গল্পেরা জোনাকি তে মধুপর্ণা বসু

ফেরা

দেবীকা, আজ অন্যদিনের থেকে অনেক তাড়াতাড়ি উঠে অনিকেতের ব্রেকফাস্ট বানিয়ে ফেলেছে। আসলে গতরাতে একদম ঘুম হয়েনি ঠিকঠাক,আজকাল আর ওই ছাই ভস্ম  আ্যলজোলাম কাজ করেনা, দূর! যাইহোক অনিকে সেটা বুঝতে দেয়না দেবী। দীর্ঘ কুড়ি বছর পর দুজনে পৈতৃক বাড়ি ছেড়ে মাঝেমধ্যে এই বাবিনের কেনা, নিউটাউনের ফ্ল্যাটে এসে…. অবকাশ যাপন আর কি? এও এক নতুন পরিবেশ,  একটা ছোট দেশ যেন। সারি সারি গাছ গাছালী সুসজ্জিত জগার্স  ট্র‍্যাক, পুল সাইড লন, পাম গাছে সাজানো আধুনিক আবাসন।
এর মধ্যেই প্রয়োজনীয় সব জিনিসের সুপার মার্কেট আরও কতকি?
কখনো দেবী ভাবেইনি তাদের জীবনে এরকম বিলাসিতা আসবে কোনদিনও। বাবিনের এসব স্বপ্ন ছিল। আর সেগুলো সে দেবীদের কাছে গচ্ছিত রেখে গেছে।
এখন আর কাজ কি, একটানা নিরবচ্ছিন্ন অবকাশই তো।
          তাও আজ প্রায় একমাস ধরে দুজনের মধ্যে আশ্চর্য একটা প্রাণ এসেছে যেন, অলিন্দদ্বয়  অতিরিক্ত কর্তব্যরত হয়ে উঠেছে, দুজনেই অদ্ভুত তৎপরতায় এই ফ্ল্যাটের সবকিছু টিপটপ করে তুলতে উঠে পড়ে লেগেছে। হ্যাঁ, একটাই কারণ, একটা লম্বা বুকভাঙা অপেক্ষার পালা শেষ করে বাবিন আসছে…
ভারতে মানে দেশে ফিরছে বাবিন।কলকাতায়, তাদের এই ফ্ল্যাটে, শুধু তাই নয়, বউমা কেটি আর নাতিনাতনি অনিরুদ্ধ আর অনসূয়াকে নিয়ে। কি যে হচ্ছে তাদের দুজনের মনের মধ্যে সে শুধু তারা দুজনে দুজনের দিকে নীরবে চেয়ে বুঝিয়ে দেয়।
ব্রেকফাস্ট টেবিলে অনিকেত জিজ্ঞেস করে,” কটায় ল্যান্ডিং? বিকেল পাঁচটা, না?”
দেবী বলে,” সবই তো মুখস্থ, আবার জিজ্ঞেস করা কেন?”
“একমাস ধরে তো ওই মালাই জপ করছো দিনরাত। ” দেবী বলে যায় আবার,” আর বারবার বলছি অনি, বেশী উত্তেজিত হয়োনা।  ওরা ইংল্যান্ডে জন্মেছে, বড় হচ্ছে, আদবকেতা সব ব্রিটিশই হবে, আর বাঙলা কি করে বুঝবে? শেখাবার কেউ আছে? বলো? বাবিন নিজেই ভুলতে বসেছে কিনা কে জানে, তার ওপর ব্রিটিশ বউমা….
এসব নিয়ে এতো চিন্তা কোরোনা, এতো দিন পর যে আসছে সপরিবারে এইই আমাদের ভাগ্য।”
             কে শোনে কার কথা! অনিকেতের তাও আশা, ” একটুও জানবেনা দেশের কথা, বাবিনকে তো আমরা কখনো এ্যাংলো করে মানুষ করিনি, ও রীতিমতো বাঙলা গান, গল্পের বই, এমনকি রবিঠাকুরের গানও শুনতো।তার ছেলেমেয়ে কি? “
অনি চোখে একটা চকচকে আলো জ্বেলে বলতে লাগলো,
“আমাদের বাবিন সেসব ভুলে যাবে? বাঙালি আদবকেতা বাঙালী খাওয়া পোস্ত পাবদা মাছ। কলকাতার স্ট্রিট ফুড,  নন্দন অ্যাকাডেমি। ওর তো আবার সাউথসিটি এ্যাক্রোপলিস ছিল আড্ডা জোন। সব কি ভুলে গেছে ও?” দেবী ওকে থামিয়ে বলে উঠলো-
” উফফ, সেই ছেলেই তো তোমার বিদেশিনী বিয়ে করলো।”
ফিরে গেল দেবী সেইসব টালমাটাল দিনে।প্রথম যখন ছেলে জানালো বিয়ের কথা মাথায় বাজ ভেঙে পড়েছিল। কোন নিয়ম রীতি না মেনে দেশের বাইরে দুম করে ব্রিটিশ মেয়ে বিয়ে করে বসলো। একবছর আমরা একটা ট্রমার মধ্যে ছিল সে আর অনিকেত। বিয়ে করে এলো না পর্যন্ত! বললো জাস্ট কোর্ট ম্যারেজ করে যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। তারপর আস্তে আস্তে স্কাইপে দেখাশোনা কথা শুরু হল। দিন যেতে যেতে জানতে পারলো কেটির স্বভাব, চরিত্র, ভারতের প্রতি টান, ভালোবাসা।
একবছর পরে সাতদিনের ঝটিকা সফরে এলো দুজনে। তখন জোর করে তারা বাঙালী রীতি মেনে একটা বিয়ের অনুষ্ঠান করেছিল।
বাঙালী রীতি মেনে বিয়েতে কেটির উৎসাহ দেখে গলে গিয়েছিল অনি। কিন্তু, কিন্তু তারপর? দেবী হঠাৎ যেন সম্বিত ফিরে বলে ফেললো,  ” এই দশ বছর, আর এদেশ মুখো হল? বলো? দু দুটো বাচ্ছা হয়ে গেল, তাও এতো দিনে মনে হয়েছে? “
অনির কপালের ভাঁজ, দেবীর চোখ এড়ায়নি। দেবী না বলে থাকতে পারলো না, ” আমিও তো তাই ভাবছ মাঝে,মাঝে কেন? কি জন্যে হঠাৎ এই আসা? আবার একেবারে তিন বছরের জন্যে? চাকরি থেকে এতো দিনের জন্য ট্রান্সফার? না, এতো সহজ নয়। কেন? কোন কি অসুবিধা?ওখানে কোন সমস্যা? “
অনিকেত দেবীকে থামিয়ে,” তুমি থামোতো, এসব নিয়ে চর্চার অনেক সময় পাবে।কাজ সারো, চারটেএ বেরোবো। আজ নিজেই ড্রাইভ করতে ইচ্ছে করছে “
” না একদম না,” দেবী সাবধান করে, “এই আনন্দে, উত্তেজনায় নিজে ড্রাইভ, অসম্ভব। তপন এসে বসে আছে।”


বেশ ঘন্টা খানেক হল, দমদম বিমানবন্দরে ইন্টারন্যাশনাল অ্যারাইভালের  লাউঞ্জের সামনে বাইরে দেবীকা আর অনিকেত চেয়ারে বসে। অপেক্ষা অপেক্ষা….
দীর্ঘ দশ বছরের অপেক্ষায় আজ তাদের একমাত্র ছেলে অনির্বাণ মানে তাদের বাবিন, বিদেশিনী বউ ছেলেমেয়ে নিয়ে দেশে ফিরছে। এই সময়টা যে কি ভাবে, কি মানসিক চাপে, তাদের কি ভাবে কেটেছে সে শুধু তারাই জানে। অনিকেত অনেকদিনই ব্যবসার কাজ কমিয়ে দিয়েছে, এই বাহাত্তরে আর কি এত চাপ পোশায়? এখন বেশির ভাগ ওই কনসালটেন্সি করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে। আর দেবী তার বাড়ি, নারী সমিতি, লেখালেখি, বাগান, এসব নিয়ে,  কিন্তু কিযে এক অসহায় একাকীত্ব, কি করে যে দুজনকে আর্ধেক গিলে রাখে, সে কি দুজনেই জানেনা? শুধু আশা, আর দুরাশা, কখনো বাবিন আসবে।
         আজ সেই দিন তাদের চোখের সামনে, দেবী তো মনের মধ্যে কেঁদেই ফেলছে। বিজ্ঞানের দৌলতে, ছেলের সাথে কথা, স্কাইপে, দেখাশোনা, বউমার সাথেও কথা হয়, নাতিনাতনির ছবি, ভিডিও, তাদের বড় হওয়া সবই দুজনের সারাক্ষণের চলচ্চিত্র। বাচ্ছাগুলোর আদো আদো কথা, স্কুলের ছবি, ওদের হাতের লেখা, জন্মদিনের ভিডিও দেখে দুজনের চোখে জল এসে যায়।
আর শুধু শোনে তারা আসবে কোন এক দিন। এই করে করে দশ বছর।
         তারপর হঠাৎ ছেলের দেওয়া এই অভাবনীয় খবর, স্কাইপে দুজনেই একসাথে বসে ছিল। ছেলে অনেক ভনিতা করে বলে, ” বেশী উত্তেজিত হবেনা, এখন শরীর ঠিক রাখবে” —
এসব বলে কয়ে জানালো, সে তিন বছরের জন্যে ভারতে ফিরছে। আর পরিবার সমেত কারণ তাদের দুজনেরই নাকি ইচ্ছে ছেলে মেয়েরা তাদের মাতৃভূমিতে কিছু দিন থেকে ভারতীয় শিক্ষা, সংস্কৃতি জানবে, বুঝবে। প্রথমে দেবী, অনির বিশ্বাসই হয়নি, তারপর লাগাতার দুমাস ধরে তাদের অনেক প্ল্যান , জল্পনা কল্পনা, ইচ্ছে সব শুনে, এখানে ইন্টারন্যাশানাল স্কুলে ছেলেমেয়ের ভর্তির ব্যবস্থাও হয়ে গেল। বাপ আর ছেলে মিলে মেল চালাচালি করে সব ঠিক করলো আর আশ্চর্যের যে কেটির এতে কোন মতামতই দেখা গেলনা। আর অবশেষে আজ, দেবী আর অনি, তাদের ছেলের অপেক্ষায়, তাদের উত্তরাধীকারীদের দেখার জন্য অধীর আগ্রহে বসে।


     
ফ্লাইট এসে গেছে, বোর্ডের ওপর সবুজ আলোয় অ্যারাইভাল কথাটা দেখে  দুজনেই দাঁড়িয়ে পড়লো। দেবী অনির হাতটা জড়িয়ে ধরে যেন বলতে চাইলো, অপেক্ষা করো। বেশী ব্যস্ত হয়োনা। বাবিনের ফোন এলো। লাগেজের জন্যে অপেক্ষা করতে হবে অনেকক্ষণ। অনিকেত উঠে দাঁড়িয়ে পায়চারী করছে, দেবী দরজার দিকে ঠায় তাকিয়ে…
উফফফ, উত্তেজনায় যেন হাতপা কাঁপছে। এক একটা মিনিট যেন এক এক ঘন্টা…
        প্রায় আধঘন্টা পর গেটের সামনে দেখা গেল বাবিনের মুখ। হেঁটে আসছে বাবিন, পাশে কেটি সাথে সাত বছরের অনিরুদ্ধ, আর বছর চারেকের অনসূয়া। দুচোখ কে যেন বিশ্বাস করতে পারছেনা তারা। ছেলে পরিবার সমেত দেশে ফিরছে। কেটির পরনে জিন্স, টপ জ্যাকেট, বাচ্ছাদুটো… কি সুন্দর, কি সুন্দর,  কিন্তু এই যা, মায়ের গায়ের রঙ। তবে মেয়ের সাথে বাবিনের মিল। নাতিকে তার মায়ের মতই দেখতে, চুলগুলো ভারতীয় বাদামী রঙ। এসব দেবীর চোখ এড়াচ্ছেনা। এবার তারা সামনে এসে দাঁড়ালো। দেবী চোখের জল মুছতেও ভুলে গেলো।
অনিকেত কিছু বলার আগেই, কেটি দুম করে মাথা নিচু করে অনির পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো, তারপর যথারীতি দেবীকে,
একি! এতো তাদের অবাক হওয়ার পালা!  আর সব্বাই কে হতচকিত করে, তাদের ছেলেমেয়ে মায়ের অনুসরণ করে ফেললো, দেবী হাঁইমাঁই করে তাদের জড়িয়ে ধরার চেষ্টা করতেই বাবিন মাকে জড়িয়ে তাকে থামিয়ে দিয়ে বললো, ” না মা, ওদের কর‍তে দাও। দেখি আমিও আমার ছেলে মেয়ের মধ্যে আমার দেশকে দেখতে পাই কিনা।” দেবী ছেলের দিকে তাকালো অসহায় ভাবে, কেটি অনিকে প্রশ্ন করলো, ” বাবা, কেমন আছো, আমি ভীষণ সরি, এটোডিন, আস্টে পারে নাই।” অনি জানতো কেটি বাঙলা বলে, আজ চোখের সামনে শুনে কেমন যেন বাকরুদ্ধ হয়ে গেল।
       চমকের ঘোর কাটার আগেই, নাতি অনিরুদ্ধ যার ডাকনাম টিটো, দাদুর দিকে হাত বাড়িয়ে ভাঙা বাঙলায়, ” ডাডু, আমি টিটো, টোমার ড্রাইভিং এর কঠা বাবা বলে, আমি টোমার সাঠে ড্রাইভে যাবে।” নিজের কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছেনা আবার অনি। এ কী শুনছে, নাতি তার বাঙলা বলছে, তার সাথে ড্রাইভে যাবে? অনি আর থাকতে পারলো না, চোখের জলে ঝাপসা হয়ে এলো চশমার কাঁচ। বাবিন দেবীকে জড়িয়ে ধরে বললো, “এতো বছর ধরে, জন্মের পর থেকেই ওদের সাথে বাঙলায় কথা বলতাম, কেটিকে সব বাঙলা শিখিয়েছি আমি। আমাদের ওখানে পুজো, পয়লা বৈশাখ, এসব অনুষ্ঠানে কেটির শাড়ি পড়া আর বাঙলায় কথা শুনে সবাই আমাকে বিগ হ্যান্ড দেয়, বুঝলে? তোমাদের নাতিনাতনি কে বাকি বাঙলাটা শিখিয়ে দেবার দায়িত্ব কিন্তু এবার তোমাদের।”    
         দেবী কোন কথা বলতে পারছে না। অবাক হয়ে ছেলের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। বাবিন মায়ের মনের অবস্থাটা বুঝে তাড়াতাড়ি বললো, ” আশ্চর্য, এতো হাঁ করার কি আছে? তোমরা কি ভেবেছিলে, আমি ট্যাশ বিয়ে করেছি বলে নিজেও ট্যাশ হয়ে ফিরবো। আসলে ওদের বাঙালী করতে একটু টাইম তো লাগবেই, না? তাই তো বেশী কথা বলতে দিতামনা, যাতে পুরো চোস্ত হয়ে দেশে ফেরে।” 
     ততক্ষণে অনিকেতের হাত ধরে ট্রলি ঠেলে নাতি, গাড়ির পার্কিং-এর দিকে যাচ্ছে, আর দেবী শুনছে, দুজনে অনর্গল বাঙলায় কথা বলছে। মেয়েটা আরও একটু ছোট তো। দেবীর হাতটা ধরে মাথা ঝাঁকিয়ে বললো, ” ইউ, থাম্মি? আমি তুনি”। দেবী তাকে জড়িয়ে ধরে কোলে নেওয়ার চেষ্টা করতে কেটি বলে উঠলো, ” না মাম, টুমি পারবেনা, শি ইজ, হেভী। ” দেবী কিছু বলার আগেই ছোট্ট টুনি তার হাত ধরে টেনে বললো, “থাম্মি  চলে চলে, দ্যে হ্যাভ গন, থাম্মি।” 
       ওরা একসাথে গাড়ির কাছে যেতে যেতে দেবী শুনলো, অনিকেত তার নাতিকে বলছে, ” হোয়ার ডু ইউ ওয়ান্ট টু গো, ফর আ লঙ ড্রাইভ? ” নাতি তার সাবলীল বাংলায় উত্তর দিচ্ছে, ” ডাডু, বাবা বলে টুমি ভীষণ ভালো ড্রাইভ করতে। সো, আমরা…. “
         ওরা এগিয়ে যেতে দেবী, কেটির পাশে হাঁটতে হাঁটতে, অনেক পুরনো কিছু ছবি স্মৃতির  সাথে টিটোর কথাগুলো মেলানোর চেষ্টায় একটু আনমনা হয়ে গেল, বাবিনেরও ছোট বেলায় এরকমই গাড়ির নেশা ছিল। কেটি হাতটা ধরে জিজ্ঞেস করলো, ” মাম, আর ইউ ওকে? কি ভাবছো? টুমি কি হ্যাপি মাম? “
কি বলবে দেবী? সে আর অনিকেত কি এতটা আশা করেছিল? তাদের নাতিনাতনি ভারতে ফিরে, বাঙলা বলে তাদের চমকে দেবে? তাদের প্রথম দেখে এইভাবে আপন করে নেবে? তাদের একাকীত্বের বিরতি আসবে এইভাবে, দেবী কি কল্পনা করতে পেরেছিল?


      গাড়ি ছুটছে নিউটাউন, বেশী সময় তো লাগেইনা। তারমধ্যেই, বাবিন একবার শুধু পেছনে তাকিয়ে চোখে টিপে সেই আগের মতো বললো, ” বুঝলে মা, ভুলতে গেলে একমাসেই ভোলা যায়, আর রাখতে চাইলে আজীবন। দেখো ভাই, খুব খারাপ ছেলে বলে বদনাম আমার ছিলনা, তাই বাঙালী হয়েই আছি আর থাকবো। বলে, বাবার কাঁধে হাত দিয়ে বলে উঠলো, ” জিও বাঙালী “।

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।