ্ট ভদ্র সভ‍্য মেয়ে। আজ টের পেলাম তোমার মতো অসভ‍্য মেয়ে খুব কম আছে। আমরাও তোমাকে রাজনৈতিক ভাবেই মোকাবিলা করব।
শ‍্যামলী বলল, করবেন ‘খন, তবে রাজনীতি বলে যদি আপনাদের মধ‍্যে কিছু অবশিষ্ট থাকে, তবেই না রাজনৈতিক মোকাবিলা করবেন? ন‌ইলে মারধরের ভাষা।
সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটি মেয়ে এসে শ‍্যামলীর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল।
খবর পেয়ে করবী মিত্র দৌড়ে এসে শ‍্যামলীকে উদ্ধার করলেন। প্রিন্সিপাল এলেন। বললেন, এই মেয়েটা গোলমাল পাকানোর একখানা! সব সময় ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে কথা কয়ে সব কিছুকে গুলিয়ে দেয়। তারপর তিনি বললেন, আজ তোদের ক্লাস সাসপেণ্ড করলাম।
প্রিন্সিপাল চলে যেতে খুব রোগা একটি সহপাঠিনী শ‍্যামলীর কাছে এসে বসল। অ্যাই শ‍্যামলী, শোন্, তোর বড্ড লেগেছে না রে!
শ‍্যামলী বলল, না রে, বেশি লাগে নি।
মেয়েটি বলল, না লাগে নি। আমি দূর থেকে দেখছি, আর ভয়ে ঠকঠক করে কাঁপছি। আসতে সাহস পাচ্ছি না, আমাকে অমন করে মারলে আমার হাড়গোড় সব চুরচুর হয়ে গুঁড়িয়ে যেত।
শ‍্যামলী হেসে বলল, আর মাংসগুলো কি হত?
রোগা মেয়েটি বলল, খুব মজা না? তোর কি সুন্দর ফিগার! যখন চলিস্, চলার ছন্দে ছন্দে তোর শাড়িতে কি চমৎকার ঢেউ খেলতে থাকে। ছেলেরা তো বটেই। আমরা মেয়েরাও না তাকিয়ে পারি না। এই শোন্ না, আমার কাছে বোরোলীন আছে, একটু লাগিয়ে দে না, এখানে ওখানে খামচে দিয়েছে!
 শ‍্যামলী সহজভাবে হেসে কথা বলছে দেখে ক্লাসের মেয়েরা একটি দুটি করে তার কাছে এসে জমল। রণিতা বলল, হ‍্যাঁ রে শ‍্যামলী, তুই যে বাঘ সিংহ দুটোকেই ক্ষেপিয়ে দিলি! এখন কি হবে বল্ তো।
শ‍্যামলী বলল, চারপেয়েরা দাঁত আর নখকেই শক্তির উৎস বলে জানে। মানুষ তাদের সঙ্গে লড়ে মগজ দিয়ে। শেষ পর্যন্ত মানুষ জেতে।
শোভনা বলল, শ‍্যামলী, তুই কি খাস্ রে, ওই দিদিটাকে কান্নিকিন, আমচিটকা তারপর ট্রটস্কি, বুখারিন, জিনোভিয়েভ, কামেনেভ, হাবিজাবি কত কি শুনিয়ে দিলি!
শ‍্যামলী বলল, বলা দরকার ছিল। ওরা ভাবে ওরাই সব জানে, আর ক্লাস চলার মধ‍্যে টিচারকে বের করে দিয়ে, এই অসভ‍্যতাটা আমার পক্ষে সহ‍্য করা শক্ত।
একটি মেয়ে বলল, তুই বকবক করতে গিয়ে লাভের লাভ যেটা হল, সেটা এই পরীক্ষার মুখে আমাদের ক্লাসগুলো বানচাল হয়ে গেল। আর ওরা যদি তোর কোনো ক্ষতি করে দেয়?
শ‍্যামলী বলল, দু বেলা মরার আগে মরব না ভাই মরব না।
আচ্ছা, যে ক্লাসটা হচ্ছিল, আমি যদি একটু দেখে দিই, তোরা দেখবি?
সবাই রাজি হয়ে গেল। নিজেরা নিজেরা ক্লাস করতে লাগল থার্ড ইয়ার ম‍্যাথস অনার্সের মেয়েরা।
পড়া শেষ হলে একটা মেয়ে বলল, তুই একা একা বাড়ি ফিরবি, তোর ভয় করছে না?
শ‍্যামলী বলল, তাহলে শোন্, এক যে ছিল রাজা। হেজিপেঁজি রাজা নয়, একেবারে দোর্দণ্ডপ্রতাপ রাজা। সেই রকম রাজা, যার হাঁকডাকে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খায়।  রাজার নাম ক্যানিউট।  রাজা ক্যানিউটকে ঘিরে থাকে স্তাবকের দল।  গিজ গিজ করছে পারিষদেরা, যো হুকুম বলে কান এঁটো করা হাসি বিলাচ্ছে মোসাহেবের দল।
ক্যানিউট নিজের স্তাবক, পারিষদ আর চাটুকারদের দেখে গর্বে ফুলে ওঠেন। তিনি একদিন সমুদ্রের তীরে গিয়ে সমুদ্রের ঢেউকে থেমে থাকতে বললেন। সমুদ্র শুনল না। পর মুহূর্তে আবার ঢেউ পাঠিয়ে দিল। রাজার ধমক চমক কোনো কিছুই সমুদ্রের ঢেউ কানে নেয় না। রাজা ক্রুদ্ধ হলেন, সমুদ্র পাত্তা দেয় না। রাজা ক্ষুব্ধ হলেন,  সমুদ্র কানে নেয় না। রাজা বিরক্ত হলেন, সমুদ্র ফিরে চায় না পর্যন্ত। অবিশ্রান্ত আছড়ে পড়তে থাকে তটে।  মানুষের শুদ্ধ চিন্তার মতোন।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।