জন্ম- ১৯৬৭, বরানগর।
বর্তমানে দার্জিলিং জেলার মিরিক মহকুমার উপশাসক ও উপসমাহর্তা পদে আসীন।
চাকরীসূত্রে ও দৈনন্দিন কাজের অভিজ্ঞতায় মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত মানুষের সমস্যা সমাধানে তাঁর লেখনী সোচ্চার।
হৃদয়ে মাছের গল্প
কথায় বলে মাছে ভাতে বাঙালি। মাছ বাঙালির প্রিয় খাদ্য। আর মাছও কত রকমের! তবে, আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ চাষের আগে পশ্চিম বাংলায় বেশিরভাগ মানুষ মাছ খেতে পেত না। মাছ জুটত দৈবাৎ। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখায় পড়েছি, বৃষ্টির অঝোর ধারায় ঘর ভেসে যাচ্ছে বলে নিম্নবিত্ত পরিবারটি বড়লোকের বাড়ির দালানে আশ্রয় নিতে চলল। তখন বাপের চোখে পড়ল একটি মাছ জলের মধ্যে পালাল। বাচ্চাটি মাছটি ধরে উঠতে পারে নি বলে বাপের কি তড়পানি। মানিকবাবুর পদ্মানদীর মাঝিতে মাছ আর মাছের দর, মেছোদের জীবন উঠে এসেছে।
পুব বাংলার খালে বিলে নদী নালায় মাছ ছিল যথেষ্ট।
দামোদর শেঠের আপ্যায়নের জন্যে মাছের খোঁজ করেন স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিন মোনী কলেবরটির জন্য হরেক আয়োজন। জলপাইগুড়ি থেকে জিয়োনো কই মাছ চাই, চাঁদনিতে বোয়ালের পেটি মিলবে কি না। ভেটকি মাছ কোথায় জোগাড় হবে!
পশ্চিমবাংলার নানা কোণে কোণে গিয়ে কত রকম মাছ খেয়েছি। বালুরঘাটে বিশ্বনাথ লাহা দাদার বাড়ি ভাত খেয়েছি কতবার। পাতে পড়ত রাইখর মাছ। দিনহাটায় অধ্যাপক হিতেন নাগ, প্রধান শিক্ষক বিশ্বনাথ দেব ও ফজলুর রহমানের বাড়িতে খেয়েছি। পাতে থাকত বোরোলি মাছ। গীতালদহে আমিনুর রাহমানের বাড়িতে রুপোর চকচকে টাকার মতো মাছ কুটছে বৌয়েরা। আমি একটা চেয়ারে বসে ওদের মাছ কোটা দেখছি। টাটকা মাছ পুকুর থেকে আমার সামনে জাল ফেলে ধরলেন ভেটাগুড়ির বিমান মণ্ডল। আর একবার কবি সোমা দাস সন্ধে বেলা টাটকা মাছ এনে স্টোভে ভেজে খাইয়ে গেল। মাছ নিয়ে প্রবাদেরও শেষ নেই। গভীর জলের মাছ, আর রাঘব বোয়ালেরা স্টিং অপারেশনে ঘুষ গ্রহণের অভিযোগে ধরা পড়লে রাজ্য রাজনীতি তুলকালাম হয়।
ঈশ্বরী পাটনীর নৌকায় চড়ে বসলেন অন্নপূর্ণা। ভবানন্দ মজুমদারের বাড়ি যাবেন। জলে পা ঝুলিয়ে নৌকায় বসেছেন দেবী। ঈশ্বরী বলেন ভাল হয়ে বৈস মাগো কুম্ভীরে যাবে লয়ে। ঈশ্বরী জানে জলের তলে মাৎস্যন্যায়। ছোটমাছকে গিলে খাবে বড় মাছ। বড়মাছকে পেটে পুরবে হাঙর কুমির। আরো বড় খেলোয়াড়ও জলের নিচে আছে। তারা তিমি তিমিঙ্গিল। চিটফান্ডে বাংলার গরিব খেটে খাওয়া মানুষের সর্বনাশ হয়ে গেল। সুদীপ্ত সেন আর দেবযানীর ঠকবাজি কারবারে কতশত মানুষ নিঃস্ব হয়ে গেল। ওদের জেল হল। কিন্তু মানুষের টাকা ফিরল না। তিমিঙ্গিলরা থাকে অনেক গভীরে। আইন তাদের টিকিটি ছুঁতে পারে না।
মাছের গল্প শেষ হয় না। শরৎচন্দ্রের পল্লীসমাজ উপন্যাসে শরিকি পুকুরের মাছের ভাগ থেকে রমেশ ঘোষালকে বঞ্চিত করে বেণী ঘোষাল। আর পরে চাষিদের খেত জলে ডুবে যাওয়া থেকে বাঁচাতে বাঁধ কাটিয়ে দেয় রমেশ। আকবর লাঠিয়ালদের বাপ ব্যাটাকে ঠেকাতে নিজের হাতে লাঠি ধরে রমেশ। আকবর লাঠিয়াল ভাবে, মায়ের দুধ খেয়েছিল বটে ছোটবাবু!
মাথা পিছু মাছ বেশি খায় জাপানের লোকে। ইংল্যাণ্ডের লোকেও মাছ খায়। মাছে যে ধরনের ওমেগা ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে, তা হৃদযন্ত্রের জন্যে ভাল। বিদেশি মাছের নাম জানি অনেক। কড, হ্যালিবাট, টুনা। আর সেই যে জেলে, যে মাছ ধরার স্বপ্ন দেখতে দেখতে সত্যিই একটা বড় মাছ পেয়ে গেল, সেই পর পর দু বছর পুলিৎজার আর নোবেলজয়ী উপন্যাসে সেই জেলের ধরা মাছের নাম ছিল মার্লিন মাছ।
১৯৫২ সালের পহেলা সেপ্টেম্বর আর্নেস্ট হেমিংওয়ের কলমে বেরোলো উপন্যাস দি ওল্ডম্যান অ্যাণ্ড দি সী। ১৯৫৩ সালে সে বই পেল পুলিৎজার, আর ১৯৫৪ সালে পেল নোবেল পুরস্কার।
মাছ নিয়ে আমাদের পুরাণ উপপুরাণেও গল্পের ছড়াছড়ি। ভগবান বিষ্ণু মৎস্যরূপ ধারণ করে বসুমাতাকে রক্ষা করেছিলেন। কেশবধৃত মীনশরীর জয় জগদীশ হরে। গোরখনাথের সূত্রে মীনেন্দ্রনাথের কথাও পড়েছি। মীন হয়ে নির্জনে তিনি সাধনা করেছিলেন। মৎস্যরাজের মেয়ে সত্যবতী। নৌকা বায় ভাল। তাকে দেখে পরাশর মুনির ভাল লাগল খুব। মুনির কামতৃপ্তি করে মৎস্যগন্ধা সত্যবতী হয়ে উঠলেন যোজনগন্ধা। সত্যবতী মহাভারতীয় নারী। আর দেবদেবীরা কারো উপর কুপিত হলে পোড়া মাছটা পর্যন্ত জলে পালাত। শ্রীবৎস আর চিন্তার কথা মনে পড়ে। গন্ধর্বরাজ চিত্ররথের পুত্র শ্রীবৎস আর চিত্রসেনের কন্যা চিন্তা। লক্ষ্মী আর শনির রেষারেষির মধ্যে পড়ে তাদের কত যন্ত্রণা পেতে হয়েছিল। শনির চক্রান্তে পোড়া মাছের প্রাণ ফিরে পেয়ে পালানোর গল্প আমি ভুলতে পারি নি। আবার চণ্ডী মেছুনি সেজে কন্যা তুমি হও গহীন গাঙ টাইপের কাপড় চোপড় পরে মাছ ধরতেন। তাঁকে পরস্ত্রী ভেবে শিবের রেতঃপাত হয়ে যেত। সেই স্খলিতবীর্য থেকে কিয়াপাতে জন্ম নিল কেতুকাসুন্দরী। মনসার একটা চোখ খুঁচিয়ে কানা করে দিলেন চণ্ডী। মনসাকে সাধু চন্দ্রধর গালি দেবেন চ্যাং মুড়ি কানী বলে। বলবেন না কেন, তিনি তো ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় পড়েন নি, কাণাকে কাণা বলিও না। সেকালে কানা লিখতে কাণা লিখত। সোনা লিখতে সোণা।
বালক ঈশ্বরচন্দ্রের বাবা ঠাকুরদাস কলকাতায় থাকতেন। ছেলেদের জন্য বাটা মাছ আনতেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসও মাছের কথা বলেন। চিল মাছ নিয়ে উড়ছিল। পিছনে খ্যা খ্যা করে তাড়া করে কাকের দল। শেষে চিল ওই মাছ ছেড়ে দিলে শান্তি মিলল। উপাধি বর্জনের কথা বলেন ঠাকুর। আর বলেন মেছুনির কথাও। মাছ বেচে ফিরতে তার দেরি হয়ে গেল। বাবুরা অনুমতি দিলেন, বাগান বাড়িতে রাতটুকু শুতে। বাগানবাড়ি মানে বাগান বাড়ি। ফুলের গন্ধে মেছুনির ঘুম আসে না। মহা মুশকিল। না ঘুমোলে কালকে খাটবে খুটবে কি করে? শেষে আঁশ চুপড়িতে জলের একটু একটু ছিটে দিতে মেছো গন্ধ বেরোলো। তখন মেছুনির ঘুম এল। স্বভাব ও অভ্যাসের কথা বলেন ঠাকুর।
দেবেন ঠাকুরের ছোটছেলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নাকি মিলিয়ে মিলিয়ে লিখতে জানে। মাস্টার রবির ছন্দজ্ঞান যাচাই করবেন। বললেন,
রবিকরে জ্বালাতন আছিল সবাই
বরষা ভরসা দিল আর ভয় নাই।
লেখ্ তো বাবা এর পরের দুই পংক্তি। নিমেষে ভাবী মহাকবি বললেন,
মীনগণ হীন হয়ে ছিল সরোবরে,
এখন তাহারা সুখে জলক্রীড়া করে।
মীন মানে মাছ। মাছ যে ধরে সে মেছো। জীবনানন্দ দাশ বলবেন,
মেছোদের মতো আমি কতো নদী ঘাটে
ঘুরিয়াছি;
পুকুরের পানা শ্যালা—আঁশ্টে গায়ের ঘ্রাণ গায়ে
গিয়েছে জড়ায়ে;
–এই সব স্বাদ;
—এ-সব পেয়েছি আমি, ….
মাছের কথায় বৈষ্ণব ঠাকুরদের কথাও আসে। বলত মাগুর মাছের ঝোল, যুবতী নারীর কোল। মাগুর মাছের ঝোল হত ট্যালটেলে। ভক্ত বৈষ্ণব কৃষ্ণপ্রেমে মাতোয়ারা। তাঁর চোখে ভাবাশ্রু। ওই হল মাগুর মাছের ঝোল। আর ভাবে বিহ্বল হয়ে তিনি ধরার ধূলিতে গড়াগড়ি দেন। পৃথিবী কিনা চিরযৌবনা চিরায়ুষ্মতী তন্বী। বৈষ্ণব সাধুর ওই ধূলায় গড়াগড়ি হল যুবতী মেয়ের কোল।
মাছের নামে অজস্র জায়গা কলকাতায়। ট্যাংরা, তপসিয়া, কৈখালি। দিনহাটায় আমার অসমসাহসী মুসলিম আমিনবাবুটি তার বাইকে করে আমায় নিয়ে যেত পুঁটিমারি, মাগুরমারি। বালুরঘাটে যেতাম বোয়ালদাড়। এছাড়া বোয়ালিয়া, মাগুরা, স্থান নামে মাছের কথা অনেক।
বর্ষাকালে মা মাছ গর্ভবতী হবেন। নতুন নতুন মাছের সম্ভাবনা। এই সময় মাছ খাওয়া থেকে বিরত থাকুন। বর্ষায় জেলেরা মাছধরা বন্ধ রাখুন। তাহলে সম্বৎসর মাছ জুটবে।