ছোটগল্পে বর্ণালী রায় মিত্র

তনিমার চাকরি

তনিমার তখন সবে ঊনিশ পেরিয়েছে।
মাস দুয়েক হলো কলেজের দ্বিতীয় বর্ষে উন্নীত হয়েছে।
বুধবার শেষের দুটো ক্লাস থাকেনা |অন্যদিনের চাইতে একটু আগে বাড়ি ফিরেছে সেদিন |
দূর থেকে দেখতে পেল বারান্দায় দু’জন অচেনা ভদ্রলোক বসা। তনিমাকে ঢুকতে দেখে পরস্পরের দিকে চেয়ে মুখ নামিয়ে নিলেন তারা |
চটি খুলে ঘরে ঢুকলো তনিমা।
দেখলো মা শাড়ি বদলাচ্ছেন। মুখে বিষন্নতার কালি ঢেলে দিয়েছে যেন কেউ। তনিমাকে দেখে আঁচলে চোখ মুছে বসুধারা বললেন, “তোর বাবা আজ অফিসে অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। সেখান থেকেই সোজা হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বারান্দার দিকে ইশারা করে বললেন “তোর বাবার অফিস থেকে এসেছেন ওঁরা | আমি হাসপাতালে যাচ্ছি ওঁদের সাথে, তুই বাড়িতে থাক। ভাই স্কুল থেকে ফিরবে এক্ষুনি। ওকে যাহোক কিছু খেতে দিস। রন্টিকে এখনই এসব কিছু বলার দরকার নেই”।
অধীরবাবুর সহকর্মীদের সাথে বেরিয়ে গেলেন বসুধারা।
ঘটনার আকস্মিকতায় তনিমার মাথা কাজ করছিলো না।
স্নানঘরে গিয়ে জামাকাপড় বদলে চোখে মুখে জল দিয়ে ঘরে এসে শুয়ে পড়লো।
উৎকণ্ঠায় স্নায়ু টানটান হয়ে আছে | ক্লান্ত লাগলেও অন্যদিনের মতো ঘুম এলোনা চোখে | আকাশপাতাল ভাবতে লাগলো তনিমা |
চিকিৎসার বেশি সুযোগ দিলেন না অধীরবাবু | পরদিন ভোররাতে মারা গেলেন, বাড়ির একমাত্র রোজগেরে মানুষটি।
তনিমা জ্যেষ্ঠ সন্তান। সাত বছরের ছোটো ভাই রন্টি স্কুলে পড়ে।
আচমকা এমন দুর্ঘটনায় সর্বদিকে বিপর্যস্ত হয়ে পড়লো তাদের পরিবার।
তনিমার মা বসুধারা বেশি দূর লেখাপড়া করেননি, নিতান্তই ছাপোষা মহিলা।
এই আচমকা শোক একেবারে পাথর করে দিল তাকে।
নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার, জমানো পুঁজিও তেমন নেই।
তনিমার কলেজের পড়া মধ্যপথে | সে বুঝলো অবিলম্বে তার উপার্জনের বন্দোবস্ত প্রয়োজন, নাহলে ছোট ভাইটির লেখাপড়া, সংসার চালানো অসম্ভব হ’য়ে পড়বে।
অধীরবাবু ছিলেন এক বেসরকারি অফিসের সাধারণ কর্মী।
অনেক ধরা করা, হাঁটাহাঁটির পর তনিমা বুঝলো বাবার অফিসে এই মুহূর্তে কাজ পাবার কোনোই সম্ভাবনা নেই।
কলেজ যাওয়া স্থগিত রেখে নানান অফিসের দরজায় ঘুরতে থাকলো চাকরির আশায়।
এক রবিবার সংবাদপত্রের বিজ্ঞাপন দেখে একটি বেসরকারি সংস্থার ইন্টারভিউতে উপস্থিত হলো তনিমা দাম।
সেখানে পৌঁছে দেখলো জনা পঁচিশেক কেতাদুরস্ত পোশাক পরিহিত, যুবক যুবতী অপেক্ষারত।
কয়েকজনের সঙ্গে সামান্য আলাপ, বাক্যবিনিময় হলো।
প্রায় সকলেরই লম্বা ডিগ্রির সার্টিফিকেট রয়েছে সাথে।
তনিমা বুঝলো এখানে কাজ পাওয়ার আশা করা দুরাশারই নামান্তর।
যারা অপেক্ষমান তাদের পাশে সে নিতান্তই এলেবেলে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা করাটা নেহাতই নিরর্থক।
একবার ভাবলো তখনই উঠে চলে যায়, তারপর মন বলল এসে যখন পড়েছে, ভাগ্যের পরীক্ষা করে দেখাই যাক বরং।
যারা ইন্টারভিউ কক্ষ থেকে বেরিয়ে আসছিলো তাদের কারুর মুখেই তেমন প্রশান্তি বা আত্মবিশ্বাসের উজ্জ্বলতা লক্ষ করা যাচ্ছিলো না।
এ দেখে আরোই বিমর্ষ ও আশাহীন হয়ে পড়ছিলো তনিমা।
অবশেষে এলো তার ডাক।
দুরু দুরু বক্ষে, সুদৃশ্য মেহগনি কাঠের দরজা ঠেলে সে প্রবেশ করলো কর্তাব্যক্তির বিশাল সুসজ্জিত শীততাপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে।
কুন্ঠিত চিত্তে দাঁড়ালো বিশাল কাঁচের টেবিলের এক প্রান্তে।
অপর প্রান্তে বসে আছেন মিস্টার সরখেল, যাঁর হাতে আজ ভাগ্যের পরীক্ষা চলছে জীবন সমুদ্রে নোঙর বাঁধার অপেক্ষায় থাকা তরতাজা এক ঝাঁক তরুণ তরুণীর।
বসতে বলার ইঙ্গিতে তনিমা আসন গ্রহণ করলো। টেবিলের এপার থেকে হাতের ফাইল বাড়িয়ে দিলো বিনীত ভঙ্গিমায়। মিস্টার সরখেল ফাইল খুলে তনিমার অর্জিত বিদ্যার প্রমাণপত্র দেখতে লাগলেন।
মুখ তুলে বললেন, “আপনার তো কলেজের পড়াই সম্পূর্ণ হয়নি !”
তনিমা তাদের আকস্মিক পারিবারিক বিপর্যয় ও জরুরি পরিস্থিতির কথা জানাল। চাকরি পেলে রাতের কলেজে পড়া চালাবে, এ ইচ্ছের কথাও বললো |
কর্তাব্যক্তিটি সব শুনে নিস্পৃহ ভাব প্রকাশ করলেন। কোনও মন্তব্য করলেন না।
ইতিমধ্যে তনিমা দেখে নিয়েছে মিস্টার সরখেল নামের মানুষটির চেহারা অতীব কুরূপ, ভাবতে খারাপ লাগলেও এককথায় কদাকার বলা চলে। কিছুটা কিম্ভুতদর্শনও যেন। গরিলার মুখের আকৃতির সঙ্গে মিল পাওয়া যায় খানিক।
ফাইলের পাতা উল্টাতে উল্টাতে তনিমাকে গতানুগতিক কয়েকটি প্রশ্ন করলেন মিস্টার সরখেল।
প্রশ্ন পর্ব মিটলে টেবিলে মৃদুভাবে পেন ঠুকতে ঠুকতে বললেন, ঠিক আছে আজ তবে আসুন আপনি, ফলাফল যথাসময়ে ডাকযোগে জানানো হবে।
ম্লানমুখে হাত বাড়িয়ে ফাইল ফেরত নিলো তনিমা |
হঠাৎ এক অদ্ভুত কথা বলে বসল সে !
মিস্টার সরখেলের চোখে চোখ রেখে মৃদু হেসে বলল, স্যর, এই স্যুটটি পরে আপনাকে খুব ভালো দেখাচ্ছে, রঙটি বেশ মানিয়েছে আপনাকে।
এই কথায় মিস্টার সরখেল এতটাই বিস্মিত হলেন, কিছুক্ষণ নিশ্চল ভাবে চেয়ে রইলেন তনিমার মুখের দিকে, তারপর চকিতে একবার নিজেকে দেখে নিলেন বিপরীত দেওয়ালে লাগানো বিস্তৃত আয়নায়।
এ জাতীয় কথা জীবনে কোনওদিন শোনেননি তিনি!!
তিনি যে কতটা কুদর্শন তা নিজে বিলক্ষণ জানেন, স্ত্রী উঠতে বসতে যা যা বলেন, এক লহমায় মনে পড়ে গেল।
চেহারা নিয়ে ইতিবাচক কোনো কথা কারুর কাছ থেকে আজ অবধি তিনি শোনেননি, শোনার অভ্যেস নেই। কলেজের বন্ধুরাও চেহারা নিয়ে কম পিছনে লাগেনি |
এই কন্যা বলে কী!
সাতান্ন বছরের জীবনে এই প্রথম কর্ণকুহরে যেন এক অদ্ভুত বাক্য প্রবেশ করলো। তিনি নিজেকে ছুঁয়ে দেখলেন, স্বপ্ন নয়তো ?
কোনোমতে মুখ তুলে খানিক শুষ্ক হাসি হাসলেন। কাষ্ঠহাসি ঠোঁটে এনে উচ্চারণ করলেন, “থ্যাংক ইউ”!
মিস্টার সরখেলকে প্রতি-ধন্যবাদ জানিয়ে ফাইলপত্র নিয়ে, নমস্কার জানিয়ে ঘর থেকে বেরিয়ে এলো তনিমা।
একটিমাত্র পদের জন্যই এতজনের আবেদন, এক রাশ হতাশা বুকে নিয়ে বাড়ি ফেরা।
ফেরার পথে বাসের জানালার ধারে বসে তনিমা নিজের বিবেককে শুধাল, মানুষটি কুদর্শন হওয়া সত্ত্বেও সে কেন এমন কথা বলল ? কী ভেবে হঠাৎ বলে ফেললো “স্যার আপনাকে স্যুটটি পরে ভালো দেখাচ্ছে !” তবে কি চাকরির জন্য মরিয়া হয়েই এমন মিথ্যা স্তুতি করে বসলো তনিমা দাম ?
এক দ্বন্দ্ব ও অস্বস্তি ছেয়ে রইলো তনিমার মনকে। নিজের আচরণে নিজেকেই হঠাৎ করে অচেনা লাগছে তার।
বসুধারা বেশিরভাগ সময়ই বিষণ্ণ মনে শুয়ে থাকেন। রান্নাবান্না ঘরের কাজকর্ম করেন। মাঝে মাঝে খবর নেন মেয়ের চাকরির কিছু হলো কিনা।
অন্যসময় তনিমা বিশেষ ঘটনা বা অনুভূতি মায়ের সাথে আলোচনা করে। এখনকার দমচাপা পরিস্থিতিতে সেসব ইচ্ছেই করলোনা তার।
সপ্তাহখানেক পরের কথা…..
ব্যাঙ্কের কিছু কাজ সারতে গিয়েছিলো তনিমা। ফিরতেই দেখলো বাড়ির চিঠির বাক্সে একখানি লম্বা খাম উঁকি দিচ্ছে। ওপরে তারই নাম | পরম ঔৎসুক্যে খাম ছিঁড়ে চিঠিটি খুললো।
নিজের চোখকে প্রায় বিশ্বাস করতে পারল না সে …..মিস্টার সরখেলের অফিসের একমাত্র পদে নির্বাচিত হয়েছে মিস তনিমা দাম!
পরের মাসের পয়লা তারিখ থেকে তার জয়েনিং !
ঊনিশ বছরের তনিমা বসু বুঝতে শিখলো পৃথিবীতে খুব কম মানুষই আছেন, যারা নিজের প্রতি দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে পারেন, জয় করতে পারেন নিজ স্তুতির মোহ!
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।