কর্ণফুলির গল্প বলা সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে মনিরুল ইসলাম (পর্ব – ১)

রাজলক্ষী

মাধ্যমিক পাস করে রাজ ভর্তি হয়েছে ব্রিটিশ সরকারের আমলে তৈরি লন্ডন মিশনারি সোসাইটিতে। বড়দের মুখে শুনেছে এল এম এস স্কুলের অনেক ইতিহাস। ছোট থেকে রাজের ইচ্ছা ছিল এল এম এস স্কুলে ভর্তি হওয়ার।
প্রথম দিনের ক্লাস। নতুন পরিবেশ, নতুন মানুষ, নতুন শিক্ষক শিক্ষিকা। বলতে গেলে সমস্তটাই তার কাছে অভিনব। প্রথম দিনের ক্লাস গুলি অতিবাহিত হল ভয় মিশ্রিত আনন্দে। তুষার স্যারের ইংলিশ ক্লাস, বুলাদির বাংলা, গনি স্যারের রাষ্ট্রবিজ্ঞান সমস্তটাই চলল পরিচয়পর্ব দিয়ে। কিছুটা গল্প কিছুটা হাসি আর বুলুদির পূর্বরাগ পড়ানো কৈশোরের শেষ প্রান্ত পার হয়ে যৌবনের প্রথম লগ্নে পা দেওয়া প্রতিটি মন আন্দোলিত হয়ে ওঠে।
রাজের প্রথম দিনের টিফিনের সময় মনের অজান্তে ফুরিয়ে ফেলল। বন্ধুদের নিয়ে বাথরুম থেকে টিউবওয়েল পেরিয়ে অফিসের পিছন সিঁড়ি দিয়ে দোতলা আর্টসের ঘরে উঠতে ব্যস্ত। ঠিক তখন সঙ্গীদের ঠেলা সামলাতে না পেরে আচমকা একটি মেয়ে পড়ল রাজএর উপর। রাজ নিজেকে ধরে রাখতে না পেরে ধাক্কা খেলো দেওয়ালে। একশো বছরের পুরানো দেওয়াল রাজের কপালে একটা স্পষ্ট ছাপ ফেলে দিল।
অন্য মেয়েগুলো পাশ কাটিয়ে উদ্যম নৃত্যের ভঙ্গিতে বত্রিশটি দাঁত দেখিয়ে চলে গেল।
ক্রোধে লাল হয়ে উঠল রাজ। সামনে মেয়েটি’ মুখ নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে। কটাক্ষের সুরে রাজ বলে উঠলো যাও না ছত্রিশ টি দাঁত বার করে, দাঁড়িয়ে আছো কেন?
রাজ রূঢ়ভাবে দু-একটা কথা বললেও মেয়েটির প্রতি হঠাৎ মনে পড়ে গেল। লজ্জায় নিজের প্রতি ঘৃণায় যেভাবে মেয়েটি দাঁড়িয়ে আছে, দেখলে মনে হবে একটি অপরিস্ফুটিত গোলাপের কুঁড়ি। এ এক অদ্ভুত দৃশ্য। রাজ ছাড়াও ভগবান বুঝি আড় চোখে তাকিয়ে দেখে ছিলেন।
মেয়েটির মুখ দিয়ে উচ্চারণ করলো সরি। তারপর ধীরে ধীরে দু পা বাড়িয়ে রাজের কপালে হাত বুলিয়ে করুন নিবেদনে বলল – লেগেছে? আসলে আমি বুঝতে পারিনি ওরা অভাবে-
থাক অন্যের উপর দোষ চাপিয়ে নিজেকে আড়াল করতে হবে না। এরপর থেকে একটু দেখে চলবে। কথাটি বলতে বলতে রাজ ও তার বন্ধুরা গটমট পায়ে উপরে উঠে গেল।
পরদিন সাড়ে দশটা বাজলে রাজ স্কুলে আসলো। সেই মুখটি চোখে পড়ল না শেষ ঘন্টা পড়া পর্যন্ত। একদিন- দুইদিন- তিনদিন চলে যায়, রাজের চোখদুটি কোন একটা বিশেষ মুখ খুঁজে বেড়ায়। এক সপ্তাহ অনুপস্থিতির পর তার আশা ছেড়ে দিল। একরকম দৃঢ় সংকল্প করে বসলো। ইস্কুলে পড়তে এসেছে পড়ার বাইরে অন্যকিছু আর ভাববে না। কিন্তু সেদিন যে নারীর কোমল হাতের তপ্ত স্পর্শটুকু নিয়ে সে বাড়ি ফিরেছিল, সেই উত্তাপ তার সমস্ত সংযমের চেষ্টা কে পুড়িয়ে শেষ করে দিতে লাগলো।
আজ সোমবার ডি এম দার কাছে পড়া আছে। রাজ আসতে একটু দেরী করে ফেলল। দাদা ততক্ষনে লেখানো শুরু করে দিয়েছেন। রাজ ধড়ফড় করে ব্যাচে ঢুকে কোথাও এতটুকু বসার জায়গা পেল না। দাদা লক্ষ্মী কে ডেকে বলল, লক্ষ্মী রাজকে বসতে দাও। লক্ষী মুখ তুলে চাইল, এক নিমেষে তার চিনতে ভুল হলো না, সিঁড়ির সেই ছেলেটি।
অমাবস্যার প্রাক লগ্নে রাতের আকাশ যেভাবে চাঁদকে বারবার ঢাকতে চায় চাঁদ তবু উঁকি মারে, ঠিক তেমনিভাবে লক্ষীর ভার করা মুখে ক্ষীন হাসির রেখা বারবার ফুটে ওঠার চেষ্টা করল ভিজে পাপড়ির মত দুটি ঠোঁটে।
বসার ইচ্ছা না থাকলেও রাজ নিরুপায় হয়ে বসে পড়লো। মাথা নিচু করে লিখতে শুরু করলো। কেউ কোনো কথা বলল না, তবে দুজন দুজনকে আড়চোখে তাকানোর প্রবণতা বেড়েই চলেছে। মাঝে মাঝে চোখে চোখ পড়ে যায়, লজ্জা পেয়ে মাথা নিচু করে আবার লেখা শুরু করে। এইভাবে চলতে চলতে এক সময় লেখানো শেষ হয়ে যায়। দাদা রাজকে বলেন- পাশ থেকে কারও খাতা চেয়ে নাও । নোটটি তোমাদের সময় আসতে পারে।
রাজ মুখে কোন কথা না বলে লক্ষ্মীর খাতাটা টেনে নিল। লক্ষী মুখ ফসকে বলল- দাদা খাতা কেড়ে নিতে বলেননি, চেয়ে নিতে বলেছেন। কথাটি শেষ করে লক্ষ্মী নিঃশব্দে হাসতে লাগলো। রাজ ভেবেছিল অনেক কথা বলব, কিন্তু কোন কথা বলা হলো না। ছুটি হলে যে যার মতো স্কুলে চলে গেল।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।