সাপ্তাহিক ধারাবাহিকে মানস চক্রবর্ত্তী – ৩০

মর্তকায়ার অন্তরালে

||৩০||

প্রেমিক বিভূতিভূষণ

“বেশ একটা ছবি তুলে দাও তো |”
“আহা ! সে না হয় হল, কিন্তু ছবি নিয়ে কী করবেন?”
“উপহার |”
“কাকে ?”
“সে একজন আছে | তরুণী |”
কথোপকথনটি বিভূূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে পরিমল গোস্বামীর | বিভূতিবাবু এসেছেন পরিমলবাবুর কাছে ছবি তোলাতে | কারণ বিভূতিভূষণের তরুণী নায়িকা কল্যাণী চিঠিতে ছবি চেয়েছেন | কে এই কল্যাণী?
১৯৩৯ | বোনের মৃত্যু হলো | ভাগ্নে ভাগ্নিকে নিয়ে এলেন নিজের কাছে | প্রথমা স্ত্রী গৌরী দেবী গিয়েছেন আগেই, বোনও গেল | বিভূতিভূষণ একেবারে ভেঙে পড়লেন | স্ত্রী চলে গেলেও ভালোবাসায় টান পড়ল না | হঠাৎ টালিগঞ্জে পরিচয় হলো এক সন্ন্যাসীর সঙ্গে | শুনলেন বৃহদারণ্য উপনিষদের আত্মতত্ত্ব | আগ্রহ বাড়ল | সন্ন্যাসীর কাছেই শিখলেন ‘মণ্ডল’| ‘মণ্ডল’ হলো প্ল্যানচেটে আত্মাকে ডাকা | যাতায়াত শুরু করলেন কলেজ স্কোয়ারের থিওসফিক্যাল সোসাইটিতে | কথা হলো মৃত স্ত্রীর সঙ্গে | কথা হলেও হৃদয়ের শুষ্কতা ঘুচল না |এই শোকের আবহেই পরিচয় হলো পাড়ারই মেয়ে রমা চট্টোপাধ্যায়ের সঙ্গে | পরিচয়টা ঘনিষ্ঠ হলো | ঘনিষ্ঠতা আঁচ করতে পেরে বিভূতিভূষণ একটু ভয় পেলেন | নিজের বয়স পঁয়তাল্লিশের কাছাকাছি | রমাদেবী তখন সদ্য তরণী | বয়সের পার্থক্য প্রায় ত্রিশ বছরের | এদিকে রমাদেবী বিভূতিভূষণকে মনে-প্রাণে নিয়ে নিয়েছেন | একদিন সরাসরি বিভূতিভূষণকে বিয়ের প্রস্তাব দিলেন | বিভূতিভূষণ একটু আড়ষ্ট, একটু লজ্জিত | তাঁর এ’বিয়েতে ইচ্ছে নেই | ভয় অন্য জায়গায়-তাঁর বয়স হয়েছে, অথচ রমাদেবী সদ্য তরুণী | হয়তো সুখী হতে পারবে না বিভূতিভূষণকে নিয়ে | যুক্তি মানতে নারাজ রমাদেবী | নিরুপায় বিভূতিভূষণ জামা খুলে বুকের কাঁচাপাকা লোম দেখিয়ে বলে , “দ্যাখো আমার অনেক বয়স হয়েছে, আর ক’দিন বা বাঁচব ?”

রমাদেবীও সরে দাঁড়ানোর মেয়ে নয় | সাফ জবাব : “আপনি যদি আর মাত্র একটা বছরও বাঁচেন, তাহলেও আমি আপনাকেই বিয়ে করব |” এরপর আর যুক্তি চলে না | ৩ ডিসেম্বর, ১৯৪০রমাদেবীর সঙ্গে বিভূতিভূষণের শুভ পরিণয় সম্পন্ন হয় | রমাদেবী বিভূতিভূষণকে ‘আপনি’ আর বিভূতিভূষণ রমাদেবীকে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করতেন | দুজনে দুজনের দুটো নামও দিয়েছিলেন | বিভূতিভূষণ রমাদেবীকে ‘কল্যাণী’ আর রমাদেবী বিভূতিভূষণকে ‘মঙ্কু’ বলে ডাকতেন | আমরা এদের দাম্পত্য জীবনের কথা অবশ্যই শুনব | তার আগে বিভূতিভূষণের জীবনে আর একটি প্রেম এসেছিল সুপ্রভা দেবীর হাত ধরে সে গল্প একটু শোনা যাক |

বেথুন কলেজে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে বিভূতিভূষণ উপস্থিত | পরিচয় হলো বিভূতিভূষণ ঘনিষ্ঠ নীরদ বাবুর স্ত্রী অমিয়া দেবীর বান্ধবী সুপ্রভা দেবীর সঙ্গে | পরিচয় আগেই ছিল | ‘পথের পাঁচালী’ পড়েই একটা ভালোলাগা তৈরি হয়েছিল সুপ্রভা দেবীর | পাঠ প্রতিক্রিয়াও বিভূতিভূষণ পেয়েছিলেন শিলং থেকে চিঠিতে | কিন্তু তা সবই ছিল পরোক্ষ যোগাযোগ | আজ বেথুন কলেজে দৃষ্টি বিনিময় হলো | একে অপরকে জানাতে চাইল অপেক্ষা পরবর্তী পর্যায়ের অগ্রিম শুভেচ্ছা | বিভূতিভূষণের তখনো একটু সলজ্জ ভাব |

তবে বিভূতিভূষণের একটা সুবিধা হলো সুপ্রিয়া দেবী যেহেতু অমিয়া দেবীর পরিচিতা তাই সেই সূত্রে সুপ্রভা দেবীর অনেক খবর বিভূতিভূষণের কর্ণগোচর তদুপরি মর্মগোচর হতো | সুপ্রভা দেবী কবিতা লিখেন একথা জানতে পেরে বিভূতিভূষণ তাঁকে কবিতা লেখা শেখাতে কৌতুহলী হলেন | মননশীল পাঠকের মনে হতেই পারে, বিভূতিভূষণ গল্পকার- কথাকার, তাঁর সঙ্গে কবিতার কী লেনাদেনা? প্রমথনাথ বিশি তার সমাধান সূত্রে বলেছেন : “বিভূতিভূষণ কবি, তাঁর সমস্ত রচনাই পুরুষবেশি চিত্রাঙ্গদার মতো ছদ্মবেশি কবিতা |” সম্পর্ক ঘনিষ্ঠ হলো | কোথাও যেনো যোগসূত্রের মিল বন্ধন ঘটল |

সিনেট হলে হবে বিজ্ঞান কংগ্রেসের সমাবেশ | ডেভিড মিড বক্তৃতা করবেন নীহারিকাপুঞ্জ সম্বন্ধে | সভাপতি জেমস জিনস | অনেককে বললেন বিভূতিভূষণ, কেউ যেতে রাজী হলেন না | বিজ্ঞানের তত্ত্ব নিয়ে ওদের তেমন কোনো উৎসাহ নেই | সুপ্রভাদেবী সঙ্গ দিলেন বিভূতিভূষণের | দুজনে পাশাপাশি বসে শুনছেন জেমস জিনসের বক্তৃতা | “আলটিমেট রিয়ালিটিজ অব দ্য ইউনিভারস আর অ্যাট প্রেজেনট কোয়াইট বিয়নড় দ্য রিচ অব সায়েনস অ্যানড প্রোববলি আর ফরএভার বিয়নড দ্য কমপ্রিহেনসন অব দ্য হিফম্যান মাইনড…..” বক্তৃতা সুপ্রভার দেবীর ভালো লাগল | বিভূতিভূষণেরও আরো বেশি ভালো লেগে গেলো সুপ্রভা দেবীকে | মনে মনে বললেন – বড় মননশীলা মেয়েটি |

একদিন দুজনে গেলেন আশুতোষ হলে জাপানি কবি ইয়োনে নোগুচির বক্তৃতা ও কবিতা শুনতে | কবি প্রথমে তাঁর স্বরচিত কবিতা পাঠ করলেন মাতৃভাষায় | পরে আবার নিজেই তার ইংরেজি অনুবাদ শোনালেন | মুগ্ধ বিভূতিভূষণ | ফেরার পথে বিভূতিভূষণ আওড়াতে লাগলেন- “ইন দ্য টুইলাইট হোয়েন দ্য ভিসন অ্যাওয়েকস |” অর্থ নিয়ে আলোচনা হয় দুজনের | ইতিমধ্যে সুপ্রভার বি.এ পরীক্ষার সাফল্য নিয়ে উল্লসিত বিভূতিভূষণ | দুজন যেনো দুজনকে চিনে নিতে চাইছে, মাপতে চাইছে সম্পর্কের গভীরতা |

ক্রমশ

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।