দৈনিক ধারাবাহিক উপন্যাসে মৃদুল শ্রীমানী (পর্ব – ১৮৩)

পর্ব – ১৮৩

শ‍্যামলী বলল, বাবা আমার বিয়ে দিতে পারলে বেঁচে যান। অথচ, আমি স্কলারশিপের টাকায় পড়াশোনা করি। দুপুরের খাবার খেতে পাই ছেলেদের কলেজে।
অনসূয়া বললেন কেন, ছেলেদের কলেজে খাস্ কেন?
শ‍্যামলী বলল, লাইব্রেরিতে অনেকটা সময় থাকি যে। ওখানে নিয়মিত ব‌ই পড়লে নিরামিষ সবজি ভাতের ফুডকুপন পাওয়া যায়। আমি তাই খাই। আর বাবার কারখানা সামলে দিই। তবুও বাবা মায়ের চোখে আমি একটা বোঝা। আমি জানি, এখনই অ্যাপ্লাই করে দিলে আমি একটা সরকারি অফিসে কেরানির কাজ জুটিয়ে ফেলতে পারব। ওপরের দিকে নাম থাকবে আমার। কিন্তু আমার পড়ার ইচ্ছে। আর সেটা নিয়েই যত সমস্যা।
 শ‍্যামলীর দিকে তাকান অনসূয়া।
শ‍্যামলী বলে, প্রতিদ্বন্দ্বী নামে একটা ফিল্ম করেছিলেন সত‍্যজিৎ রায়। একদিন দিয়েছিল টিভিতে। দাদা এসে টিভি নিভিয়ে দিয়েছিল। বলেছিল, যত ফালতু গল্প। আগে লোকের বাড়ি টিভি দেখতে যাওয়া যেত। আমি একজনদের বাড়িতে গিয়ে দেখেছিলাম সিস্টার। এখন আর কারো বাড়ি গিয়ে টিভি দেখতে চাইলে লোকেরা অবাক হবে। আমি ফিল্মটা নিয়ে বেশ কয়েকটা আলোচনা পড়েছি।
অনসূয়া বললেন, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প প্রতিদ্বন্দ্বী নিয়ে ফিল্মটা। ইংরেজি নাম ছিল দি অ্যাডভারসারি। মূল চরিত্রের নাম সিদ্ধার্থ। অভিনয় করেছেন ধৃতিমান চ‍্যাটার্জি। জানিস্ তো, প্রতিদ্বন্দ্বী ওর একেবারেই প্রথম দিকের ছবি।
শ‍্যামলী বলল, একটা ফিল্ম আসলে ডিরেকটরের। কুমোরটুলির কুমোররা মাটি দিয়ে একরকম প্রতিমা বানায়। লোকজন হাঁ করে তাকায়। আর সেই মাটি অগুস্ত রেনে রদ‍্যাঁ বা আমাদের রামকিঙ্কর বেইজ পেলে অন্য রকম। ওঁরা শিল্পী। জাতশিল্পী। কুমোরটুলির লোকেরা কারিগর।
অনসূয়া বললেন, না রে, সত‍্যজিৎ রায় নিজে নিজেই ধৃতিমানের প্রচুর প্রশংসা করেছেন। বলেছেন ধৃতিমান একজন রিয়েল স্টার।
আচ্ছা, জানিস্ তো, ধৃতিমান ওর আসল নাম নয়। ওর নাম হল সুন্দর চ‍্যাটার্জি। ওর কেরিয়ার দেখে তো আমি অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। স্কুলিং হয়েছে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজিয়েট স্কুলে। তারপর প্রেসিডেন্সী কলেজ। তারপর দিল্লি স্কুল অফ ইকনমিকস। দারুণ না? অতো বুদ্ধিদীপ্ত বলেই মৃণাল সেন আকালের সন্ধানে আর পদাতিক এ কাজ করিয়েছেন। অপর্ণা সেন ওঁকে নিয়েছেন থার্টি সিক্স চৌরঙ্গী লেন এ।
 শ‍্যামলী বলল, তবুও আমি বলব সিনেমা শেষ পর্যন্ত ডিরেকটরের জিনিস। ক‍্যামেরার কায়দা, আর এডিটিং ডাবিং দিয়ে তিনি অসাধ‍্য সাধন করতে পারেন।
অনসূয়া বললেন, তা ঠিক, সপ্তপদীতে উত্তম সুচিত্রা গোটা বাংলা মাতিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু ওই কলেজ সোশ্যালে ওথেলো ডেসডিমোনা নিয়ে টুকরো অভিনয়ে উৎপল দত্ত আর জেনিফার কাপুরের ইংরেজি না হলে কি হত?
শ‍্যামলী বলল, তারাশঙ্কর বন্দ‍্যোপাধ‍্যায়ের গল্পটা অনবদ‍্য। ওই গল্পের জোরে বহুদূর যাওয়া যায়। অবশ‍্য অজয় কর যথেষ্ট ভাল পরিচালনা করেছেন।
 শ‍্যামলী আরো বলল, দিদি, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের একটা ভাল গল্প সত‍্যজিৎ রায় শুধু বলে যান নি। সিনেমা করে তুলেছেন। অনেক ট্রিটমেন্ট আছে। তার উপর গল্প বাছাইটাও একটা ভাল ব‍্যাপার। সিনেমা বলতে গিয়ে যারা “ব‌ই” বলে, তারা হয়তো নিতে পারবে না। দু ঘণ্টাও পুরো নয়, একশো দশ মিনিটের ফিল্ম। সত্তর দশকের পুরো যন্ত্রণা, দোটানা, অগভীরতা, লাচারি, মুখোশ পরা বাঙালি সমাজটাকে দেখিয়েছেন।
অনসূয়া বললেন, আমার আশ্চর্য লাগে,  ওর বোনটা সুতপা চাকরি করতে চায় নি। ওর বাড়ি থেকে জোর করে চাকরি করতে পাঠানো হল। সে সকলের সংসার চালাতে টাকাটাও দিচ্ছে। অথচ তার মনুষ্যত্ব, জ্ঞান বিবেক রুচির উপরে পরিবারের সদস্যদের আস্থা নেই। দেখবি, এই দ‍্যাখ্, বলে লাইব্রেরি ঘরের আলমারি হাঁটকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ব‌ইটা বের করে আনেন অনসূয়া। পড়েন, “চাকরি নেবার সময় সে কেঁদে ভাসিয়েছিল। কিছুতেই নিতে চায়নি। কিন্তু এক কথায় সাড়ে তিনশো টাকার একটা চাকরি—ওইটুকু তো মেয়ে, সুতপা তখন বি.এ. পড়ত, কলেজ ছেড়ে চাকরি করার একটুও ইচ্ছে ছিল না তার। তবু, সাড়ে তিনশো টাকার লোভনীয় প্রস্তাব—তখন মা, ছোটোকাকা সবাই মিলে ওকে বুঝিয়েছিল, সংসার তখন প্রায় অচল, বাবার ইনশিয়োরেন্সের টাকা শেষ হয়ে গেছে, শেয়ারগুলো সব নষ্ট হয়ে গেল, শুধু ওই রয়ালটির সামান্য একশো কুড়ি টাকা মাসে—সিদ্ধার্থর সেবার বি.এস.-সি. ফাইনাল ইয়ার।”
শ‍্যামলী বলল হুম।
অনসূয়া বললেন, এ ঠিক তোর কোভারচার। তুমি মেয়ে। তোমার সতীত্ব বাড়ির লোকজন চাবিতালা দিয়ে রাখবে। তারপর কোনো শুভদিনে ওই সতীত্ব কারো হাতে তুলে দেওয়া হবে। বিবাহ।
শ‍্যামলী বলল, বিয়ে কথাটার উৎসে আছে বলপূর্বক বহন করা।
অনসূয়া বললেন, তারপর দ‍্যাখ্, নারী পুরুষের দেহের রহস্য নিয়ে কৌতূহল সিদ্ধার্থের যথেষ্ট রয়েছে। অথচ বোনের বেলা তিনি গার্জিয়ান। এখানটা শোন্, “খাটের নীচে সিদ্ধার্থের সুটকেসটার মুখ খোলা। টুনুই খুলেছিল নিশ্চয়ই। হঠাৎ সিদ্ধার্থর রাগ হয়ে গেল। টুনু বড্ড বাড়াবাড়ি আরম্ভ করেছে—কতবার বারণ করেছি ওকে—সুটকেসে কত জরুরি কাগজপত্র আছে! তাড়াতাড়ি সুটকেসটা খুলে একেবারে নীচে পাতা খবরের কাগজটা উলটে দেখল। ছবিগুলো ঠিকই আছে। কলেজে পড়ার সময় একটা ছেলে সিদ্ধার্থকে এই ছবিগুলো দেখতে দিয়েছিল; নারী-পুরুষের গোপন ব্যাপারের ছবি—এগুলো আর ফেরত দেওয়া হয়নি। কোনো-কোনোদিন মাঝরাত্রে এ ছবিগুলো সিদ্ধার্থর এখনও কাজে লাগে। কিন্তু কোনোদিন টুনুর চোখে পড়ে যাবে—এবার এগুলো কোথাও সরাতে হবে। আদিনাথকে দিলে লুফে নেবে। কিংবা টুনুটাকে যদি অন্য ঘরে সরানো যেত! টুনু কিছুতেই ছোটোকাকার সঙ্গে শোবে না। আর তো ঘরও নেই!”
শ‍্যামলী বলে, আদিনাথ নামে ওই যে একটা ক‍্যারেকটার রয়েছে গল্পে, তার‌ই সাথে একটা নার্সের যোগাযোগ। দেহসম্পর্ক। একেবারে পয়সা দিয়ে সম্পর্ক। সুনীল একভাবে দেখিয়েছেন জিনিসটা। রিয়ালিস্ট লেখক যেমন দেখিয়ে থাকেন। সত‍্যজিৎ কিন্তু গড়পড়তা বাঙালি  সিনে গোয়ারদের চিনতেন। তারা কতটা নিতে পারবেন সে নিয়ে সত‍্যজিতের স্পষ্ট ধারণা ছিল। তবুও গণ্ডগোল হয়েছিল।
অনসূয়া বললেন কোন্ গণ্ডগোল?
শ‍্যামলী বলল, গল্পের চরিত্রের নাম লতিকা। সিনেমা করতে গিয়ে সত‍্যজিৎ খুঁজে নিলেন আরতি দাসকে। ওকে গড় বাঙালি চেনে মিস শেফালি নামে।
অনসূয়া বললেন, ওহ্, সেই নার্সের পোশাক ছেড়ে শুধু অন্তর্বাসটুকু পরে ঘরের মধ্যে ঘুরে বেড়ানো।
শ‍্যামলী বলল, না, শুধু ওটুকু নয়। সিনেমার স্ক্রিনে সত‍্যজিৎ দেখাচ্ছেন, বাথরুমে ঢুকে গিয়েছে লতিকা। ব্রায়ের হুক খুলতে সমস‍্যা হবার ছল করে সিদ্ধার্থের সামনেই আদিনাথকে ডেকে নিল লতিকা।
ওই জায়গাটা মূল গল্পে অনেক বেশি করে বলেছিলেন সুনীল। কিন্তু সত‍্যজিৎ রায় চিত্রনাট্যে অনেক মেদ ঝরিয়ে একবারে স্লিম করে দিয়েছিলেন। তাতেও সমস্যা এড়ানো যায়নি।
অনসূয়া বললেন, গল্পে অন‍্যরকম ছিল। তাই তো। ঠিক বলেছিস তো।
শ‍্যামলী বলল, খুব মুন্সিয়ানা করে আভাসে ইঙ্গিতে কাজ সারলেন সত‍্যজিৎ। তবু নার্সেস ইউনিয়ন সেই নিয়ে তুলকালাম করেছিল। সংগঠনের নেত্রীরা সত‍্যজিতের বাড়িতে ধরনা দিয়ে বলেছিলেন ওই সিনটা বাদ দিতে হবে। ক্ষমা চাইতে হবে। অথচ গল্পে অনেক ইলাবোরেট ছিল। তাতে কারো কিছু সমস্যা হয় নি।
অনসূয়া বললেন, কী বলেছিলেন নার্সদের নেত্রীরা?
শ‍্যামলী বলল, বলেছিল, আপনি ওভাবে একজন নার্সিং স্টাফের সাথে ডাক্তারি ছাত্রের দেহসম্পর্ক দেখালেন। পয়সার বিনিময়ে দেহসম্পর্ক। এতে লোকেরা নার্সদের খারাপ ভাববে।
অনসূয়া বললেন, কি মুশকিল, তাহলে একজন শিল্পী তার ভাবনাটা তুলে ধরার আগে চিত্রনাট্যটা নেত্রীদের দেখিয়ে নিতে বাধ‍্য থাকবে?
শ‍্যামলী বলল, হ‍্যাঁ, চার্চ মিল্টনকেও এই কথাই বলেছিল। গ‍্যালিলিওকে হাঁটু গেড়ে ক্ষমা চাইতে বাধ‍্য করেছিল। ইন্দিরা গান্ধীও সেই এক‌ই পথের পথিক ছিলেন। বাবার গুরুদেব ধর্ষণের অভিযোগ গ্রেপ্তার হয়েছেন, আর সেই গুরুদেবের মামলা লড়ার চাঁদা তোলা নিয়ে প্রতিবাদ করতে আমায় মারধোর করা হয়েছে। নিজের মনোমত চলার অধিকার দেবে না পরিবার। সব সময় মন যুগিয়ে চলো। রোজগার করলেও রেহাই নেই। একটা মেয়েকে একটা ভারবাহী পশুর বেশি সম্মান দিতে নারাজ আমার পরিবার। আমায় নিজের একটা জায়গা খুঁজে নিতেই হবে।

ক্রমশ…

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।