রবিবারে রবি-বার – এ মৃদুল শ্রীমানী

মৃত্যুর নিপুণ শিল্প – ১৬

১| কে তুমি নন্দিনী: রাণুর রবীন্দ্রনাথ

তোমার রাণু নামটি খুব মিষ্টি। আমার একটি মেয়ে ছিল, তাকে রাণু বলে ডাকতুম, কিন্তু সে এখন নেই।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ কথা যাঁকে লিখেছিলেন, সেই তিনি রাণু অধিকারী। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অনেক সাহিত্য সৃষ্টি, নাট‍্যসাধনার নেপথ‍্যে তিনি। কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ‍্যাপক ফণিভূষণ অধিকারীর এই কন‍্যাটির ভাল নাম ছিল প্রীতি।

অধ‍্যাপক অধিকারীর সাথে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পরিচয় হয়েছিল ১৯১০ খ্রীস্টাব্দে। গরমের ছুটির পরে, কর্মস্থলে ফিরে যাওয়ার পথে, অধ‍্যাপক অধিকারী কয়েক ঘণ্টার জন‍্য শান্তিনিকেতনে এসেছিলেন। তাঁর লেখা প্রশস্তি “বোলপুর ব্রহ্মবিদ‍্যালয়” নামে প্রবাসী পত্রিকার ১৩১৭ বঙ্গাব্দের অগ্রহায়ণ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। অধ্যাপক অধিকারী ও তাঁর স্ত্রী সরযূবালা রবীন্দ্র সাহিত্যে গভীর ভাবে অনুরক্ত ছিলেন। সেটিই রাণুসহ তাঁদের অন‍্যান‍্য সন্তানদের মধ‍্যে সঞ্চারিত হয়েছিল। রাণু কবিকে যখন চিঠি লিখতে সবে শুরু করেন, তখনো চর্মচক্ষে পরিচয় হয় নি। নয় বছরের বালিকা প্রথম চিঠিতে কবিকে সম্ভাষণ করেছিলেন ‘প্রিয় রবিবাবু’ বলে। সেই পত্রে বালিকা রবীন্দ্রনাথের গল্প ক্ষুধিত পাষাণ ও জয়পরাজয় নিয়ে কৌতূহল প্রকাশ করেছিলেন। কবির জ‍্যেষ্ঠা কন‍্যা মাধুরীলতার শরীরে ক্ষয়রোগ বাসা বেঁধেছিল। মাধুরীলতার মৃত‍্যু হয় ১৬ মে, ১৯১৮, বৃহস্পতিবার। সকালে। এর ঠিক একদিন আগে কবির সাথে রাণুর চর্মচক্ষে প্রথম দেখা। রাণু তখন ন দশ বছরের বালিকা। সেই প্রথম সাক্ষাৎ এর অভিজ্ঞতা নিজের কলমে লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ২৫ আগস্ট, ১৯১৮ তারিখে। তখন রাণুর পরিবার কলকাতার ল‍্যান্সডাউন রোডে থাকতেন। বড়মেয়ের অন্ত‍্যেষ্টি সেরেই কবি সরাসরি গিয়েছিলেন রাণু সন্দর্শনে। পরবর্তীকালে লেডি রাণু হয়ে, অভিজ্ঞ কলমে সেদিনের বালিকা লিখেছিলেন, অন্ত‍্যেষ্টিক্রিয়া নিষ্পন্ন করে এক ভিখারির মতো তিনি আমাদের গৃহের সামনে এসে দাঁড়িয়ে ডাকছিলেন, রাণু রাণু কোথায় গেলে?

শুধুমাত্র জ‍্যেষ্ঠাকন‍্যা মাধুরীলতার সূত্রেই নয়, মধ‍্যমা রাণীর সঙ্গেও রাণু জড়িয়ে আছেন। রাণীকেও রবীন্দ্রনাথ হারিয়েছেন বড়ই অকালে। কবি তাঁর প্রাণপ্রতিমা রাণুকে মধ‍্যমা কন‍্যার বিষয়েই লিখেছেন, “আমার একটি মেয়ে ছিল, তাকে রাণু বলে ডাকতুম, কিন্তু সে এখন নেই”। রক্তকরবী নাটকের সূত্রেও রাণু অধিকারী নানাভাবে জড়িয়ে আছেন।

২| ‘হায় রে, ধূলায় বিছিয়ে গেছে যূথীর মালা কার।’

১৯২৪ সালের ২৬ অক্টোবর তারিখে ‘প্রকাশ’ নামে একটা কবিতা লেখেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তখন তিনি অ্যাণ্ডেস জাহাজের যাত্রী। ওই কবিতায় তিনি লেখেন, ‘খুঁজতে যখন এলাম সেদিন কোথায় তোমার গোপন অশ্রুজল, সে পথ আমায় দাও নি তুমি বলে।’
আরো লেখেন,
‘এই ছবি মোর ছিল মনে-
নির্জনমন্দিরের কোণে
দিনের অবসানে
সন্ধ‍্যাপ্রদীপ আছে চেয়ে ধ‍্যানের চোখে সন্ধ্যাতারার পানে।’
লেখেন,
‘ভোগ সে নহে , নয় বাসনা,
নয় আপনার উপাসনা,
নয়কো অভিমান —
সরল প্রেমের সহজ প্রকাশ, বাইরে যে তার নাই রে পরিমাণ।’

বাংলা ক‍্যালেণ্ডারে এই দিনটা ছিল রবিবার। কার্তিক মাসের নয় তারিখ। অ্যাণ্ডেস জাহাজ থেকে এই ২৬ অক্টোবর তারিখেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রশান্তচন্দ্র মহলানবীশকে চিঠিতে লিখেছেন, ‘ভেসে চলেচি। দুই এক দিনের মধ্যে ব্রেজিলের একটা বন্দরে পৌঁছব। সেখান থেকে আর্জেন্টিনায় পৌঁছতে আরো কিছুদিন। …. এবারে বক্তৃতার দুশ্চিন্তা নেই বলে কবিতা লিখতে মন দিয়েচি। ভারতবর্ষ থেকে বেরিয়ে এসে এত কবিতা আমার জীবনে আর কখনো লিখিনি। ভারত মহাসাগরে গদ‍্যের সঙ্গে মিশোল দিয়ে কবিতা লিখেচি — এ জাহাজে একেবারে নির্জলা পদ‍্য। সাত দিনে বারোটা কবিতা স্বদেশের আবহাওয়াতেও সহজ নয়। … এই কবিতাগুলো সব বৈকালীতে ছাপাতে পারবে।’

এই সময়ে কবির শরীর খারাপ হয়েছিল। যাত্রা পথের সঙ্গী লেনার্ড এলমহার্স্ট তাঁর ভাবী পত্নী ডরোথিকে জানিয়েছেন এভাবে, “দি পোয়েট কট এ চিল অন দি বোট, ইট ডেভেলপড ইনটু ফ্লু, হি প্রিপেয়ারড টু ডাই আফটার সাম হেজিটেশন অ্যাণ্ড প্রম্পটলি গট ওয়েল, নেভার সীজিং টু টার্ন হিজ় ইমাজিনেশন ইভন অ্যাট হিজ় ওয়ার্স্ট।” এই সময়ের কথা কবি স্মরণ করেছেন এভাবে: বিষুবরেখা পার হয়ে চলেছি, এমন সময় হঠাৎ কখন শরীর গেল বিগড়ে; বিছানা ছাড়া গতি রইল না। ….. মাঝে মাঝে মনে হত এটা স্বয়ং যমরাজের পায়ের চাপ। দুঃখের অত‍্যাচার যখন অতিমাত্রায় চড়ে ওঠে তখন তাকে পরাভূত করতে পারি নে; কিন্তু তাকে অবজ্ঞা করবার অধিকার তো কেউ কাড়তে পারে না — আমার হাতে তার একটা উপায় আছে, সে হচ্ছে কবিতা-লেখা।… আমি সেই কাজে লাগলুম, বিছানায় পড়ে পড়ে কবিতা লেখা চলল।’

নভেম্বরের একেবারে গোড়ায়, হয়তো চার তারিখে রবীন্দ্রনাথ প্রশান্তচন্দ্রকে লেখেন, ‘ক’দিন শরীর বেশ রীতিমত খারাপ চলছিল, বুকে ব‍্যথা, দুর্বলতা ইত‍্যাদি। তাই রাত্রে শুয়ে শুয়ে বারবার মৃত্যুর কথা মনে আসছিল। মৃত্যুর কবিতাটা তার থেকেই জনশূন্য সঙ্কীর্ণ ক‍্যাবিনে রোগযন্ত্রণায় নিজেকে সান্ত্বনা দেবার জন‍্যে। প্রথম দুই একদিন খুব ইচ্ছা হচ্ছিল দেশে ফিরে যাই — তার পরে মনে হল দেশ তো জন্মের জন‍্যে, মৃত্যুর জন‍্যে পথ।…. দীর্ঘপথের শেষভাগে পথিকের যে রকম একান্ত ক্লান্তি আসে আমার ঠিক তাই হয়েছে। সেই জন‍্যেই আমি যা তা কবিতা লিখে স্বপ্নলোক সৃষ্টি করচি।’

এইসব কবিতা লিখতে লিখতে কবি বুয়েনোস এয়ারিস এ ১২ নভেম্বর তারিখে লিখে ফেললেন,

‘হে বিদেশী ফুল, আমি যেদিন প্রথম এনু ভোরে,
শুধালেম, ‘চেন তুমি মোরে?’
হাসিয়া দুলালে মাথা…
কহিলাম, বোঝ নি কি তোমার পরশে
হৃদয় ভরেছে মোর রসে।’

ওই নভেম্বরের ১৫ তারিখে লিখলেন,

প্রবাসের দিন মোর পরিপূর্ণ করি দিলে, নারী, মাধুর্যসুধায়; কত সহজে করিলে আপনারই
দূরদেশী পথিকেরে.. হে নারী, শুনেছি তব গীতি —
প্রেমের অতিথি কবি, চিরদিন আমারই অতিথি।’

১৬ নভেম্বর লিখলেন এক অসাধারণ কবিতা। লিখলেন,
শয়ন ছেড়ে উঠে তখন
খুলে দিলেম দ্বার —
হায় রে, ধূলায় বিছিয়ে গেছে
যূথীর মালা কার।’

আরো বললেন,
‘আজ হতে মোর ঘরের দুয়ার
রাখব খুলে রাতে…

বললেন,

আজ হতে কার পরশ লাগি
পথ তাকিয়ে রইব জাগি–‘

সচেতন পাঠক “এই আজ হতে কার পরশ লাগি /পথ তাকিয়ে রইব জাগি… ” পংক্তির অনুষঙ্গে ১০ জুলাই, ১৯৪০ তারিখে কবির একটি চিঠির বয়ান স্মরণ করবেন, ” When the world atmosphere is darkened the distracted heart naturally yearns for the nearness of those friends in whom are associated the memory of happier days the value of which enhances with time. Often it comes to my mind the picture of that riverside home and the regret that in my absent minded foolishness I have failed to accept fully the precious gift offered to me.”

ওই যে লিখেছিলেন “হে বিদেশী ফুল”, সেই বিদেশী ফুল হলেন ভিক্টোরিয়া ওকাম্পো। ওকাম্পো ১৮৯০ সালে জন্মানো মেয়ে, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে সাক্ষাতের সময়ে তাঁর বয়স চৌত্রিশ। বাইশ বছর বয়সে মেয়েটির বিয়ে হয়েছিল, সেটা ১৯১২ সাল, কিন্তু স্বামীর প্রাচীনপন্থী রুচির সাথে তাঁর মেলবন্ধন হয় নি। মধুচন্দ্রিমার সময়েই তাঁদের দাম্পত্যে বেসুর বাজে। এক সম্পর্কিত দেবরের সাথে ভিক্টোরিয়ার অনুরাগের পালা শুরু হয়। গোপন সম্পর্ক চলতে থাকে। অসুখী বিবাহ ও গোপন প্রেমের দ্বন্দ্বে ক্ষতবিক্ষত ভিক্টোরিয়ার কাছে এসে পৌঁছায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতাঞ্জলি, আঁদ্রে জিদ এর ফরাসি অনুবাদে। সেটা ১৯১৪। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তখন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী কবি। তখন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছে। স্বামীর সাথে ভিক্টোরিয়ার আইনস্বীকৃত ছাড়াছাড়ি সম্পূর্ণ হয়েছিল ১৯২২এ। এই অবস্থায় ১৯২৪এ কবির সঙ্গে তাঁর দেখা।

নিজের কাছে প্রিয় কবি যাতে আরো একটু বেশিদিন থাকেন, তার পুঁজি যোগাড় করতে তিনি নিজের হীরের অলঙ্কার পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে দ্বিধা করেন নি।

নিজের ভালবাসাকে বহু উচ্চ পর্যায়ে উন্নীত করতে জানতেন রবীন্দ্রনাথ। সেই মর্মে আদরণীয়াদের গড়ে নিতেও জানতেন কবি। ওকাম্পোকে বিজয়া করে গড়ে নিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। তারপর কবিতাগুলি তাঁকেই উৎসর্গ করেছেন প্রীতিভরে। যে বইয়ের নাম হতে পারত বৈকালী, তা হয়ে উঠল পূরবী, এক মনোহরার জন‍্য কবির দুখবাদলের ফল।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।