দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৮৫)

পর্ব – ১৮৫

অনসূয়ার বাড়ি থেকে নামতে নামতেই শ‍্যামলী দেখল গেটে গোবিন্দ দাঁড়িয়ে আছে। বলল, চলো, তোমাকে কলেজে পৌঁছে দেবার হুকুম আছে। শ‍্যামলী বলল, সে কি, কেন, আমি বাসে করে চলে যাব। বলেই সে দেখতে পেল জানালা দিয়ে অনসূয়া দেখছেন। তিনি বললেন, ক্লাস শেষ হলে সোজা এখানে চলে আসবি। সন্ধেবেলা তোর বাড়ি থেকে দুজনে মিলে মালপত্র আনতে যাব।
 গোবিন্দচন্দ্র গাড়ির পিছনের গেট খুলে দাঁড়িয়ে আছে। শ‍্যামলী বলল, আমি সামনে তোমার পাশে বসি না কেন! গোবিন্দ বলল, তোমার বিয়ে হোক। তোমার বর নিজের গাড়ি নিজে চালাবে, তখন বোসো। এখন পিছনে।
কলেজের গেটের সামনে গাড়ি তাকে পৌঁছে দিল। গোবিন্দ বলল, ম‍্যাডাম বলে দিয়েছেন, তোমার ক্লাস হলে তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে।
শ‍্যামলী আপত্তি জানাল। বলল, না না, দরকার নেই। তাছাড়া আমি বাড়ি যাব। বাড়িতে অনেক কাজ পড়ে আছে।
গোবিন্দ বলল, এখন তুমি বড় হয়ে গেছ, কিন্তু, তুমি তো জান, ছোটবেলায় আমার কোলে করেই তুমি ঘুরতে। তোমাদের বাড়িতে নিচের দিকে কোণের ঘরটায় আমি আর গ‍্যারাজের আরেকটা ছেলে থাকত। আর ম‍্যাডামের কথা না শুনলে তিনি খুব রেগে যান। তুমি কলেজেই থেকো। আমি ওঁকে কোর্টে পৌঁছে দিয়ে, তারপর তোমাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাব।
শ‍্যামলী বলল, এক কথা কতবার বলব গোবিন্দ কাকা? বলছি না, বাড়িতে আমার কাজ আছে?
গোবিন্দ বলল, ঠিক আছে, ম‍্যাডামকে বলব, তারপর দরকার হলে তোমাকে নিজের বাড়িতেই আমি পৌঁছে দিয়ে আসব। কিন্তু তুমি যেন আমাকে বিপদে ফেলো না।
মুখ গোঁজ করে শ‍্যামলী কলেজে ঢুকে গেল।
ক্লাসে যেতেই তাকে নিয়ে হ‌ই চ‌ই শুরু হয়ে গেল। ক্লাসের একটি মেয়ে রমানাথ বাবুদের প্রতিবেশিনী। সে বুঝি কেমন করে জানতে পেরেছে শ‍্যামলী পর পর দুদিন রমানাথদের বাড়িতে গিয়েছিল। শুধুমাত্র নিমন্ত্রিত হয়ে ওদের বাড়িতে যাওয়াটুকুই নয়, শ‍্যামলী যে রমানাথের বাবার শ্রাদ্ধের দিনেই গড়িয়ে যাওয়া সন্ধ্যায় অনেকক্ষণ  তার সাথে একান্তে ছাতে সময় কাটিয়েছে, আর পরদিন আবার সন্ধ্যায় গিয়ে তাকে পায়স করে খাইয়েছে, মেয়ে মহলে সে সব খুঁটিনাটি কথাও পল্লবিত হয়ে রটে গিয়েছে। মেয়েরা এর সহজ সরল অর্থও করে নিয়েছে।
শ‍্যামলীর কাছে মেয়েরা জানতে চাইল, কবে চার হাত এক হচ্ছে। আর কালাশৌচের জন‍্য অপেক্ষা করতে শ‍্যামলীর কষ্ট হচ্ছে কি না। ওদের প্রশ্নগুলো সব‌ই আমিষ ধাঁচের।  ওদের কৌতূহল দেখে শ‍্যামলী বড় অস্বস্তিতে পড়ল। সে বলার চেষ্টা করল, তোমরা যা ভাবছ, সে সব কিছুই নয়। আমার সঙ্গে তোমাদের যেমন বন্ধুত্ব, রমানাথের সঙ্গেও। মেয়েরা কৌতুক করে বলল, তাই বুঝি তুই ওঁকে নাম ধরে ডাকিস, আর গলা জড়িয়ে চুমু খাস্?
শ‍্যামলী বিরক্ত হয়ে বলল, কে তোমাদের এসব বলেছেন জানি না। তবে যাঁর মুখ থেকে খবর পেয়েছ, তাঁর কাছেই বাকি প্রশ্নগুলোও কোরো। আমার এ নিয়ে কিছু বলার নেই।
মেয়েরা সিনেমা থিয়েটারে প্রেম দেখতে ভালবাসে। আর বাস্তবে প্রেম আর দেহকামনা তাদের কাছে এক। শ‍্যামলীর একবার মনে হল, ছেলেরাও এই রকম। বাড়িতে গোলমাল বাধিয়ে লুকিয়ে চুরিয়ে দেখা করে, রহস‍্যপূর্ণ চাউনি ছুঁড়ে, তাড়া তাড়া প্রেমপত্র লিখে মধ‍্যবিত্ত বাঙালি যে প্রেমে অভ‍্যস্ত, তা এক অমূলতরু। সংসারের দৈনন্দিন ঘাতপ্রতিঘাত সহ‍্য করার ক্ষমতা তার কম। অজয় করের সপ্তপদী ফিল্মের ট্রিটমেন্টটা মনে পড়ল তার। রীণা ব্রাউন যখন কৃষ্ণেন্দুর উদ্দেশে বলেছিল ও যেন আমায় টাচ্ না করে,  আর “টাচ্” কথাটা অমন অ্যাকসেণ্টে উচ্চারণ করে,  তখন নিজেকে সে খাঁটি সাহেব বলেই জানত। তারপর যেদিন নিজের জন্মরহস‍্য জানতে পারল, তখন কতখানি অসহায় বোধ করল। জন্মের কারণে মানুষে মানুষে তফাত করা চলবে না, এটা ভারতীয় সংবিধানে বড় করে বলা হলেও ভারতীয় মনে এ জিনিসটা স্থান পায় নি। জন্ম হোক যথাতথা, কর্ম হোক ভাল, এটা কবিতায় বলা আছে, কিন্তু মানুষ এটা বিশ্বাস করে নি। কৃষ্ণেন্দুর বাবা যখন রীণা ব্রাউনের কাছে ছেলেকে ভিক্ষা চাইলেন, তখন রীণার উচিত ছিল বুড়োটাকে স্পষ্টভাবে বলা, মশাই আপনার ছেলের প্রতি আমি বিশ্বস্ত, কিন্তু আপনার প্রতি আমার কোনো দায়বদ্ধতা নেই। আপনি আসতে পারেন। এই বলে বুড়োটাকে দরজা দেখিয়ে দেওয়া উচিত ছিল রীণার। কিন্তু তাকে হঠাৎ ভারতীয় মূল‍্যবোধ পেয়ে বসল, আর নিজের জন্মের কারণেই নিজেকে হীন ভাবা শুরু হয়ে গিয়েছিল তার মধ‍্যে। জন্ম কখনোই চূড়ান্ত পরিচয় নয়। জন্ম একটা ঘটনা। আর জীবন হল সাধনা। তাকে ঘিরে কৃষ্ণেন্দু যে ভালবাসার নন্দনকানন রচনা করেছে, তাকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে রক্ষা করা উচিত ছিল তার। তাই রীণা ব্রাউনের প্রেম বাইকের উপর থেকে গেল। কোনো ঠিকানায় পৌঁছে যেতে পেল না। তার পথ শেষ হল না। সার্থকতা পেল না।
বাঙালি প্রেমের কি জানে? তথাকথিত প্রেমের সম্পর্ক আসলে বিয়ের আগে অবৈধভাবে দেহসম্পর্ক গড়ার উদগ্রতা। দেহসম্পর্ক তো খারাপ নয়। দেহ ছাড়া মানুষের অস্তিত্ব কোথায়? কিন্তু দেহ এত গুরুত্বপূর্ণ বলেই তার মর্যাদাও সব চাইতে বেশি। শ‍্যামলী মুহূর্তে যখন এইসব ভাবছিল, তখনই একটা মেয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল, বিয়ের আগেই গলা জড়িয়ে চুমু খাচ্ছিস্, ছাতের অন্ধকারে লুকিয়ে লুকিয়ে আর কি কি করেছিস, সে তো আর আমরা দেখতে যাই নি। তবে তোকে সত‍্যবাদী, স্পষ্টবক্তা বলে জানতাম, সে ধারণা আজ থেকে ভেঙে গেল।
শ‍্যামলী বলল, আমরা প্রতিটা মানুষ আলাদা আলাদা। আমার ব‍্যক্তিগত জীবন নিয়ে তুমি খামচা খামচা ভাবে কিছু তথ‍্য যোগাড় করে মনগড়া একটা সিদ্ধান্ত নিতেই পার। তার দায় সম্পূর্ণ ভাবেই তোমার। আমি সত‍্যবাদী কি না,  সে নিয়ে তোমার সামনে অগ্নিপরীক্ষা দেবার কোনো ইচ্ছা আমার নেই। এ ব‍্যাপারে একটিও জবাব না দেবার অধিকার আমার আছে।
 মেয়েরা শ‍্যামলীর আচরণে রীতিমতো বিরক্ত হল এবং খুব রাগ করল। বলল, তাহলে তো তোর সাথে বন্ধুত্ব রাখার কোনো মানেই হয় না।
মুহূর্তে শ‍্যামলী ফুঁসে উঠল। বন্ধুত্ব? দয়া করে ওই মহান শব্দটা উচ্চারণ কোরো না। তোমাদের ওটা সাজে না। তোমাদের জ্ঞান বুদ্ধি বিবেচনার অনেক ওপর দিয়ে যায় বন্ধুত্বের কনসেপ্ট। আমরা খুব বেশি হলে পরিচিত। এই কলেজেরই একটা মেয়ে গুরশরণ কৌর, ফিলজফির, সে কেমন আছে, কী করছে, জানো তোমরা? তোমরা দয়া করে বন্ধুত্ব কথাটা উচ্চারণ করা বন্ধ করো। তোমাদের ওটা মানায় না।
মেয়েরা রাগ করল। বেঞ্চে ওর পাশে যারা বসত, সবাই সরে গিয়ে অন‍্য বেঞ্চে চলে গেল।
শ‍্যামলী ভাবল, এই বিচ্ছিন্নতা অনেক ভাল।
সুখের কথা বোলো না আর, বুঝেছি সুখ কেবল ফাঁকি।
 দুঃখ আমার প্রাণের সখা, সুখ দিয়ে যা’ন চোখের দেখা,
দু’দণ্ডের হাসি হেসে মৌখিক ভদ্রতা রাখি।
দয়া করে মোর ঘরে সুখ পায়ের ধূলা ঝাড়েন যবে,
চোখের বারি চেপে রেখে সুখের হাসি হাসতে হবে;
কী আশ্চর্য, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়‌ও কি এমন উৎকট সমস্যার মধ‍্য দিয়ে চলেছিলেন?
করবী মিত্র এসে রাশিবিজ্ঞানের ক্লাস শুরু করলেন। তাঁর বিষয় হল, র‍্যানডম স‍্যাম্পল এসটিমেটস অফ এ পপুলেশন ক‍্যারেকটারিসটিক অর প‍্যারামিটার।
ক্লাস করতে করতে করবী বললেন, তোরা কেউ বলতে পারিস, সল্ট এস্টিমেট জিনিসটা কি?
ক্লাসের সবার মুখ শুকনো। কেউ কোনোদিন এই শব্দটা শোনে নি। করবী শ‍্যামলীকে জিজ্ঞাসা করলেন, কি রে তুইও পারবি না?
শ‍্যামলী বলল, ম‍্যাম, সবাই আপনার থেকে শুনতে ইনটারেসটেড। আমি কি জানি না জানি, সেটা সবার ভাল লাগার কথা নয়।
করবী বললেন, বাজে না বকে সল্ট এস্টিমেট কি জিনিস, সেটা বলো।
শ‍্যামলী বলতে শুরু করার আগেই তিন চারটি মেয়ে উঠে চলে গেল। আর কয়েকটি মেয়ে সম স্বরে বলল, এই চ‍্যাপটারে মোটে কুড়ি নম্বর আছে। এ নিয়ে পরীক্ষার আগে এত সময় নষ্ট করা কেন?
করবী বললেন, আমার ক্লাস করা যাদের কাছে সময় নষ্ট মনে হচ্ছে, তারা চলে যেতে পারো। পড়াশুনাটা ভালবাসার ব‍্যাপার। ধরে বেঁধে গিলিয়ে দিয়ে গণিতের ক্লাস হয় বলে আমি মনে করি না।
করবী মিত্রের কথা শুনে আরো বেশ  কতকগুলি মেয়ে উঠে গেল। তারপরেও যারা বসে র‌ইল, চোখের ভাষা খেয়াল করলে বোঝা যেত, তারা নেহাতই চক্ষু লজ্জার দায়ে বসে আছে।
শিক্ষক বললেন,  শ‍্যামলী, নাউ স্টার্ট টু এক্সপ্লেইন হ্বোয়াট ইজ় সল্ট এস্টিমেট।
শ‍্যামলী বলতে শুরু করল, হোয়েন ইন্ডিয়া ওয়জ় গোয়িং টু বি গিফটেড স্বতন্ত্রতা ফ্রম দ‍্য ব্রিটিশ রুলারস…….
অমনি কয়েকটি মেয়ে বলল, ম‍্যাম, উই আর্নড আওয়ার ফ্রীডম বাই ব্লাড শেড অ্যাণ্ড টিয়ার্স। উই ভেহিমেন্টলি অবজেক্ট হার কালারেবল চয়েস অফ দ‍্য পারটিকুলার ওয়র্ড গিফ্ট। দিস লেডি হ‍্যাজ় নো রাইট টু আন্ডারমাইন দ‍্য স‍্যাক্রিফাইস অফ দ‍্য রেভোলিউশনারিজ লাইক ক্ষুদিরাম।
করবী বললেন আচ্ছা আচ্ছা, শ‍্যামলী আসল জায়গাটা বল্
শ‍্যামলী বলল, আজ ইন্দিরা হত‍্যার প্রেক্ষিতে গোটা দেশের শিখ জনতা যেভাবে এক অংশের রাজনৈতিক গুণ্ডামির শিকার হয়ে পড়েছে ঠিক সেই ভাবে….. ..
অমনি কয়েকটি মেয়ে বলে উঠল, ম‍্যাম কলেজের পড়ার ক্লাসে মেঠো রাজনীতির কথা টেনে আনা ঠিক হচ্ছে না।
করবী বললেন, শ‍্যামলী আসলটুকু বল্।
শ‍্যামলী বলল, ভারত পাকিস্তান ভাগাভাগির সময়ে কোনো বাস্তবিক কারণে একটি ধর্মসম্প্রদায়ের মানুষের মনে আক্রান্ত হওয়ার আতঙ্ক সৃষ্টি হয়। প্রাণে বাঁচার জন্য তারা লাল কেল্লায় রিফিউজি হিসেবে আশ্রয় নেয়। এই সময় ভারত সরকার কেল্লায় আশ্রয় নেওয়া রিফিউজিদের খাবার চাল ডাল নুন সরবরাহ করার দায়িত্ব স্বীকার করে।
কিন্তু সরকারের মনে হয়েছিল চাল ডাল সরবরাহের নামে কনট্রাকটরটা ভুয়ো হিসাব দাখিল করে সরকারি টাকা লুঠ করছেন। এটাকে আটকাতে তাঁরা বদ্ধপরিকর ছিলেন। অথচ কেল্লায় থাকা উদ্বাস্তুরা প্রাণের ভয়ে বাইরে থেকে কাউকে ঢুকতে দিচ্ছিল না। ফলে মাথাগুনতির সুযোগ ছিল না। তখন জ‌ওহরলাল নেহরু বরানগরের আইএস‌আই এর প্রতিষ্ঠাতা প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশকে অনুরোধ করেন যে গণিতের তত্ত্ব খাটিয়ে কার্যোদ্ধার করে দেবার। নেহরুর আহ্বানে সাড়া দিয়ে মহলানবীশ দুজন রিসার্চ ফেলো জে এম সেনগুপ্ত ও ডি বি লাহিড়ীকে লালকেল্লায় পাঠান। উদ্বাস্তু রা তাঁদের পর্যন্ত ঢুকতে দিতে চান নি। তখন সেনগুপ্ত আর লাহিড়ী, এই দুই রিসার্চ ফেলো চাল ডাল আর লবণের মধ‍্যে, যেহেতু লবণের দাম ও লবণের মাথাপিছু ব‍্যবহার অতি সামান‍্য বিবেচনা করে মনে করলেন যে, লবণ দিয়ে কেল্লায় থাকা উদ্বাস্তুদের সংখ‍্যা অনুমান করা ভাল হবে। তাঁরা সেটা করলেন। এবং পরে জানা গিয়েছিল যে তাঁদের অনুমান সত‍্যের যথেষ্ট কাছাকাছি ছিল। সেনগুপ্ত আর লাহিড়ীর  এই যে পদ্ধতি, একেই সল্ট এস্টিমেট বলে।  এর ফলে স‍্যাম্পল এস্টিমেটের গুরুত্ব ভারতীয় প্রশাসনের কাছে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
করবী বললেন, ব্র‍্যাভো। এর পর‌ই ঘণ্টা পড়ে গেল।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।