সাপ্তাহিক ধারাবাহিক প্রবন্ধে মানস চক্রবর্তী – ১৭

শিক্ষক ও শিক্ষকতার গল্প 

এবার আমরা দেবেন্দ্রনাথের শিক্ষাদানের কৌশলটি লক্ষ করব | সাবধানতাবৃত্তির উন্নতিসাধন প্রসঙ্গে জীবনস্মৃতিতে রবীন্দ্রনাথ লিখলেন , “পিতা বোধ করি আমার সাবধানতাবৃত্তির উন্নতি সাধনের জন্য আমার কাছে দুই চারি আনা পয়সা রাখিয়া বলিতেন , হিসাব রাখিতে হইবে |” দায়িত্বে দীক্ষিত করার অভিপ্রায়ে – “আমার প্রতি তাঁহার দামি সোনার ঘড়িটি দম দিবার ভার দিলেন | ইহাতে যে ক্ষতির সম্ভাবনা ছিল সে চিন্তা করিলেন না |”
রবীন্দ্রনাথ তাঁর পিতার শিক্ষা প্রণালীর আর একটি দিক তুলে ধরেছেন | “সকালে যখন বেড়াইতে বাহির হইতেন , আমাকে সঙ্গে লইতেন | পথের মধ্যে ভিক্ষুক দেখিলে , ভিক্ষা দিতে আমাকে আদেশ করিতেন | হয়তো দেবেন্দ্রনাথের মনে হয়েছিল তাতে পুত্রটির অন্তর বিকশিত হবার পথ প্রসারিত হতে পারে |
দেবেন্দ্রনাথ রবীন্দ্রনাথের পড়াশোনার প্রতি সমমাত্রায় মনোযোগী ছিলেন | “ভগবদগীতায় পিতার মনের মতো শ্লোকগুলি চিহ্নিত করা ছিল | সেইগুলি বাংলা অনুবাদ সমেত আমাকে কপি করিতে দিয়াছিলেন |” সম্ভবত বাংলা শেখার জন্য বোধহয় এই ব্যবস্থা | ছোট্ট রবি এতে খুব গর্ব অনুভব করতেন | কারণ তার বিশ্বাস ছিল পিতা তার মতো নগন্য বালকের হাতে গুরুতর কাজের ভার দিয়েছেন |
ইংরেজি শিক্ষার মানসে হিমালয় ভ্রমণকালে দেবেন্দ্রনাথ Peter Parly’s  Tales পর্যায়ের  অনেকগুলি বই নিয়েছিলেন | তার মধ্যে জীবনীগ্রন্থও ছিল | কারণ দেবেন্দ্রনাথের ধারণা ছিল ‘জীবনী’ গল্পের মতো লাগবে এবং পড়ে উপকার হবে | নিজেই পড়ে শোনাতেন | পড়াতে গিয়ে নিজেও বেশ শিক্ষা( অভিজ্ঞতা ) পেতেন এবং অনেক সময় বেশ কড়া সমালোচনাও করতেন | রবীন্দ্রনাথ লিখছেন , “বেঞ্জামিন ফ্রাঙ্কলিন নিতান্তই সুবুদ্ধি মানুষ ছিলেন | তাঁহার হিসাব করা কেজো ধর্মনীতির সংকীর্ণতা আমার পিতাকে  পীড়িত করিত | তিনি এক এক জায়গা পড়াইতে পড়াইতে ফ্রাঙ্কলিনের ঘোরতর সাংসারিক বিজ্ঞতার দৃষ্টান্তে ও উপদেশবাক্যে অত্যন্ত বিরক্ত হইয়া উঠিতেন এবং প্রতিবাদ না করিয়া থাকিতে পারিতেন না | “
ইংরেজি ছাড়া সংস্কৃতও পড়াতেন দেবেন্দ্রনাথ | সংস্কৃত পড়াতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথের ভুলগুলিকে স্নেহের চোখেই দেখতেন | “আমি যাহা পড়িতাম তাহারই শব্দগুলো উলটপালট করিয়া লম্বা লম্বা সমাস গাঁথিয়া যেখানে -সেখানে যথেষ্ট অনুস্বার যোগ করিয়া দেবভাষাকে অপদেবের যোগ্য করিয়া তুলিতাম | কিন্তু পিতা আমার এই অদ্ভুত দুঃসাহসকে একদিনও উপহাস করেন নাই | “
“ইহা ছাড়া তিনি প্রক্টরের লিখিত সরলপাঠ্য ইংরেজি জ্যোতিষ গ্রন্হ হইতে অনেক বিষয় মুখে মুখে আমাকে বুঝাইয়া দিতেন ; আমি তাহা বাংলায় লিখিতাম |”
দেবেন্দ্রনাথ পুত্রের উপর যেমন অধ্যাপনা করতেন , তেমনি নিজেও অধ্যয়ন করতে ভালোবাসতেন | নিজে পড়ার জন্য দশ বারো খণ্ডে বাঁধানো বৃহদাকার ‘The History of the Decline and Fall of the Roman Empire by Edward Gibbon ‘ সঙ্গে নিয়েছিলেন | অবশ্য তা ছোট্ট রবির কাছে দুর্বোধ্য ছিল | “আমি মনে ভাবিতাম , আমাকে দায়ে পড়িয়া অনেক জিনিস পড়িতে হয় , কারণ আমি বালক , আমার উপায় নাই – কিন্তু ইনি তো ইচ্ছা করিলেই না পড়িলেই পারিতেন , তবে এ দুঃখ কেন |”
এই সময়কার রবীন্দ্রনাথের প্রাত্যহিক রুটিনটায় একটু চোখ রাখব | এতে দেবেন্দ্রনাথকে আর একটু চিনতে সুবিধা হবে | রুটিনে যাবার আগে একটু বলে নিই , “এক একদিন , জানি না কত রাত্রে , দেখিতাম , পিতা গায়ে একখানি লাল শাল পরিয়া হাতে একটি মোমবাতির সেজ লইয়া নিঃশব্দ সঞ্চরণে চলিয়াছেন | কাচের আবরণে ঘেরা বাহিরের বারান্দায় বসিয়া উপাসনা করিতে যাইতেছেন |”
রবীন্দ্রনাথকে খুব ভোরে উঠে ‘নরঃ নরৌ নরাঃ’ করতে হতো | “…..পিতা আমাকে ঠেলিয়া জাগাইয়া দিতেছেন | তখনো রাত্রি সম্পূর্ণ দূর হয় নাই | উপক্রমণিকা হইতে ‘নরঃ নরৌ নরাঃ’ মুখস্ত করিবার জন্য আমার সেই সময় নির্দিষ্ট ছিল | শীতের কম্বলরাশির তপ্ত বেষ্টন হইতে বড়ো দুঃখের এই উদ্ বোধন | “
তারপর দেবেন্দ্রনাথ তাঁর নিজস্ব উপাসনা অন্তে একবাটি দুধ খাওয়া শেষ করে পুত্রকে নিয়ে উপনিষদের মন্ত্রপাঠ দ্বারা আবার উপাসনা করতেন | অত্যন্ত শিক্ষণীয় পুত্রকে শিশুবয়স থেকে উপাসনা শেখাচ্ছেন | লক্ষ্যনীয় ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দের ২৫ এপ্রিল দেবেন্দ্রনাথের পত্র | লিখছেন ,” ইহাকে ( রবীন্দ্রনাথকে ) ব্রাহ্মধর্মও পড়াইয়া থাকি |” যথার্থ পিতার কাজ |
তারপর শুরু হতো ভ্রমণ পর্ব | তবে এ পর্ব শেষ হওয়ার পূর্বেই ছোটো রবি ভঙ্গ দিত | জীবনস্মৃতিতে লিখছেন , “তাঁহার সঙ্গে বেড়াইতে আমি পারিব কেন | অনেক বয়স্ক লোকেরও সে সাধ্য ছিল না | আমি পথিমধ্যেই কোনো-একটা জায়গায় ভঙ্গ দিয়া পায়ে চলা পথ বাহিয়া উঠিয়া আমাদের বাড়িতে গিয়া উপস্থিত হইতাম |”
এরপর শুরু হতো পিতার কাছে অধ্যয়নং তপঃ | এই তপস্যা কার্য ঘণ্টা খানেক চলত | অধ্যয়নের বিষয় ছিল ইংরেজি |
তারপর স্নান | ঘড়ি ধরে বেলা দশটার সময় বরফগলা ঠাণ্ডা জলে স্নান | ইহা হতে অব্যাহতির কোনো উপায় ছিল না | রবীন্দ্রনাথ লিখছেন , “তাঁহার আদেশের বিরুদ্ধে ঘড়ায় গরমজল মিশাইতেও ভৃত্যেরা কেহ সাহস করিত না |” অবশ্য পুত্রকে সাহস জোগানোর জন্য তিনি নিজে যৌবন কালে কিরূপ দুঃসহ শীতল জলে স্নান করিয়াছেন তার গল্প শুনাতেন |
দুপুরের আহারের পর রবীন্দ্রনাথকে পিতার কাছে আবার পড়তে বসতে হতো | কিন্তু সে পড়া অধিকদূর অগ্রসর হতে পারত না | কারণ সময় পুরো হবার পূর্বেই পিতা ছুটি ঘোষণা করে দিতেন | এই অকাল ছুটি ঘোষণার কারণও ছিল | রবীন্দ্রনাথের ভাষায় , ” প্রত্যুষের নষ্ট ঘুম তাহার অকাল ব্যাঘাতের শোধ লইত | আমি ঘুমে বার বার ঢুলিয়া পড়িতাম | আমার অবস্থা বুঝিয়া পিতা ছুটি দিবামাত্র ঘুম কোথায় ছুটিয়া যাইত |” ছুটিও হতো ঘুমও ছুটত | তখন কী করতেন ছোট্ট রবীন্দ্রনাথ | লাঠি হাতে একলা এক পাহাড় থেকে আর এক পাহাড়ে | দেবেন্দ্রনাথ এতে উদ্ বেগ প্রকাশও করেননি , বাধাও দেননি | এতে দেবেন্দ্রনাথের চরিত্রের আর একটি দিক প্রস্ফুটিত হয় |

( চলবে )

ফেসবুক দিয়ে আপনার মন্তব্য করুন
Spread the love

You may also like...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

কপি করার অনুমতি নেই।