কর্ণফুলির গল্প বলা সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে এস মিয়া ওমরান (পর্ব – ৬)

মাছ

মাস তিনেক পর
আজগর আলী বাড়িতে আসার জন্য খুব উদগ্রীব হয়ে উঠে। দীর্ঘ ইটখোলার জীবনে আর কখনো বাড়ির প্রতি তার এমন পিছুটান হয়নি। হঠাৎ করে এবার বাড়ির প্রতি তার ভিষণ একটা পিছুটান সৃষ্টি হয়েছে। কিন্তু মাঝিকে শত বলার পরও মাঝি তাকে ছুটি দেয় না।অনেক আর্জি করেও কিছুতে মাঝি রাজি হয় না।
আমাকে অন্তত একদিনের জন্য ছুটি দেন।আজগর আলী মাঝির কাছে কাকুতি মিনতি করে। মাঝির কঠোর উত্তর।
না। তুই সবকিছু জানিস।এখানে ছয় মাসের জন্য একেবারে আসতে হয় আবার একেবারে যেতে হয়।তাছাড়া খড়মাওয়ালা পালিয়ে গেছে। আমার টাকা খেয়ে পালাবে কোথায়। আমার টাকা দিতে হবে। আর এখন মাত্র কাজ শুরু হয়েছে। এখন অনেক মাল বানাতে হবে। কয়েক দিনের মধ্যে আমি এলাকায় যাবো। খড়মাওয়ালা কাউকে আনতে পারি কিনা। মাঝির বয়সের তুলনায় আজগর আলী অনেক বড়। লেবারদের মধ্যে সবাই তাকে সম্মান করে। কিন্তু মাঝি তার সাথে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে ব্যবহার করে। কারণ তারা গরীব অসহায় মানুষ। লেবারের কাজ করে। তাই অনেক সময় অনেক অপমান অপঘাত নিরবে নিভৃতে সয়ে যায়। কাউকে তা বুঝতে দে না।
অনেক রাত। হঠাৎ টিন পিটা শব্দে তাহের মাঝির ঘুম ভেঙে যায়।নিরব নিস্তব্ধতায় ঢেকে গেছে চারিধার। কোথাও কোন টুঁশব্দ নেই। চারিদিকে এখন ঘুমের মাতাল। তাহের মাঝির চিন্তায় ঘুম আসে না। সারাদিন এ গ্রাম ঐ গ্রাম ঘুরে কোন খড়মা ওয়ালা ঠিক করতে পারে নাই। সে মনে মনে ভাবতে থাকে এবার বোধহয় লোকসান গুণতে হবে।
তাদের পাশের বাড়ির মনচুরার মা রাত জেগে জেগে বরই ফল গাছ থেকে বাদুড় ও অন্যন্যা ক্ষতিকর প্রাণী তাড়ায়।তাই বরই ফলগুলো রক্ষা করার জন্য বরই গাছের মাথায় একটা টিন বেঁধে দিয়েছে। আর ভেতরে লৌহের একটা খঞ্জন বেঁধে দে।মাঝে মাঝে রশি ধরে টান মারে।তখন ডংডং একটা শব্দের সৃষ্টি হয়।টিন পিটা শব্দ শোনে বাদুড়গুলো পালিয়ে যায়। তার বড় মেয়ের নাম হল মনচুরা। তাই এলাকার ছেলে বুড়ো সকলে এ নাম ধরে তাকে ডাকে এবং চিনে।
আজ কয়েক দিন ধরে আজগর আলী কেমন জানি উদাসীন। কাজ করে ত গা ছাড়া। ভেতরে ভেতরে কি গভীর চিন্তায় সারাক্ষণ মত্ত থাকে। কাউকে তা স্পষ্ট করে না।
হাফিজ জিজ্ঞেস করে। কি আজগর আলী ভাই তোমার কি হয়েছে। তোমাকে কেমন বিমর্ষ এবং চিন্তিত দেখায়।যে লোকটি শত দুঃখের মাঝেও সদা প্রফুল্ল মনে কাজ করত।কখন তোমাকে আর এমন দেখি নাই। বলত কি হয়েছে। কেউকি কিছু বলেছে।
আসলে তেমন কিছু না।কোন কিছু ভালো লাগে না। কয়েক দিন হতে মন বাড়িতে যাওয়ার জন্য চটপট করতেছে। কাজ হতে মন, দেহ হতে প্রাণ কেমন জানি আগলাইয়া গেছে। কাজের মাঝে কোন স্বস্তি পাইনা।
তাছাড়া এখানে আসার পর খবর পেলাম রাত করে জমির ধান চুরি করে নিয়ে গেছে। কি করল না করল আর কোন খবর পেলাম না।
মাঝিকে কি বলছ?
বলছি।মাঝি কিছুতে ছুটি দিতে রাজি না। সে দিবে না।তার সাফ সাফ কথা।
আমারও বাড়িতে যাওয়া দরকার। হাফিজ বলে।
তোমাদের ভাবি সন্তান সম্ভবা।নতুন মেহমান দুনিয়াতে আসবে। সময়ও ঘনিয়ে গেছে।
কই,কোনদিন কইলা নাতো। আজগর আলী তার সাথে দুষ্টুমি করে। ক্ষণকালের জন্য মনের যাতনাকে ভুলে দুই ঠোঁটের কোণে প্রহসনের একখণ্ড হাসি ফুটে। তারপর আবার সূর্য গ্রহণের ন্যায় মুখটাকে দুঃখ ঘিরে পেলে।
অন্য প্রান্তে হতে ইউনুস জিজ্ঞেস করে।
হাফিজ ভাই তোমার ছেলেমেয়ে মোট কয়টা?
কেউ যখন তার ছেলেমেয়েদের কথা জিজ্ঞেস করে তখন সে তা এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। এ নিয়ে তার দশটা ছেলেমেয়ে হয়েছে। তন্মধ্যে একটা ছেলে পানিতে পড়ে মারা যায়। এর জন্য তাকে অনেক সময় লজ্জা পেতে হয়।
এবারও সে নানাবিধ কথা তুলে পার পেতে চেয়েছে। কিন্তু ইউনুস নাছোড়বান্দা তার বারবার পীড়াপীড়িতে শেষ পর্যন্ত বলতে বাধ্য হয়।ঐ মূহুর্তে সকলে তাকে নিয়ে রহস্যে মেতে উঠেছে। কেউ একজন বলে হাফিজ ভাই বন্ধ করবা না।আরেক জন বাধা দেয়, না এখন পাঁচটা বাকি। কারণ একজন মাঝির পনের জন লোক লাগে।তারপর সকলে একসাথে হেসে উঠে। যেন তখন ইটের ভাটায় পৃথিবীর সব আনন্দ উছরে পড়েছে। একজন থেকে একজন সেই আনন্দ কেড়ে নেয়। এভাবে তা সারা ভাটায়ময় ছড়িয়ে পড়ে।
তখন সে বলে আমাকে এক মৌলভী সাব বলেছে এটা বন্ধ করলে পাপ হবে। রোজহাসরে এর জন্য জাবাব দিতে হবে।
তো এদেরকে খাওয়া-পরাও কিভাবে? ইউনুস জিজ্ঞেস করে।
তার চিরাচরিত উত্তর। আল্লা..চালান।
আজ দুদিন হয়ে গেছে।
সারাদিন একটি বারের জন্য আকাশে সূর্যের দেখা মিলেনি । সারাদিন কুয়াশায় আচ্ছন্ন থাকে।এক বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়।
মানুষেরা বাড়িতে।
রাস্তার পাশে।
বিভিন্ন খড়কুটো এক সাথে করে আগুন লাগিয়ে পোহাতে থাকে। হঠাৎ একটা শোর চিৎকার শোনা যায়।
আহারে পোড়া গেছেরে..।
বাড়ির সবাই ছুটে আসছে। কেউ রসুই ঘর হতে। আবার কেউ উঠোন থেকে। যে যেখানে ছিল।
একজন আরেক জনকে জিজ্ঞেস করে।
কেমনে পোড়া গেছে?
একজন তা বিস্তারিত বলতে লাগলো। আর কয়েকটা মাথা একসাথ হয়ে তা শুনে। তারপর আপসোস করে।
আহারে বুড়ো মানুষ। এখন কত কষ্ট পাবে।
একজন খুব বয়স্ক মহিলা। বয়সের ভারে এখন আর বিছানা ছেড়ে উঠতে পারে না।সারাক্ষণ বিছানায় পড়ে থাকে। এখন শীতকাল তাই যেন একটু গরম লাগে সেই জন্য তার বিছানার পাশে একটি আগুনের ভাঁড় রাখা হয়।কিন্তু কখন যে, তার হাত পুড়ে গেছে একটুও টের পায়নি। বয়সের কারণে এখন আর আগের মত অনেককিছু শারীরিক বোধদয় করতে পারে না।
সকালের বিরতিতে খেতে গিয়ে আজগর আলী এবং বাবুর্চির মধ্যে অনেকক্ষণ ঝগড়া হয় খাওয়া নিয়ে। প্রতিদিন এক তরকারি।
আলু আর মুলা। পরিবর্তন করে আনতে পারনা।খেতে খেতে তিতে হয়ে গেছি।
আমাকে বলে কোন উপকার হবে না। আমি হলাম বাবুর্চি। আমার দায়িত্ব হল শুধু রান্না করা। তোমাদের যার যা অভিযোগ তোমরা মাঝিকে বল।
আবার আজগর আলীকে লক্ষ্য করে বলে সবাই খেতে পারে। শুধু উনি খেতে পারে না।কারো কোন সমস্যা হয় না। কেবল তারই সমস্যা।
এ কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে বাবুর্চি সকলের রোষানলে পড়ে। তখন আজগর আলী আবার উত্তর দে। এটা শুধু আমার একার নয় সকলের চাপা ক্ষোভ।
অ্যাঁ হইছে, হইছে আপনারা সবাই মাঝিকে বলেন।
এবার হাফিজও মুখ খোলে। তুমি হলে বাবুর্চি। আমাদের মতো কাজ করতে আসছ।তুমি কেন মাঝির পক্ষ নিয়ে ঝগড়া কর। মায়া কেঁদে লাভ নেই কিছুই দেবে না।
তখন আরেক জন বলে। না দিবে, এবার যে জমিটা কিনবে তা বাবুর্চি নামে কিনবে। তারপর বিড়বিড় করে বলে অন্যন্যা মাঝিরা লেবারদেরকে ভালো ভালো খাবার দে।আর আমাদের মাঝি..বলতে গিয়ে আর বলে না।
চারদিক হতে একেক জন একেক কথা বলে বাবুর্চিকে । বাবুর্চি কোন কথা বলে না। কারণ সে মাঝির পক্ষ নিয়ে কোনঠাসা হয়ে পড়ে।
আজগর আলী রাগ করে ভাত খায় না।না খেয়ে মাটির টিবির এক পাশে গিয়ে বসে রয়।যেখান থেকে তাঁরা মাটি কেটে দে।হঠাৎ একটা আকস্মিক ঘটনা ঘটে। মাটির একটা বিশাল খন্ড ধসে পড়ে। তার নিচে বসা ছিল আজগর আলী সঙ্গে সঙ্গে মাটির নিচে চাপা পড়ে যায়। পাশে অন্য মাঝির লেবার কাজ করে। প্রথমে একজন দেখে সে চিৎকার করে উঠে। তখন সবাই ছুটে আসে। তাকে টেনেহিঁচড়ে মাটির ভেতর হতে বের করে।
ততক্ষণে সে আধমরা।
লাশ হয়ে শুয়ে আছে কোন কথাবার্তা নেই। ইটখোলা হতে বেশ কয়েক মাইল দূরে হলো হাসপাতাল। তাকে সেখানে নেওয়া হয়।চিকিৎসক তাকে দেখে মৃত ঘোষণা করে। যখন তার লাশ বাড়িতে আনা হয়।সাথে সাথে শোকের এক ক্রন্দন বীণা বেজে উঠে। সেই সুর আকাশ-পাতাল ধ্বনিত হতে থাকে। উপস্থিত সকলের গায়ের লোম শিউরে ওঠে। কেউ আর চোখের জল ধরে রাখতে পারে না। কেউ চোখ লুকিয়ে কাঁদে আবার কেউ প্রকাশে।
সবাই মা-মেয়েকে শান্তনা দে কিন্তু কিছুতে তাদের কান্না থামে না। সবচেয়ে বেশি কাঁদছিল তার মেয়েটি বিলাপ করে করে।
হঠাৎ একটা অযাচিত ঘন কালো অন্ধকারে ঢেকে যায় আজগর আলী পরিবার। যে ছিল পরিবারের একমাত্র উপার্জনকারী।যার কর্মময় দুটি হাতের উপর ভর করে চলছিল তাদের সংসার। আজ সে শুয়ে আছে নিরব নিথর হয়ে বুকের উপর একগাদা মাটি নিয়ে। রাস্তার পাশে বাবলা গাছটার নিচে তাকে কবর দেওয়া হয়। যারা তার পরিচিত ছিল তারা কবরের দিকে তাকিয়ে আপসোস করতে করতে যায়।মৃত্যুর দিন এলাকার সকলে মাঝির কাছে সুপারিশ করেছিলো তাদের পরিবারকে কিছু আর্থিক সহযোগিতা করার জন্য। দিবে বলে আর দেয়নি।
পরে পরে তার কাছে চাওয়া হলে সে অস্বীকার করত।আরো কর্কশ ভাষায় বলত, এমনিতে আমার অনেক লোকসান হয়ে গেছে তার মৃত্যুতে।কারন এখনো অনেক মাস আছে ইটের ভাটা উঠতে। একদিকে খড়মা ওয়ালা পালিয়ে গেলো আবার এখন আজগর আলী মারা যা।এ মুহূর্তে আমার দু’জন লোক প্রয়োজন।এবার গণেশ(ভাগ্য) আমার উল্টো পথে।
সন্ধ্যা হতে শোর চিৎকার।
ধর।ঘের।
গ্রামে চোর পড়ছে। বাড়ির বৌ ঝিরা সবাই চিন্তিত । কখন কোন্ বাড়িতে পড়ে। এমন সময় হলে চরকে চর পৌরুষহীন হয়ে যায়। পুরুষরা সবাই জীবনের তাগিদে বাড়ির বার হয়ে যায়। আর এ সময় গ্রামে চোরের উপদ্রব বেড়ে যায়। যে সব বাড়িতে গরু, ছাগল আছে ঐ সব বাড়ির মহিলাদের চোখের নিদ নাই। একজন পথচারী মুন্সির দোকানে বসে চা খাচ্ছে। সবাই যখন চোরের উপদ্রব নিয়ে আলোচনা করছিল তখন সেও তাদের সাথে আলোচনায় সামিল হয়।
গতরাতে আমাদের গ্রামে চুরি হয়েছিল একটি বাড়িতে। তাদের একটি গাভী গরু ছিল গরুটি নিয়ে যায়। সরকারি তরফে পেয়েছিল। একটি বাড়ি, একটি খামার এ প্রকল্প হতে।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।