“বিভূতির পথে অপুর সাথে” পথের গল্প না পাঁচালী -তে মৌমিতা চক্রবর্তী

পলিবিয়ন

ছোটোমাসিকে দেখতে ডাক্তার এয়েচেন। নামের আগে নয়, পরে ডাক্তার। নীলমণি ডাক্তার। ডাকনাম পাঁচু। দেখতে অনেকটা আপেল গাছের দিকে রাতের পর রাত তাকিয়ে থাকা নিউটনের মতো। আরে ধুর! চোরা বস্তির নিউটন নয়। বিজ্ঞানী বিজ্ঞানী! যাঁকে ছাড়া শিক্ষিত নাগরিক তালিকায় নাম লেখা যায় না। ওনার মাধ্যাকর্ষণ বোঝাতে বিকাশ স্যার আমার পিঠে গোটা দশেক কঞ্চি ভেঙেছেন। পাঁচু ডাক্তার কারওর খুড়ো, জ্যেঠা, দাদু নন। সবার কাছেই এক নামে পরিচিত – ‘পলিবিয়ন।’ ডাক্তার বাবুর মুদিখানায় চাল-ডাল-মশলা-নিত্য প্রয়োজনীয় ছাড়াও সামনের দ্বিতীয় তাকটায় রাখা আছে স্টেথোস্কোপ, গামছা আর একটা টর্চ। রাতবিরেতে রোগী দেখতে যেতে হয় বলেই এই ব্যবস্থাটা করে রেখেছেন। একবার অন্ধকারে বিষধর চলে যায় পায়ের ওপর দিয়ে। শীতলতা অনুভব করেছিলেন শুধু। শুকনো পাতায় ওদের চলনের শব্দ ওনার খুব চেনা। দীর্ঘ পঁচিশ বছর ডাক্তারিতে উৎপটাং নানা ঘটনার সাক্ষী হতে হয়েছে পাঁচু ডাক্তার-কে। একবার নদী পেরিয়ে যাবেন রোগী দেখতে। সন্ধে আগতপ্রায়। সূয্যিঠাকুর সারাদিনের পরিশ্রমের পর এবার বিশ্রামের প্রস্তুতি নিচ্ছেন। দোকানের ঝাঁপ ফেলে রোগীর পরিজনের সাথে সাইকেল চেপে যাত্রা শুরু করলেন। নদীতীরে বাঁশঝাড়ে তালাবন্ধ সাইকেল রেখে প্যান্ট, স্টেথো পুঁটলিতে বেঁধে মাথায় নিলেন। গামছা পরে পার হলেন হাঁটুজলের কিশোরী নদী। বর্ষা এলে এই কিশোরীই যুবতী হয়ে ওঠে। একই অঙ্গে কতো রূপ! রোগীর উঠোনে পা রাখতে রাখতে চাঁদের হাসি বাঁধ ভাঙলো। পূর্ণিমার আলো গায়ে মাখছে ঝিঁঝিঁ পোকারা। বারান্দায় বসে ইকিরমিকির খেলছে দুই কিশোর। একটিবার ওদের দিকে তাকিয়ে কিশোর পাঁচুকে স্মরণ করে ঘরে ঢুকলেন বর্তমানের জ্ঞানী পাঁচু ডাক্তার। ডাক্তারবাবুকে দেখেই ঘোমটায় কপাল পর্যন্ত ঢাকা বৌটি এসে রোগীর খাটিয়ার সামনে প্রায় বিনা শব্দে কাঠের টুল রাখলেন। বসতে বললেন বাড়ির পুরুষ সদস্য। এবার ডাক্তারবাবু রোগীর পালস্ রেট পর্যবেক্ষণ করে, স্টেথো লাগিয়ে, বিভিন্ন স্টাইলে আঙুল চালিয়ে বুক পরীক্ষা করে বললেন-
— বুকে কফ জমেছে। দিনে ক’টা বিড়ি ফোঁকেন?
কাশতে কাশতে রোগীর উত্তর-
— আজ্ঞে বেশি না।
— সেটা তো বুঝতেই পারছি। পরিশ্রমের কাজ করলেই হাঁপানি বাড়ে, তাই না?
— আগে সারা দুপুর কোদালি করতাম। এখন দু’হাত জমি কোদালি করলেই বুক ধড়ফড় করে।
— শ্বাসকষ্ট, সাথে শুকনো কাশি। শ্বাস-প্রশ্বাসের সময় বাঁশির মতো সাঁ সাঁ শব্দ। হঠাৎ দমবন্ধ হয়ে আসে, তাই তো?
— হুম।
কাগজে লিখছেন পাঁচু ডাক্তার।
— নকুল দাশ। বয়স- ৫৭। রোগ- হাঁপানি।
এবার ওষুধের পালা।
ইনহেলার, খুব প্রয়োজনে লিখিত ইনজেকশন আর অতি অবশ্যই পলিবিয়ন। দু’চামচ করে দিনে দু’বার।
সাবধানতা–
— বিড়ি ফোঁকা বন্ধ করতে হবে। বাড়িতে তো বেড়ালের অভাব নেই দেখছি! এগুলোকে বিদায় দিতে হবে।
উঠোন, বারান্দা, এ-ঘর মিলিয়ে ডাক্তারবাবুর নজরে পড়েছে পাঁচটি ভিন্ন স্বাস্থ্য, রঙের পুশিক্যাট। তবে ব্ল্যাক বিউটি একটাও চোখে পড়েনি। ওনার সোনাদা’র বাগানবাড়িতে ছিল একটা। রোববার গল্প দাদুর আসরে নাতিদ্বয়– সোহাগ-সানাইকে বলেছিলেন গল্পটা। ওদের এই রকম রঙের কারণ হচ্ছে মেলানিনের সারপ্লাস নামে পিগমেন্ট। এদের এই অবস্থাকে বলে ‘মেলানিস্টিক।’
রোগী ভদ্দরলোক বললেন-
— অনেকদিন ধরেই আছে। পরিবারের লোকেদের মতো। কোনো অশান্তি করে না জানেন! চুরি-চামারি, ঝগড়াঝাটি সব পাশের বাড়িতে গিয়ে করে। এজন্য অবশ্য পাড়ার শত্তুরগুলোর কু-কথা প্রায়ই শুনতে হয়। বুকনের পিসি তো একদিন ঝাঁটা নিয়ে এসেছিল আমার বড়ো বৌমাকে ঝারতে। সে কী কাণ্ড! পাড়ার সবাই মাধবীলতা, পেয়ারা, নিম গাছের তলায় জড়ো হয়েছিল সেই দৃশ্য দেখতে। আসলে ওরা দেখতে চাইছিল, কে জেতে-কে হারে। জিতেছিল অবশ্য আমার বৌমা ই। ওর মতো মুখরা মেয়ে আপনি আর খুঁজে পাবেন না।
— আচ্ছা হয়েছে, হয়েছে। আর কথা বলতে হবে না।
— না, না, কিচ্ছু হবে না। সবাই বলে আপনি নাকি ধন্বন্তরী। আপনার ছোঁয়া পেয়েই নিজেকে আধা সুস্থ মনে হচ্ছে।
চিনামাটির ছালবাকল খসে পড়া কাপে চা নিয়ে এলেন এক বয়স্কা। দেখে মনে হচ্ছে রোগীর সহধর্মিনী। জর্দার গন্ধে ঘরটা ম ম করছে। কোনও রকম নেশায় আসক্তি নেই পাঁচু ডাক্তারের। একটা ছাড়া! বিনা ডিগ্রিতে রোগীর নাড়ী টেপার নেশা। ভর্তি পেয়ালায় এক চুমুক দিতেই অন্নপ্রাশনে ওনার বিলেতি মামা অতিন্দ্র দাশগুপ্তের হাতে আদরমাখা পায়েস উগড়ে আসছিল। রোগী দেখতে গিয়ে এককাপ চা ডাক্তারবাবুকে খেতেই হয়। তবে বিদঘুটে স্বাদের চা-তালিকায় একে উনি প্রথম স্থানেই রাখবেন। হ্যাজাক বাতির হৃষ্টপুষ্ট আলোয় ডাক্তারবাবুকে নদী পার করিয়ে সাইকেল পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেলো রোগীর দুই ছেলে। বাড়ি ফিরে কলে হাত-মুখ ধুয়ে বারান্দায় দড়িতে ঝোলানো গামছা দিয়ে হাত-পা শুকনো করে ঘরে ঢুকলেন ডাক্তারবাবু। দাদুর ফেরার অপেক্ষায় চোখে সরষের তেল দিয়ে বসে আছে নাতি। জল খেয়ে নাতির পাশে বিছানায় বসলেন দাদু।
— কী করছে আমার সোহাগ ভাই?
সোহাগ করেই দাদু নাতির নাম রেখেছেন সোহাগ।
— গল্প শুনবো বলে বসে আছি।
এটা সোহাগের রোজকার রুটিনের অন্তর্ভুক্ত। এর সাথে রোববারের একঘন্টা বোনাস। রাতে দাদুর কাছ থেকে গল্প শুনে তারপর ঘুমপরীর রুপোলি ডানায় ভর করে ঘুমের দেশে পাড়ি দেওয়া। ক্লাস ফোরে আর কতো পড়া যায়! সোহাগের দাদা সানাই রাতে খেয়েদেয়ে সবাই ঘুমিয়ে পড়লেও বই নিয়ে বসে থাকে। দাদু বলেছে, বছরে একঘন্টা করে সময়ের বয়স বাড়ে। ক্লাস ফাইভের দু’ঘন্টা নাইনে ছ’ঘন্টা হয়েছে। এভাবেই চলবে সময়ের গতি। দাদুকে জিজ্ঞেস করলো সোহাগ-
— গল্প শোনাবে না?
নিয়ম ভাঙার সাহস নেই দাদুর। শুরু করলেন-
— আজকে অন্যরকম একটা গল্প বলবো তোমায়। গল্প হলেও সত্যি।
— বলো, বলো।
কবি সুকান্তের পরিচিত ছবির মতো গালে হাত দিয়ে মনোযোগ সহকারে শুনতে লাগলো দাদুর গল্প হলেও সত্যি ঘটনা।
— হ্যাজাক বাতি দেখেছো কখনও?
অবাক নাতি। এটা আবার কী! কোন বাতি! বেকায়দায় পড়েছে নাতি। বুঝে, মনে মনে হাসলেন দাদু।
— দেখেছো, এখন মনে পড়ছে না। তুমি তখন বালোয়ারির মেঝেতে চাটাই পেতে অ, আ, ক, খ আর সংখ্যার সাথে পরিচিত হচ্ছিলে। আমরা সতি পিসির নাতনির বিয়েতে গিয়েছিলাম। সেখানে বিদ্যুতের খুঁটি দেখতে পাইনি কোথাও। হ্যাজাক বাতি জ্বালিয়ে বিয়ে বাড়ি আলো করা হয়েছিল। সেই হ্যাজাকের গল্পই শোনাব আজ।
কৌতূহল, অপরিচিতকে পরিচিত করার খুশিতে সোহাগের মন ফড়িং-এর মতো ছটফট করছে।
— আমাদের দেশের নাম কী বলো তো?
এতো জলের মতো সরল প্রশ্ন করলে কে না উত্তর দিতে পারবে? ওদের ক্লাসে পেছনের বেঞ্চে বসা, স্কুল কামাই করা বিপিনবিহারীও পারবে। ফটাস করে বললো-
— ভারতবর্ষ।
— হুম। জার্মানি নামে একটি দেশ আছে। সেখানকার ম্যাক্স গ্রেটজ ১৯১০ সালে হ্যাজাক বাতি আবিষ্কার করেন। একে পেট্রোম্যাক্স ল্যাম্পও বলা হয়। স্প্রিট বাতির ওপর ভিত্তি করেই এই বাতিটির নাম দেন। উনি প্যারাফিন বা কেরোসিন তেল দিয়ে সৃষ্টি একটা লাইটিং সিস্টেম চেয়েছিলেন। গবেষণা করে এমন একটা প্রক্রিয়া আবিষ্কার করেন যেটাতে প্যারফিন থেকে গ্যাস তৈরি করা যায় এবং যা খুব গরম নীল শিখা তৈরি করতে পারে। এরপর তিনি একটা চাপ বাতির ডিজাইন করেন যা বাষ্পীভূত প্যারাফিন এর সঙ্গে কাজ করে। একসময় এই বাতির ব্যবহার সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পরে। সিলভার বা পিতল দিয়ে তৈরি করা হয় হ্যাজাক বাতি।
— খুব ভারি হয় নাকি গো?
— ওজন দুই থেকে আড়াই কেজির মতো।
— আলো জ্বালাতে কি পেট্রোল ভরতে হয়?
— না না। কেরোসিন। নির্দিষ্ট সময় পর পর পাম্প করতে হয়। বাতির নিচের দিকে তেল ধারণ করার জন্য আছে ট্যাংকার। বাতিটা জ্বালানোর আগে এতে তেল ভরতে হয়।
— কতো লিটার?
— সবচেয়ে বেশি সোয়া লিটার। ওপরের দিকে বার্নার, মেন্টেল হোল্ডার, ভ্যাপারাইজিং চেম্বার। ট্যাংকার থেকে একটা নল যুক্ত থাকে ভ্যাপারাইজিং চেম্বার এর সাথে।বাতিটা জ্বালানোর সময় প্রথম ভিতরে আগুন জ্বালিয়ে কিছু সময় ধরে বার্নার এবং ভ্যাপারাইজিং চেম্বার গরম করতে হয়। এরপর ট্যাংকার থেকে বায়ুর চাপসহ তেল নল দিয়ে ভ্যাপারাইজিং চেম্বারে পাঠানো হয়। তখন উত্তপ্ত বার্নারের সংস্পর্শে এসে এক ধরনের গ্যাস তৈরি হয় যা মেন্টেলকে জ্বালাতে সাহায্য করে। এতে করে খুব উজ্জ্বল আলো পাওয়া যায়। একটা মেন্টেল একবারই ব্যবহার করা যায়। তবে অনেকে আবার মেন্টেলকে ব্যালেন্টারও বলে। ট্যাংকারে ভরা তেল থাকলে একটানা ৮ ঘণ্টা জ্বলে বাতি। তবে মাঝে মাঝে পাম্প করে বায়ুর চাপ বাড়াতে হয়। একবার পাম্প করা হলে একটানা তিন ঘণ্টা চলে। তবে বায়ুর চাপ কমে এলে আলো’র দম ফুরিয়ে আসে। কাঁচ দিয়ে ঘেরাও করা একটা খাঁচা ব্যবহার করা হয় যাতে করে বাইরের বায়ু ভিতরে প্রবেশ করতে না পারে।
এবার নাতির জিজ্ঞাসা–
— আমাদের বাড়িতে হ্যাজাক বাতি ছিল?
— আমার মামাবাড়িতে ছিল। একবার রামায়ণ পালা দেখতে যাই মামাদের সাথে। বাল্মীকির আশ্রমে সন্ধেবেলা তুলসীতলায় বসে আছেন সীতাদেবী।
— লব-কুশের মা?
— হুম। অযোধ্যার রাজা রামচন্দ্রের সহধর্মিনী।
— সহধর্মিনী মানে?
— বউ, বউ।
— ওঃ।
— ঘটি-বাটি ছেড়ে পাতালে এসে স্বাভাবিকভাবেই মন খারাপের আকাশে কালো মেঘ গাঢ় হয়ে উঠছিল তাঁর।
— পাতাল থেকে আকাশ দ্যাখা যায়?
উফ্, হঠাত্ হঠাত্ নাতির কৌতূহলে দাদুর বিষম খেতে হয়।
— যায়, যায়।
সংক্ষেপে জিজ্ঞাসাকে ভাঁজ করে চলে এলেন রামায়ণ পালায়।
— তারপর শোনো। এরমধ্যে লব-কুশের দুরন্তপনায় শীতল সীতাদেবীও গরম হয়ে উঠছেন।
— খুব দুষ্টুমি করতো? আমাদের লবদা’র মতো?
— কোথায় রাজার কুমার আর কোথায় খচ্চর কুমার! ধুর, কার সাথে কার তুলনা! হঠাত্ দেখলাম এতো মনখারাপ করা দৃশ্যেও সবাই হাসছে। কিন্তু কেন?
পাঁচু ডাক্তার মোটেও এটা ভাবছিলেন না। কারন উনি নিজেও ছিলেন ওই দলেরই একজন। ভাবছিলেন পালার নায়ক ওনার মেজদা লক্ষ্মণ দাশ। রামচন্দ্রের ভূমিকায় স্টেজের পাশেই বেঞ্চে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন এই অবাক করা কাণ্ড। সোহাগেরও প্রশ্ন–
— সত্যি তো, ওরা হাসছিল কেন গো?
দাদু’র উত্তর–
— কাঁদতে কাঁদতে সীতাদেবীর খেয়াল ছিল না কখন মাথা থেকে আঁচল খসে পড়েছে, সঙ্গে লম্বা চুল গড়াচ্ছে মঞ্চের ওপর। সবাই সীতাদেবীর পরিচয় বুঝতে পেরে চিৎকার করে বললো-‘ বগলা রে, এইবার তুই ন্যাইমা পড়। আর কাইন্দ্যা বুক ভাসান লাগতো না।’
সোহাগও হেসে উঠলো প্রাণ খুলে। ঠাকমা এসে বললেন-
— ছাড়ান দাও। ছাড়ান দাও। সক্কাল সক্কাল ইস্কুল যাইতে হইবো পোলাডারে। দাদু, মা ডাকে, যাও। আবার কাইল গল্প শুইন্যো।
ফাগুনের মাঝামাঝি। আজ যে পথে সাইকেল চালিয়ে রোগী দেখার জন্য যাত্রা করছেন পাঁচু ডাক্তার, সে পথ ওনার বড্ড চেনা। চেনা এখানকার নীল আকাশ আর পলাশের আগুন শিখা৷ সঙ্গে মহুয়া আর মাদলের নেশা। শিমূল, পলাশের সঙ্গে শাল-কুসুমের কচিপাতার স্বাদ পেতে এসময়টায় আকাশও বড্ড বেহায়াপনা করে! বাঘমুণ্ডির বামনি ফলস্, এর পাশে লহরিয়া বাঁধ৷ ওখানেই রোগীর বাড়ি। সাইকেল উঠোনে স্ট্যান্ড করে ডাক্তারবাবু তাকাচ্ছেন ইতিউতি। পশ্চিমের ঘরের চাল বেয়ে পানি লাউয়ের সুজলা-সুফলা সংসার। উঠোনের দক্ষিণ দিকে চালকুমড়ো, মিঠাকুমড়ো ঢকঢক করে পান করছে এ বাড়ির মৃত্তিকা রস। অপরিচিতকে দেখে বারান্দা থেকে মাকে হাঁক পারলো কিশোর। একচালা একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন পাঁচু ডাক্তারের মেয়ে তনু’র কাছাকাছি বয়সের এঁয়োস্ত্রী। জানতে চাইলেন-
— কোথা লে আসছেন?
— কুশলডি।
— ডাক্তর?
— হুম। রোগী কোথায়?
বারান্দায় দাঁড়িয়ে কিশোর দেখছিল নতুন মানুষটাকে। মায়ের ডাকে এসে দাঁড়ালো ডাক্তারের সামনে। ডাক্তারবাবু বুঝতে পারলেন, এরই সমস্যা। জিজ্ঞেস করলেন-
— নাম কী ওর? কোথায় সমস্যা?
উদ্বিগ্ন মা বললেন-
— লরেন। উহার গটা শরীলে দরদ আইজ্ঞা। বই গুল্যা সব তাক্যা তুইল্যা। একটোই কেলাসে পড়্যে আছে পাশ হইনাই আর। ল্যাইচত্যা হামার পিথীবিট তিতা লাগে।
মিনিট পাঁচেকের কথোপোকথনে পিকচার ক্লিয়ার হো গয়া। ডাক্তারবাবু বুঝলেন, রোগটা দুজনেরই মনের। লেখাপড়া থেকে ছেলের মন উড়ান দিয়েছে। অথচ মায়ের মনে হচ্ছে নিশ্চয়ই ছেলের কোনও অসুখ হয়েছে যার জন্য ও পড়তে চায় না। সারা শরীরে শুধু বিষব্যথা। হুম, সত্যিই কঠিন অসুখ। রোগীর সাথে কথা বলে বুঝতে পারলেন ডাক্তারবাবু, লেখাপড়া ছাড়া আর সব কিছুতেই পারদর্শী ছেলে। গাছে ওঠা, নদী থেকে মাছ ধরা, কবাডি, গোল্লাছুট ইত্যাদি ইত্যাদি। ডাক্তারবাবু আগেই বলেছিলেন, রোগী দেখার সময় কেউ যেন এ ঘরে না আসে। কথা রেখেছে পরিজন। ডাক্তারকে বন্ধু ভাবছে রোগী। এর কাছে বলতে বাধা নেই মনের কথা, স্থির করলো নরেন।
— পরব বাইদের জমি ট তে ইবার বড় ধান জন্মেছো ব ।
সোনার বন্ন ধান ভ্যালে দেইখলে চোখ থির‍্যায়। ইঁয়া গাছা গাছা ডাগর ডাগর শীষ গিল্যান হাওয়ায় লড়ছো। দেইখলে বুকটো সুর সুরায়।
ডাক্তারবাবু জানতে চাইলেন–
— পরব কে?
— গাঁয়ের মড়লর লাতি। হামার সংগে লাইচ করে।
— তুই নাচ করিস?
— হ।
— কী নাচ?
— পালা ছো।
— তবে তো তুই খুব গুণী ছেলে। লেখাপড়া করিস না বলেই সমস্যাটা হচ্ছে। অনেকক্ষণ যাবত্ নাচ করিস বলেই গায়ে ব্যথা হচ্ছে। কিন্তু তোর মা তো চায় তুই লেখাপড়া করিস।
অসহায় হয়ে জানায় কিশোর–
— কিন্তুক লাচ থামছ্যে নাইখ। ও হামার পেরান।
লাচের সংগে ব্যাঁধে লিয়েছে মনটাকো।
ডাক্তারবাবু উঠোনে দাঁড়িয়ে বললেন রোগীর মা-কে, টেবিলের ওপর একটা কাগজে লিখে দিয়েছি ওষুধের নাম। কাউকে দিয়ে আনিয়ে নিয়ো– পলিবিয়ন। শুধু ওটা খেলেই হবে।
দৌড়োতে দৌড়োতে আসছে শম্ভু। সবাই বলে মুরগি শম্ভু। নিন্দুকে যাই বলুক না কেন, ছেলেটা খুব কর্মঠ। মুরগির ব্যবসা করে খড়ের চাল সরিয়ে ইট, বালি, সিমেন্ট লাগিয়েছে। দুই বোন- কে পাত্রস্থ করেছে। ওর বিশ্বাস, মানুষের মতো বুদ্ধির জাহাজের রোগ সারাতে পারেন যিনি, পক্ষীর রোগ সারানো তার বাঁয়ে হাত কা খেল। ডাক্তারবাবু- কে দোকানে দেখে ও শান্তি পেলো।
— কী হয়েছে, হাঁপাচ্ছিস কেন? বস, এখানে বস।
কাঠের টুলটা এগিয়ে দিলেন পাঁচু ডাক্তার।
— এক্ষুণি চলুন আমাদের বাড়ি।
— কেন রে, কার কী হলো আবার?
— আমার মুরগিদের।
— মুরগির! আমি তো পশু-পাখির ডাক্তার নই।
— ওসব বুঝি না। আপনি ধন্বন্তরী। যাকে একবার ছুঁয়ে দেবেন সেই বেঁচে যাবে।
প্রকাশ না করলেও মনে মনে খুশি হলেন বটে।
— ঠিক আছে চল, দেখি কী হয়েছে।
দোকানের দায়িত্ব পাশের দোকানের নাড়ু- কে দিয়ে সাইকেল নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন ডাক্তারবাবু। সামনে বসালেন শম্ভু- কে। রাণীক্ষেত রোগে পাশের গাঁয়েও রোজ রোজ মুরগি মারা যাচ্ছে। বাজার থেকে কেউ মুরগির মাংস কিনতে চাইছে না। প্রথম হলদেটে পাতলা পায়খানা, শ্বাসকষ্ট, সর্দি-কাশি তারপর ঝিমুনি। পুঙ্খানুপুঙ্খ পর্যবেক্ষণের পর সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন পাঁচু ডাক্তার।
— শোন শম্ভু, এ মারাত্মক রোগ, ছোঁয়াচে। ভাইরাস আক্রমণ করেছে ওদের। এই মুরগিগুলোকে অন্যদের থেকে আলাদা কর। এদের থাকার জায়গা, জলের গামলা সব পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখবি।
— আর ওষুধ?
— ওষুধ বলতে অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়াতে হবে। এখন শুধু এক গামলা জলে বড়ো চামচে ছয় চামচ এই ওষুধটা খাওয়াবি। আমি লিখে দিচ্ছি। কোরা কাগজ অর কোরা নেহি রহা, জ্বলজ্বল করছে– পলিবিয়ন।
এরপর থেকেই তো পাঁচু ডাক্তার আর পরিচিত থাকতে পারলেন না ঠাকুরদার দেওয়া সাধের নামে। মানুষ-পক্ষী-প্রকৃতি, সবার পলিবিয়ন।
ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।